২৫ মার্চ রাতে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম
নির্মলেন্দু গুণ
অভিনন্দনের জবাবে হাত নাড়ছেন বঙ্গবন্ধু কবিতার নিচে রচনার তারিখ লিপিবদ্ধ করা যে কতটা জরুরি, তা এখন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি। রবীন্দ্রনাথের প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে কী ভুলটাই না করেছি। আজ, চল্লিশ বছর আগের লেখা কোনো কবিতার দিকে যখন তাকাই, আবছা স্মৃতির মতো অতি-সামান্য কিছু মনে পড়ে। বুঝি, ওই সব কবিতার রচনা-তারিখ কোনো দিনই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ পৃথিবী একবারই পায় তারে, পায় নাকো আর। তবু রচনার কাছাকাছি সময়টা কবিতার চেহারার দিকে তাকিয়ে আমি মাঝে মাঝে ধরতে পারি। কিন্তু একটি কবিতা (‘হুলিয়া’) নিয়ে আমি খুবই ধন্ধের মধ্যে পড়েছি। কবিতাটিকে অনেকেই আমার প্রথম সফল কবিতা বলে বিবেচনা করেন, আমি নিজেও করি। ওই জনপ্রিয় কবিতাটির রচনাকাল নির্ণয় করার ব্যাপারে আমার প্রবল আগ্রহ ছিল, প্রয়োজনও ছিল; এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু ছয় মাস ধরে তদন্ত করেও আমি এর রচনাকাল নির্ণয়ে সফল হইনি। অনেক (আজাদ, সংবাদ, পূর্বদেশ) পত্রপত্রিকা ঘেঁটেও আমি ওই কবিতার রচনাকাল, কবিতাটি প্রথম কোথায় প্রকাশিত হয়েছিল, প্রথম কোথায় কবিতাটি পাঠ করেছিলাম, বা ওই কবিতার প্রথম শ্রোতা কে ছিল, কিছুই আমি আবিষ্কার করতে পারিনি।
আমার শুধু মনে পড়ে, বাংলা একাডেমীর কোনো একটি অনুষ্ঠানে আমি ওই কবিতাটি পাঠ করেছিলাম। কবিতা পাঠের আসরে প্রচুর জনসমাগম হয়েছিল। পাঠের পর মঞ্চ থেকে নেমে এলে অভিনেতা ও আবৃত্তিকার গোলাম মোস্তাফা আমাকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, একটি ভালো কবিতার বাজে আবৃত্তিতে তিনি খুবই মর্মাহত হয়েছেন।
সেটি কি কোনো একুশের কবিতা পাঠের আসর ছিল? হতে পারে। ১৯৭০-এর একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরেই হবে। বাংলা একাডেমী একুশের অনুষ্ঠানগুলোতে পাঠ করা কবিতা বা পঠিত প্রবন্ধের কোনো রেকর্ড রাখে না। তাই একাডেমীর সংস্কৃতি বিভাগ থেকেও এ-বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে, ‘আইয়ুব খান এখন কোথায়?’—কবিতার মধ্যে উত্থাপিত ওই প্রশ্ন পাঠে মনে হয়, কবিতাটি আইয়ুবের পতনের অব্যবহিত পরে রচিত হয়ে থাকবে। রচয়িতা এবং তাঁর সহযাত্রীদের জীবদ্দশায়ও ‘হুলিয়া’র রচনাকাল এবং প্রথম প্রকাশের স্থান নির্ণয় করা যে কারও পক্ষে সম্ভব হলো না—এটা খুবই দুঃখের বিষয়।
মনে আছে, ‘হুলিয়া’র প্রথম খসড়াটি আমার প্রিয় বন্ধু আবুল হাসান রাগ করে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। আগের দিন রাতে আমি আর হাসান সলিমুল্লাহ হলে ছিলাম। সম্ভবত হাসানের বাল্যসুহূদ মাহফুজুল হক খানের রুমে। পান এবং আড্ডার কারণে অনেক রাত করে আমরা ঘুমাই। তাই পরদিন বেশ দেরিতে আমার ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙার পর উঠে দেখি রুম ফাঁকা। হাসান চলে গেছে। তাকিয়ে দেখি টেবিল থেকে ‘হুলিয়া’ উধাও। তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে, রুম বন্ধ করে ছুটলাম শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনের উদ্দেশে। শরীফে যাওয়ার পথে ঘাসের মধ্যে ওই কবিতার কিছু ছেঁড়া অংশ আবিষ্কার করি। বুঝতে একটুও অসুবিধে হয় না যে আমার বন্ধু কবিতাটি পড়তে-পড়তে এবং ছিঁড়তে ছিঁড়তে শরীফের দিকে গেছে। জটায়ুর কর্তিত ডানা পথে পড়ে থাকতে দেখে শ্রীরামচন্দ্র যে রকম সীতার গমনপথের সন্ধান পেয়েছিলেন, আমিও তেমনি হাসানের গমনপথের সন্ধান পাই।
আমি যখন শরীফে পৌঁছি তখন সকাল ১০টা। হাসান চা-নাশতা সেরে, একটি অকবিতার হাত থেকে বাংলা সাহিত্যকে মুক্ত করতে পারার আনন্দে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল এবং চারপাশে ভিড় করে বসা তার কয়েকজন ভক্তকে কবিতা জিনিসটা আসলে কী, সে-সম্পর্কে জ্ঞান দান করছিল।
আমি শরীফে ঢুকেই পথ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ‘হুলিয়া’র কিছু ছেঁড়া অংশের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করি। হাসান প্রথমে একটু চমকে ওঠে। তারপর আমার দিক থেকে কিছুটা অভয় পেয়ে হাসে। বলে, এটা তো কবিতা নয়, গল্প। আবার লিখে ফেলো। রাগ করার কী আছে?
এজরা পাউন্ড যে এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ডের কতটা কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন, আমি জানি, তর্কে লিপ্ত হলে হাসান ওই প্রসঙ্গটি তুলবে। তাই আর তর্ক করলাম না। ঘটনাটি স্বীকার করায় হাসানের ওপর থেকে আমার রাগ পড়ে গেল। অবশ্য আমি খুব একটা রাগ করিওনি। আমি জানতাম যে ওই কবিতাটি আমার পক্ষে আবার রচনা করা খুবই সম্ভব।
আমি হাসানের পাশে গিয়ে বসলাম। বুঝলাম, মুখে সে যাই বলুক না কেন, ‘হুলিয়া’ কবিতাটি তার কবিতা-সম্পর্কিত ধারণাকে পাল্টে দিতে উদ্যত হয়েছিল বলেই ওই কবিতাটিকে সে না পারছিল সহ্য করতে, না পারছিল উপেক্ষা করতে। ওইদিনই আমি পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে ‘হুলিয়া’ কবিতাটি আবার নতুন করে লিখি। দ্বিতীয়বারের লেখাটি প্রথমবারের লেখা থেকে খুব একটা পৃথক হয়নি বলেই আমার ধারণা। আমি হাসানকে কবিতাটি পাঠ করে শোনাই। হাসান ‘হুলিয়া’র দ্বিতীয় পাঠ শোনার পর, একটি পরিবর্তনমুখী সময়ই যে এই কবিতাটি আমার হাত দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে, তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। এবং স্বীকার করে যে এই কবিতার মধ্যে ‘আমি’ এবং ‘দেশ’ এমনভাবে মিশে গেছে যে, এর একটি থেকে অন্যটিকে পৃথক করা কঠিন।
আমার হুলিয়াকবলিত জীবনের অভিজ্ঞতা একদিন এ রকম একটি কবিতার রূপ নিয়ে বেরিয়ে আসবে, আমি ভাবিনি। কবিতাটি লেখার পর আমি খুব খুশি হই।
প্রথম কোথায় ‘হুলিয়া’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল, তার সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়নি, আগেই বলেছি। এ প্রসঙ্গে কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা তাঁর স্মৃতি থেকে বলেছেন, আমার কণ্ঠে ওই কবিতা তিনি ১৯৬৯ সালে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একটি অনুষ্ঠানে শুনেছিলেন। ওই অনুষ্ঠান কলা ভবনের ২০১৩ নম্বর কক্ষে হয়েছিল এবং বাংলা বিভাগের প্রধান প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাই ওই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন। আমারও এ রকম একটা অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে। কিন্তু ওই অনুষ্ঠানে আমি কোন কবিতাটি পড়েছিলাম, তা মনে পড়ে না। হতে পারে ‘হুলিয়া’।
পরে কবিতাটি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের বই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আমার জানা মতে সেটি ছিল ‘হুলিয়া’ কবিতার পুনর্মুদ্রণ। ২১ জুলাই ১৯৭০ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে তরুণ কবিদের কবিতাপাঠের একটি আসর বসেছিল। ওই আসরে আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবু কায়সার, হুমায়ুন কবির, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, সানাউল হক খান, দাউদ হায়দার প্রমুখ কবি কবিতা পাঠ করেছিলেন।
ওই আসরে আমি ‘হুলিয়া’ পাঠ করি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ওই আসরে উপস্থিত ছিলেন। ওই কবিতাটি শোনার পর তিনি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় তাঁর জনপ্রিয় কলাম ‘তৃতীয় মত’-এ ‘হুলিয়া’ সম্পর্কে এ রকম মন্তব্য করেন:
‘গত মঙ্গলবার ঢাকার জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত একটি কবিতা পাঠের আসরে উপস্থিত ছিলাম। কয়েকজন তরুণ কবি কয়েকটি বিস্ময়কর উজ্জ্বল কবিতা পাঠ করেছেন এই আসরে। শ্রাবণ-সন্ধ্যায় এমন কবিতার আসর ঢাকায় আজকাল দুর্লভ। ভেবেছিলাম, অধিকাংশ তরুণ কবি এই আসরে এমন কবিতা পাঠ করবেন, যার মূল কথা হবে—সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এই জীবনের কলরব।
‘কিন্তু তা নয়। এই আসরে একটি সুস্থ, সাম্প্রতিক কণ্ঠ শুনলাম একটি কবিতায়। কবিতার নাম সম্ভবত হুলিয়া। কবির নাম নির্মলেন্দু গুণ। ফেরারী নায়ক গ্রামে ফিরেছেন। তার শৈশব ও কৈশোরের অতি-পরিচিত খাল-বিল, মাঠ-ঘাট, পথ সবই তার কাছে বহুবার দেখা ছবির মতো। অথচ কেউ তাকে চিনতে পারছে না। যেমন তাকে চিনতে পারেনি স্টেশনের গোয়েন্দা পুলিশ এবং টিকিট চেকার। নায়ক ফিরে এলো মায়ের কাছে, সংসারের প্রাত্যহিক দাবির কাছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সকলের কণ্ঠেই একটি প্রশ্ন—দেশের কী হবে? শেখ সাহেব এখন কী করবেন? কবিতার নায়ক জবাব দেয়…আমি এসবের কিছুই জানি না—আমি এসবের কিছুই বুঝি না
‘জানি না কবিতাটির আখ্যান সংক্ষেপে বর্ণনা করতে পেরেছি কি না। দীর্ঘ কবিতা। তাতে শুধু কবিতার স্বাদ নয়, সাম্প্রতিক রাজনীতির যুগ-জিজ্ঞাসাও বেশ স্পষ্ট। এ যেন বাংলার ক্ষুব্ধ তারুণ্যের স্বগতোক্তি। এই জবাবের চাইতে বড় সত্য এই মুহূর্তে জন-চেতনায় আর কিছু নেই।’ [দ্র: তৃতীয় মত—আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, পূর্বদেশ, ২৪ জুলাই ১৯৭০]
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ওই কলামটি তখন খুবই জনপ্রিয় ছিল বলে ওই কলাম পাঠ করে অনেকেই আমার ‘হুলিয়া’ কবিতার খোঁজ করেন। ওই কবিতাটি আমার কবি-স্বীকৃতি লাভেই শুধু সহায়তা করেনি, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক পাওয়ার ব্যাপারেও সহায়ক হয়েছিল। ওই কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পরই খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোং-এর মালিক মোসলেম খান তাঁর পুত্রদের ‘হুলিয়া’র কবিকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। তাঁর আগ্রহের কারণ অবশ্য শুধুই ‘হুলিয়া’ ছিল না, আমার গুণ পদবিটিও ছিল তাঁর আগ্রহের একটি উত্স। ছাত্রজীবনে তিনি মানিকগঞ্জের ইব্রাহিমপুর স্কুলে মণীন্দ্র গুণ মহাশয়ের ছাত্র ছিলেন, আমি ওই মনীন্দ্র গুণের সঙ্গে রক্তসূত্রে যুক্ত কি না, তা জানার জন্যও তিনি আমার সন্ধান করেন। মণীন্দ্র গুণ ছিলেন আমার জ্ঞাতি-ভাই। একদিন বিউটি বোর্ডিংয়ে ঢোকার পথে মোসলেম খান সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি আমাকে ‘হুলিয়া’ কবিতাটির জন্য প্রশংসা করেন এবং আমাকে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে বলেন। জীবনানন্দ দাশের কাব্যসমগ্র প্রকাশ করার কারণে ওই প্রকাশনীটি তখন সুধীমহলের, বিশেষ করে কবিমহলের সুনজরে পড়েছিল।
আমার কবিতার বই প্রকাশ করার জন্য আমি নওরোজ কিতাবিস্তান, মওলা ব্রাদার্স এবং বইঘরের কাছে ধরনা দিয়ে ব্যর্থ হই। তাদের কেউই আমার বই প্রকাশ করার ঝুঁকি নিতে রাজি হননি। তখন পর্যন্ত আধুনিক কবিতার বইয়ের কাটতি এমন কম ছিল যে আল মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর কবি-সাহিত্যিকের যৌথ উদ্যোগে গড়া কপোতাক্ষ নামক একটি প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করতে হয়েছিল। শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতার বইও প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর অনুরাগী-বন্ধু শিল্পপতি আবদুল বারিক চৌধুরী (এবিসি নামেই তিনি ঢাকার সুধীমহলে পরিচিত ছিলেন) আর্থিক আনুকূল্যে। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর প্রথম কবিতার বই জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ নিজেই প্রকাশ করেছিলেন।
কবিতার বইয়ের এই প্রকাশনা ও পাঠক-সংকটজনিত পরিস্থিতিটা আমার কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কয়েকজন প্রকাশক আমাকে নিরাশ করলেও, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, অচিরেই এই অবস্থার অবসান হবে। পাঠক যখন কবিতার দিকে ঝুঁকছে, তখন প্রকাশকেরাও ক্রমশ কবিতার দিকে ঝুঁকবে।
খান ব্রাদার্স নিজ থেকে আমার কবিতার বই প্রকাশ করতে আগ্রহী হওয়ায়, আমি খুব খুশি হই। আমার জেনারেশনের কবিদের মধ্যে এমন সৌভাগ্য হয় আমারই প্রথম।
বঙ্গবন্ধু কবি হিসেবে আমাকে আগে থেকেই জানতেন। তাঁকে উত্সর্গ করে রচিত আমার প্রথম কবিতা ‘প্রচ্ছদের জন্য’ প্রকাশিত হয় সংবাদ-এর ১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর সংখ্যায়। কবিতাটি তিনি যে পাঠ করে খুব আনন্দ পেয়েছিলেন এবং গর্ব বোধ করেছিলেন, সে কথা আমি জেনেছিলাম রণেশ দাশগুপ্তের মুখে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর একদিন (সম্ভবত সংবাদ কার্যালয়ে) তাঁর সঙ্গে দেখা হলে তিনি ঘটনাটির কথা আমাকে বলেছিলেন। পরে এক সময় আওয়ামী লীগের অগ্রজতুল্য নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর কাছেও শুনেছিলাম। আগরতলা ও গোলটেবিলের চাপে হয়তো তিনি আমার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। গাফ্ফার ভাইয়ের কলাম পাঠ করার পর আমার কথা নতুন করে তাঁর মনে পড়ে। তিনি আমার সঙ্গে ‘হুলিয়া’ নিয়ে আলাপ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। [তথ্য: আবিদুর রহমান, সম্পাদক, দি পিপল]
বিস্তারিত তথ্যের জন্য আবিদুর রহমানের সন্ধান করা যেতে পারে। আবিদ ভাই আমাকে তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতে বললেও, আমি আজ যাব কাল যাব করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারটিকে বারবার পিছিয়ে দিচ্ছিলাম। একপর্যায়ে আবিদ ভাই রণে ভঙ্গ দেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে দূর থেকেই দেখব, কখনো তাঁর কাছে যাব না, তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হব না বলেও মনে-মনে স্থির করি।
আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া সেই নির্বাচন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ তো বটেই, সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ব্যাপারে পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তানের অসামরিক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে গোপন মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ পাড়ি দিয়ে আসে একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ। পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে রোপিত হয় বাংলাদেশের রক্তবীজ। বাংলাদেশের নতুন পতাকা নিয়ে আসে ২ মার্চ। জাতীয় সংগীত ও স্বাধীনতার ইশতেহার নিয়ে আসে ৩ মার্চ। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’—বঙ্গবন্ধুর এই অমর কবিতা নিয়ে আসে ৭ মার্চ। আমি মন্ত্রমুগ্ধবত্ মঞ্চের পশ্চিমপাশে সাংবাদিকদের জন্য সংরক্ষিত আসনে বসে বঙ্গবন্ধুর সেই কালজয়ী ভাষণটি শ্রবণ করি। ফিরে এসে দি পিপল গ্রুপ থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক গণবাংলার জন্য ৭ মার্চের ওপর একটি কবিতাও লিখেছিলাম। সেদিনই সন্ধ্যায় গণবাংলার টেলিগ্রামে সেই কবিতাটি ছাপা হয়।
অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধীর একক-কৃতিত্বে ভাগ বসিয়ে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন। শুরু হয় ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অর্থহীন আলোচনা-আলোচনা খেলা। এককাট্টা হয়ে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর পেছনে দাঁড়ায়। পাকিস্তান দিবসে তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ান। গাড়িতে বাংলাদেশের জন্য অনুমোদিত লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়েই তিনি ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় যোগ দেন। তাঁর সাহস, দূরদৃষ্টি ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। পাকিস্তানিদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার সংবাদে আমি অন্তরে পুলকিত বোধ করি। বুঝতে পারি, ইয়াহিয়া-ভুট্টো নন, ধৈর্যের অগ্নি-পরীক্ষায় শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই জয়ী হতে চলেছেন।
‘হুলিয়া’ কবিতায় একটি পঙিক্ত ছিল, ‘শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?’ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব সম্পর্কে আমার এই সংশয়-যুক্ত পঙিক্তটি আমি মনে মনে আমার ‘হুলিয়া’ কবিতা থেকে প্রত্যাহার করি। আমার মনে এই প্রত্যয় জন্মায় যে সাতই মার্চের জনসভায় প্রদত্ত চার-শর্ত নয়, তাঁর মুক্তি ও স্বাধীনতার কৌশলী ঘোষণাটিই শেষ পর্যন্ত কার্যকর হতে চলেছে। ভাবি, আর বিলম্ব করা ঠিক হবে না। তিনি যে ভুল করছেন না, এই প্রয়োজনীয় কথাটা আমার দিক থেকে তাঁকে বলা দরকার।
কাছে যাওয়ার সুযোগ পেলে আমি বঙ্গবন্ধুকে এই কথাটাই বলব, এই মনে করে সন্ধ্যার দিকে আমি ছাত্রলীগের নেতা সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি সৈয়দ আহমদ ফারুকের সঙ্গে বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাই। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যে-বাড়িটি পরিণত হয়েছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সবচেয়ে প্রিয়ভবনে। কিন্তু তখন বড় বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিল। দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত খালেদ ভাইয়ের (প্রভু খালেদ চৌধুরী, তখন এপিএনে কর্মরত ছিলেন) সঙ্গে লনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলি। বঙ্গবন্ধু সেদিন আর বাইরে বেরিয়ে আসেননি। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়া বা কথা বলা তো দূরের কথা, তাঁকে একনজর দেখার সুযোগও আমার হয় না। তাঁর প্রেস সচিব আমিনুল হক বাদশা জানান যে বঙ্গবন্ধু হাইকমান্ডের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসেছেন। তিনি আজ বাইরে বেরোবেন না।
আমি গাড়ি-বারান্দার ছাদের ওপর দাঁড়ানো বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে দেখতে পাই। হাজার মানুষের ভিড়েও আমাকে চিনতে পেরে তিনি মৃদু হাত নাড়েন। সেই হাত নাড়ার অর্থ আমার কাছে স্পষ্ট হয় না। তবু আমি তাঁর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কথা একবার ভেবেছিলাম, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারও মাধ্যমে পরিচিত হতে আমার মন শেষ পর্যন্ত সায় দেয়নি। আমি রাত ১০টার দিকে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসি।
বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার অপরাধে ওই রাতেই তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী হন। তারিখটি ছিল ২৫ মার্চ ১৯৭১।
নির্মলেন্দু গুণ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০২, ২০১০
আমার শুধু মনে পড়ে, বাংলা একাডেমীর কোনো একটি অনুষ্ঠানে আমি ওই কবিতাটি পাঠ করেছিলাম। কবিতা পাঠের আসরে প্রচুর জনসমাগম হয়েছিল। পাঠের পর মঞ্চ থেকে নেমে এলে অভিনেতা ও আবৃত্তিকার গোলাম মোস্তাফা আমাকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, একটি ভালো কবিতার বাজে আবৃত্তিতে তিনি খুবই মর্মাহত হয়েছেন।
সেটি কি কোনো একুশের কবিতা পাঠের আসর ছিল? হতে পারে। ১৯৭০-এর একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরেই হবে। বাংলা একাডেমী একুশের অনুষ্ঠানগুলোতে পাঠ করা কবিতা বা পঠিত প্রবন্ধের কোনো রেকর্ড রাখে না। তাই একাডেমীর সংস্কৃতি বিভাগ থেকেও এ-বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে, ‘আইয়ুব খান এখন কোথায়?’—কবিতার মধ্যে উত্থাপিত ওই প্রশ্ন পাঠে মনে হয়, কবিতাটি আইয়ুবের পতনের অব্যবহিত পরে রচিত হয়ে থাকবে। রচয়িতা এবং তাঁর সহযাত্রীদের জীবদ্দশায়ও ‘হুলিয়া’র রচনাকাল এবং প্রথম প্রকাশের স্থান নির্ণয় করা যে কারও পক্ষে সম্ভব হলো না—এটা খুবই দুঃখের বিষয়।
মনে আছে, ‘হুলিয়া’র প্রথম খসড়াটি আমার প্রিয় বন্ধু আবুল হাসান রাগ করে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। আগের দিন রাতে আমি আর হাসান সলিমুল্লাহ হলে ছিলাম। সম্ভবত হাসানের বাল্যসুহূদ মাহফুজুল হক খানের রুমে। পান এবং আড্ডার কারণে অনেক রাত করে আমরা ঘুমাই। তাই পরদিন বেশ দেরিতে আমার ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙার পর উঠে দেখি রুম ফাঁকা। হাসান চলে গেছে। তাকিয়ে দেখি টেবিল থেকে ‘হুলিয়া’ উধাও। তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে, রুম বন্ধ করে ছুটলাম শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনের উদ্দেশে। শরীফে যাওয়ার পথে ঘাসের মধ্যে ওই কবিতার কিছু ছেঁড়া অংশ আবিষ্কার করি। বুঝতে একটুও অসুবিধে হয় না যে আমার বন্ধু কবিতাটি পড়তে-পড়তে এবং ছিঁড়তে ছিঁড়তে শরীফের দিকে গেছে। জটায়ুর কর্তিত ডানা পথে পড়ে থাকতে দেখে শ্রীরামচন্দ্র যে রকম সীতার গমনপথের সন্ধান পেয়েছিলেন, আমিও তেমনি হাসানের গমনপথের সন্ধান পাই।
আমি যখন শরীফে পৌঁছি তখন সকাল ১০টা। হাসান চা-নাশতা সেরে, একটি অকবিতার হাত থেকে বাংলা সাহিত্যকে মুক্ত করতে পারার আনন্দে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল এবং চারপাশে ভিড় করে বসা তার কয়েকজন ভক্তকে কবিতা জিনিসটা আসলে কী, সে-সম্পর্কে জ্ঞান দান করছিল।
আমি শরীফে ঢুকেই পথ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ‘হুলিয়া’র কিছু ছেঁড়া অংশের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করি। হাসান প্রথমে একটু চমকে ওঠে। তারপর আমার দিক থেকে কিছুটা অভয় পেয়ে হাসে। বলে, এটা তো কবিতা নয়, গল্প। আবার লিখে ফেলো। রাগ করার কী আছে?
এজরা পাউন্ড যে এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ডের কতটা কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন, আমি জানি, তর্কে লিপ্ত হলে হাসান ওই প্রসঙ্গটি তুলবে। তাই আর তর্ক করলাম না। ঘটনাটি স্বীকার করায় হাসানের ওপর থেকে আমার রাগ পড়ে গেল। অবশ্য আমি খুব একটা রাগ করিওনি। আমি জানতাম যে ওই কবিতাটি আমার পক্ষে আবার রচনা করা খুবই সম্ভব।
আমি হাসানের পাশে গিয়ে বসলাম। বুঝলাম, মুখে সে যাই বলুক না কেন, ‘হুলিয়া’ কবিতাটি তার কবিতা-সম্পর্কিত ধারণাকে পাল্টে দিতে উদ্যত হয়েছিল বলেই ওই কবিতাটিকে সে না পারছিল সহ্য করতে, না পারছিল উপেক্ষা করতে। ওইদিনই আমি পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে ‘হুলিয়া’ কবিতাটি আবার নতুন করে লিখি। দ্বিতীয়বারের লেখাটি প্রথমবারের লেখা থেকে খুব একটা পৃথক হয়নি বলেই আমার ধারণা। আমি হাসানকে কবিতাটি পাঠ করে শোনাই। হাসান ‘হুলিয়া’র দ্বিতীয় পাঠ শোনার পর, একটি পরিবর্তনমুখী সময়ই যে এই কবিতাটি আমার হাত দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে, তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। এবং স্বীকার করে যে এই কবিতার মধ্যে ‘আমি’ এবং ‘দেশ’ এমনভাবে মিশে গেছে যে, এর একটি থেকে অন্যটিকে পৃথক করা কঠিন।
আমার হুলিয়াকবলিত জীবনের অভিজ্ঞতা একদিন এ রকম একটি কবিতার রূপ নিয়ে বেরিয়ে আসবে, আমি ভাবিনি। কবিতাটি লেখার পর আমি খুব খুশি হই।
প্রথম কোথায় ‘হুলিয়া’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল, তার সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়নি, আগেই বলেছি। এ প্রসঙ্গে কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা তাঁর স্মৃতি থেকে বলেছেন, আমার কণ্ঠে ওই কবিতা তিনি ১৯৬৯ সালে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একটি অনুষ্ঠানে শুনেছিলেন। ওই অনুষ্ঠান কলা ভবনের ২০১৩ নম্বর কক্ষে হয়েছিল এবং বাংলা বিভাগের প্রধান প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাই ওই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন। আমারও এ রকম একটা অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে। কিন্তু ওই অনুষ্ঠানে আমি কোন কবিতাটি পড়েছিলাম, তা মনে পড়ে না। হতে পারে ‘হুলিয়া’।
পরে কবিতাটি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের বই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আমার জানা মতে সেটি ছিল ‘হুলিয়া’ কবিতার পুনর্মুদ্রণ। ২১ জুলাই ১৯৭০ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে তরুণ কবিদের কবিতাপাঠের একটি আসর বসেছিল। ওই আসরে আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবু কায়সার, হুমায়ুন কবির, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, সানাউল হক খান, দাউদ হায়দার প্রমুখ কবি কবিতা পাঠ করেছিলেন।
ওই আসরে আমি ‘হুলিয়া’ পাঠ করি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ওই আসরে উপস্থিত ছিলেন। ওই কবিতাটি শোনার পর তিনি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় তাঁর জনপ্রিয় কলাম ‘তৃতীয় মত’-এ ‘হুলিয়া’ সম্পর্কে এ রকম মন্তব্য করেন:
‘গত মঙ্গলবার ঢাকার জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত একটি কবিতা পাঠের আসরে উপস্থিত ছিলাম। কয়েকজন তরুণ কবি কয়েকটি বিস্ময়কর উজ্জ্বল কবিতা পাঠ করেছেন এই আসরে। শ্রাবণ-সন্ধ্যায় এমন কবিতার আসর ঢাকায় আজকাল দুর্লভ। ভেবেছিলাম, অধিকাংশ তরুণ কবি এই আসরে এমন কবিতা পাঠ করবেন, যার মূল কথা হবে—সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এই জীবনের কলরব।
‘কিন্তু তা নয়। এই আসরে একটি সুস্থ, সাম্প্রতিক কণ্ঠ শুনলাম একটি কবিতায়। কবিতার নাম সম্ভবত হুলিয়া। কবির নাম নির্মলেন্দু গুণ। ফেরারী নায়ক গ্রামে ফিরেছেন। তার শৈশব ও কৈশোরের অতি-পরিচিত খাল-বিল, মাঠ-ঘাট, পথ সবই তার কাছে বহুবার দেখা ছবির মতো। অথচ কেউ তাকে চিনতে পারছে না। যেমন তাকে চিনতে পারেনি স্টেশনের গোয়েন্দা পুলিশ এবং টিকিট চেকার। নায়ক ফিরে এলো মায়ের কাছে, সংসারের প্রাত্যহিক দাবির কাছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সকলের কণ্ঠেই একটি প্রশ্ন—দেশের কী হবে? শেখ সাহেব এখন কী করবেন? কবিতার নায়ক জবাব দেয়…আমি এসবের কিছুই জানি না—আমি এসবের কিছুই বুঝি না
‘জানি না কবিতাটির আখ্যান সংক্ষেপে বর্ণনা করতে পেরেছি কি না। দীর্ঘ কবিতা। তাতে শুধু কবিতার স্বাদ নয়, সাম্প্রতিক রাজনীতির যুগ-জিজ্ঞাসাও বেশ স্পষ্ট। এ যেন বাংলার ক্ষুব্ধ তারুণ্যের স্বগতোক্তি। এই জবাবের চাইতে বড় সত্য এই মুহূর্তে জন-চেতনায় আর কিছু নেই।’ [দ্র: তৃতীয় মত—আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, পূর্বদেশ, ২৪ জুলাই ১৯৭০]
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ওই কলামটি তখন খুবই জনপ্রিয় ছিল বলে ওই কলাম পাঠ করে অনেকেই আমার ‘হুলিয়া’ কবিতার খোঁজ করেন। ওই কবিতাটি আমার কবি-স্বীকৃতি লাভেই শুধু সহায়তা করেনি, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক পাওয়ার ব্যাপারেও সহায়ক হয়েছিল। ওই কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পরই খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোং-এর মালিক মোসলেম খান তাঁর পুত্রদের ‘হুলিয়া’র কবিকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। তাঁর আগ্রহের কারণ অবশ্য শুধুই ‘হুলিয়া’ ছিল না, আমার গুণ পদবিটিও ছিল তাঁর আগ্রহের একটি উত্স। ছাত্রজীবনে তিনি মানিকগঞ্জের ইব্রাহিমপুর স্কুলে মণীন্দ্র গুণ মহাশয়ের ছাত্র ছিলেন, আমি ওই মনীন্দ্র গুণের সঙ্গে রক্তসূত্রে যুক্ত কি না, তা জানার জন্যও তিনি আমার সন্ধান করেন। মণীন্দ্র গুণ ছিলেন আমার জ্ঞাতি-ভাই। একদিন বিউটি বোর্ডিংয়ে ঢোকার পথে মোসলেম খান সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি আমাকে ‘হুলিয়া’ কবিতাটির জন্য প্রশংসা করেন এবং আমাকে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে বলেন। জীবনানন্দ দাশের কাব্যসমগ্র প্রকাশ করার কারণে ওই প্রকাশনীটি তখন সুধীমহলের, বিশেষ করে কবিমহলের সুনজরে পড়েছিল।
আমার কবিতার বই প্রকাশ করার জন্য আমি নওরোজ কিতাবিস্তান, মওলা ব্রাদার্স এবং বইঘরের কাছে ধরনা দিয়ে ব্যর্থ হই। তাদের কেউই আমার বই প্রকাশ করার ঝুঁকি নিতে রাজি হননি। তখন পর্যন্ত আধুনিক কবিতার বইয়ের কাটতি এমন কম ছিল যে আল মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর কবি-সাহিত্যিকের যৌথ উদ্যোগে গড়া কপোতাক্ষ নামক একটি প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করতে হয়েছিল। শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতার বইও প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর অনুরাগী-বন্ধু শিল্পপতি আবদুল বারিক চৌধুরী (এবিসি নামেই তিনি ঢাকার সুধীমহলে পরিচিত ছিলেন) আর্থিক আনুকূল্যে। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর প্রথম কবিতার বই জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ নিজেই প্রকাশ করেছিলেন।
কবিতার বইয়ের এই প্রকাশনা ও পাঠক-সংকটজনিত পরিস্থিতিটা আমার কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কয়েকজন প্রকাশক আমাকে নিরাশ করলেও, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, অচিরেই এই অবস্থার অবসান হবে। পাঠক যখন কবিতার দিকে ঝুঁকছে, তখন প্রকাশকেরাও ক্রমশ কবিতার দিকে ঝুঁকবে।
খান ব্রাদার্স নিজ থেকে আমার কবিতার বই প্রকাশ করতে আগ্রহী হওয়ায়, আমি খুব খুশি হই। আমার জেনারেশনের কবিদের মধ্যে এমন সৌভাগ্য হয় আমারই প্রথম।
বঙ্গবন্ধু কবি হিসেবে আমাকে আগে থেকেই জানতেন। তাঁকে উত্সর্গ করে রচিত আমার প্রথম কবিতা ‘প্রচ্ছদের জন্য’ প্রকাশিত হয় সংবাদ-এর ১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর সংখ্যায়। কবিতাটি তিনি যে পাঠ করে খুব আনন্দ পেয়েছিলেন এবং গর্ব বোধ করেছিলেন, সে কথা আমি জেনেছিলাম রণেশ দাশগুপ্তের মুখে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর একদিন (সম্ভবত সংবাদ কার্যালয়ে) তাঁর সঙ্গে দেখা হলে তিনি ঘটনাটির কথা আমাকে বলেছিলেন। পরে এক সময় আওয়ামী লীগের অগ্রজতুল্য নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর কাছেও শুনেছিলাম। আগরতলা ও গোলটেবিলের চাপে হয়তো তিনি আমার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। গাফ্ফার ভাইয়ের কলাম পাঠ করার পর আমার কথা নতুন করে তাঁর মনে পড়ে। তিনি আমার সঙ্গে ‘হুলিয়া’ নিয়ে আলাপ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। [তথ্য: আবিদুর রহমান, সম্পাদক, দি পিপল]
বিস্তারিত তথ্যের জন্য আবিদুর রহমানের সন্ধান করা যেতে পারে। আবিদ ভাই আমাকে তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতে বললেও, আমি আজ যাব কাল যাব করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারটিকে বারবার পিছিয়ে দিচ্ছিলাম। একপর্যায়ে আবিদ ভাই রণে ভঙ্গ দেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে দূর থেকেই দেখব, কখনো তাঁর কাছে যাব না, তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হব না বলেও মনে-মনে স্থির করি।
আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া সেই নির্বাচন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ তো বটেই, সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ব্যাপারে পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তানের অসামরিক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে গোপন মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ পাড়ি দিয়ে আসে একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ। পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে রোপিত হয় বাংলাদেশের রক্তবীজ। বাংলাদেশের নতুন পতাকা নিয়ে আসে ২ মার্চ। জাতীয় সংগীত ও স্বাধীনতার ইশতেহার নিয়ে আসে ৩ মার্চ। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’—বঙ্গবন্ধুর এই অমর কবিতা নিয়ে আসে ৭ মার্চ। আমি মন্ত্রমুগ্ধবত্ মঞ্চের পশ্চিমপাশে সাংবাদিকদের জন্য সংরক্ষিত আসনে বসে বঙ্গবন্ধুর সেই কালজয়ী ভাষণটি শ্রবণ করি। ফিরে এসে দি পিপল গ্রুপ থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক গণবাংলার জন্য ৭ মার্চের ওপর একটি কবিতাও লিখেছিলাম। সেদিনই সন্ধ্যায় গণবাংলার টেলিগ্রামে সেই কবিতাটি ছাপা হয়।
অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধীর একক-কৃতিত্বে ভাগ বসিয়ে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন। শুরু হয় ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অর্থহীন আলোচনা-আলোচনা খেলা। এককাট্টা হয়ে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর পেছনে দাঁড়ায়। পাকিস্তান দিবসে তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ান। গাড়িতে বাংলাদেশের জন্য অনুমোদিত লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়েই তিনি ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় যোগ দেন। তাঁর সাহস, দূরদৃষ্টি ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। পাকিস্তানিদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার সংবাদে আমি অন্তরে পুলকিত বোধ করি। বুঝতে পারি, ইয়াহিয়া-ভুট্টো নন, ধৈর্যের অগ্নি-পরীক্ষায় শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই জয়ী হতে চলেছেন।
‘হুলিয়া’ কবিতায় একটি পঙিক্ত ছিল, ‘শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?’ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব সম্পর্কে আমার এই সংশয়-যুক্ত পঙিক্তটি আমি মনে মনে আমার ‘হুলিয়া’ কবিতা থেকে প্রত্যাহার করি। আমার মনে এই প্রত্যয় জন্মায় যে সাতই মার্চের জনসভায় প্রদত্ত চার-শর্ত নয়, তাঁর মুক্তি ও স্বাধীনতার কৌশলী ঘোষণাটিই শেষ পর্যন্ত কার্যকর হতে চলেছে। ভাবি, আর বিলম্ব করা ঠিক হবে না। তিনি যে ভুল করছেন না, এই প্রয়োজনীয় কথাটা আমার দিক থেকে তাঁকে বলা দরকার।
কাছে যাওয়ার সুযোগ পেলে আমি বঙ্গবন্ধুকে এই কথাটাই বলব, এই মনে করে সন্ধ্যার দিকে আমি ছাত্রলীগের নেতা সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি সৈয়দ আহমদ ফারুকের সঙ্গে বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাই। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যে-বাড়িটি পরিণত হয়েছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সবচেয়ে প্রিয়ভবনে। কিন্তু তখন বড় বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিল। দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত খালেদ ভাইয়ের (প্রভু খালেদ চৌধুরী, তখন এপিএনে কর্মরত ছিলেন) সঙ্গে লনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলি। বঙ্গবন্ধু সেদিন আর বাইরে বেরিয়ে আসেননি। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়া বা কথা বলা তো দূরের কথা, তাঁকে একনজর দেখার সুযোগও আমার হয় না। তাঁর প্রেস সচিব আমিনুল হক বাদশা জানান যে বঙ্গবন্ধু হাইকমান্ডের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসেছেন। তিনি আজ বাইরে বেরোবেন না।
আমি গাড়ি-বারান্দার ছাদের ওপর দাঁড়ানো বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে দেখতে পাই। হাজার মানুষের ভিড়েও আমাকে চিনতে পেরে তিনি মৃদু হাত নাড়েন। সেই হাত নাড়ার অর্থ আমার কাছে স্পষ্ট হয় না। তবু আমি তাঁর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কথা একবার ভেবেছিলাম, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারও মাধ্যমে পরিচিত হতে আমার মন শেষ পর্যন্ত সায় দেয়নি। আমি রাত ১০টার দিকে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসি।
বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার অপরাধে ওই রাতেই তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী হন। তারিখটি ছিল ২৫ মার্চ ১৯৭১।
নির্মলেন্দু গুণ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০২, ২০১০
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ৬০ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন