বর্তমানে আমরা এমন একটি সময়ে বসবাস করছি, যেখানে তারুণ্যের শক্তির অবস্থা খুবই ভঙ্গুর। আমরা যদি তাদের স্নোফ্ল্যাক্সও বলি, ভুল হবে না। স্নোফ্ল্যাক্স বিষয়টি সহজে যদি বলি, আপনি স্নো বা শুভ্র বরফের ঢিবিও বলতে পারেন। মানে, শুভ্র বরফ দিয়ে আপনি একটি ঢিবি বানালেন। দূর থেকে মনে হবে ঢিবিটি হয়তো অনেক শক্তিশালী, তবে বাস্তবতা ভিন্ন, তা আপনারা সবাই জানেন। কারণ দেখতে শক্ত হলেও খুব অল্প আঘাতেই তা ভেঙে যাবে। কারণ তার ভেতরে পুরোই ফাঁপা। আমাদের এই জেনারেশনটিও সেই স্নোফ্ল্যাক্স-এর মতোই, ঠুনকো ও ভেতর থেকে একদমই ভঙ্গুর। এদের নিয়ে বিজ্ঞানীদেরও অনেক চিন্তা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে এই ব্যাধির প্রভাব পড়বে পুরো বিশ্বের আর্থিক পরিবেশেও। তারা একটি জরিপে জানান, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বসবাসকারী ৭৫%-এরও বেশি মানুষ ডিপ্রেশন নামক এই অদৃশ্য ব্যাধির চিকিৎসা নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (American Psychiatric Association) ডিপ্রেশন নিয়ে বেশ কিছু লক্ষণ উদ্ঘাটন করেছেন। যেমন ধরুন, অল্পতেই রেগে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, মন খারাপ করা, পছন্দের কাজে অনীহা, সবসময় বিরক্তি ও অস্থিরতা কাজ করা, নিজেকে সবার থেকে আড়ালে রাখা, খাওয়ায় অরুচি, ওজন কমে যাওয়ার মতো আরো অনেক কিছুই রয়েছে এই লক্ষণের মধ্যে।
তবে সবচেয়ে ভয়াবহ এবং শেষ পরিণতি হলো নিজের জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। আমরা বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা না নিয়ে মানবিক চিকিৎসা নিতে যাই। যারা নিজেরাই একেকজন বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার কিংবা বাইপোলার ডিসঅর্ডার রোগী। আবার অনেকে আছেন, যারা পেইন ক্যাটাস্ট্রোফাইজিং এর রোগী। অর্থাৎ তারা তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ছোট ঘটনাকেও অনেক বড় করে দেখেন এবং তা ভেবেই সারা সময় পার করে দেন। আর এই অসচেতনতার ফলে মানব দেহের গুরুত্বপূর্ণ পদার্থ সেরোটোনিন (Serotonin) কমে যায়। ধীরে ধীরে মানুষ রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস (Rheumatoid Arthritis) মতো রোগেও আক্রান্ত হতে পারেন। আবার এটি হয়ে উঠতে পারে আমাদের চিরচেনা রোগ- প্রেশার, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, মৃগী রোগের উৎস।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বের প্রায় 280 মিলিয়ন মানুষের বিষণ্নতা। যার ফলে প্রতিবছর 700 000 এর বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। আর এদের অধিকাংশের বয়স সীমা হলো 15-29 বছর।
তবে ডিপ্রেশন নামের এই মরণব্যাধির কারণ হলো যে, আমাদের এই প্রজন্ম স্বাভাবিক পরিবেশের সাথে নিজেদের সম্পূর্ণরূপে গড়ে তুলতে পারে না। কারণ বর্তমানে আমাদের সমাজের বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে এতটাই আদর-যত্নে লালন-পালন করতে চান যে, তাদের কোনো প্রকার সমস্যা হোক তা তারা মেনে নিতে পারেন না। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বলেন কিংবা উচ্চবিত্ত যারা আছেন, তারা দেখা যায় তাদের সন্তানকে কোনো প্রকার কসরত কিংবা পরিশ্রমের দিকগুলো থেকে সরিয়ে রাখতে চান। যার ফলে তাদের সন্তান স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে অনেকটাই দূরে সরে যায়। তারা তাদের সন্তানকে এতটাই আগলে রাখতে চান যে খাট থেকে নামতে দিতেও তারা নারাজ। তারা তাদের সন্তানকে এতটাই অবলা মনে করেন যে, সন্তানকে মাঠেও পর্যন্ত যেতে দেন না। কারণ, পড়ে ব্যথা পাবে। সাইকেল চালানো নিষেধ, সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে যদি ছিঁলে যায়। মাঠে খেলা যাবে না, ব্যথা পেতে পারে। এখন আপনারাই বলুন, স্বাভাবিক পরিবেশের সাথে সে কিভাবে নিজেকে মানিয়ে নেবে? পরিবেশের সাথে তার সখ্যতা কিভাবে হবে? কিভাবেই বা তার পরিশ্রমী মনোভাব আসবে? কিভাবে এবার সে নিজেকে পরিবেশের মতো করে গড়ে তুলবে?
হারা এস্ট্রফ মারানো সেসব অভিভাবকদের নিন্দা জানিয়েছেন, যারা তাদের সন্তানকে সোনার চামচ মুখে দিয়ে বড় করেন বা করতে চান। সাইকেল চালাতে দেন না, যদি পড়ে যায়, গাড়ি চালাতে দেন না, যদি এক্সিডেন্ট করে, মাঠে খেলতে দেন না, যদি পড়ে ব্যথা পায়। আবার অনেকে তো সন্তানকে বাজারে পাঠাতেও নারাজ। এখন আপনারাই বলুন, তাদের অভিজ্ঞতার গণ্ডি কতটুকু হবে?
অপরদিকে দেখুন, নিম্নশ্রেণীর কোনো ব্যক্তির সন্তানরা খুব সহজেই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। সকল পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এর কারণ কি? কারণ হলো, সে ছোট থেকেই ঐ পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত। সে মাঠে-ঘাটে ঘুরে, পানিতে লাফায়, সাইকেল চালাচ্ছে। কোথায় সে তো অস্বাভাবিক জীবনে নেই। হ্যাঁ, সে ব্যথা পাচ্ছে কিন্তু নিজেকে পরিবেশের মতো করে গড়ে তুলতে পারছে।
একজন মানুষ তখনই মানসিক চাপের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, যখন সে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে ছোট থেকেই দায়িত্বপরায়ণ হতে থাকে। নিজের ভুল স্বীকার ও ভুলের দায় গ্রহণ করতে শিখে। এতে তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ছোটখাটো কোনো ঘটনা তাকে কাবু করতে পারে না।
আমাদের আধুনিক বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের জীবনকে সুরক্ষিত করছেন ঠিকই, তবে তা ভবিষ্যতের জন্য খুবই ভয়াবহ। তাদের এই পরিবেশ-বিমুখ মনোভাবের কারণে তারা নিজেদের সমাজ থেকে দূরে রাখছে। তারা সমাজের সাথে মিশতে পারছে না। তাদের চিন্তাধারা খুবই এককেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। এমনকি তারা নিজের পরিবার, বাবা-মা, ভাই-বোন কিংবা বন্ধু মহলের থেকেও নিজেদের গুটিয়ে নেয়।
বর্তমানে কেউ মানসিকভাবে সমস্যায় পড়লে পরিবার কিংবা বন্ধু মহলে সমাধান চাওয়া থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চাইতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। অথচ সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যাদের কাছে সমাধান চাচ্ছে, তারা নিজেরাই এক একজন ডিপ্রেশনের ইঁদুর হয়ে উঠেছে। তারা প্রত্যেকেই এই রোগের এক একটি ভিন্ন উৎস।
এই অসুস্থতা থেকে বেরিয়ে আসা এতো সহজ নয়। তবে কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। এবার আসা যাক এর কিছু সমাধানে। এটি এমন একটি সমস্যা যা খুব দ্রুত সেরে যাবে না। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তবে মানুসিক চিকিৎসা (Psychological Treatments) ও আত্ম যত্নের (Self-Care) মাধ্যমে এর থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।
মানুসিক চিকিৎসা (Psychological Treatments):
কগনিটিভ বিহেভিয়োরাল থেরাপি (CBT): এটি চিন্তা এবং আচরণের প্যাটার্ন পরিবর্তন করার জন্য সহায়ক।
আচরণগত সক্রিয়করণ: এর মাধ্যমে পজিটিভ ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করা হয়।
আন্তঃব্যক্তিক সাইকোথেরাপি: সম্পর্কের সমস্যা এবং জীবন পরিবর্তনের সময় বিষণ্নতা মোকাবিলা করতে সহায়তা করে।
সমস্যা সমাধানের থেরাপি: সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে বের করার জন্য সহায়ক।
এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ:
এই ওষুধগুলো বিষণ্নতার উপসর্গগুলো কমাতে সাহায্য করে।
SSRIs (Selective Serotonin Reuptake Inhibitors), যেমন ফ্লুওক্সেটিন অন্যতম।
তবে ওষুধ ব্যবহারের পূর্বে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
স্ব-যত্ন:
নিয়মিত ব্যায়াম: দৈনন্দিন ব্যায়াম বিষণ্নতার লক্ষণ কমাতে সহায়ক।
শরীরের রুটিন বজায় রাখা: খাওয়া এবং ঘুমের অভ্যাস ঠিক রাখা।
বন্ধু ও পরিবারের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা: একা না থেকে কাছের মানুষের সঙ্গে কথা বলা।
এলকোহল ও মাদক এড়ানো: এসব বিষণ্নতার অবস্থা আরো খারাপ করে তুলতে পারে।
কিছু গবেষণায় দেখা যায় যে ধর্ম-ভিত্তিক হস্তক্ষেপগুলি হতাশা সহ মানসিক অসুস্থতা থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করতে পারে। ইসলাম অনুশীলন করার কিছু উপায় যা বিষণ্নতায় সাহায্য করতে পারে তার মধ্যে রয়েছে:
প্রার্থনা করুন
পবিত্র কুরআন শুনুন
উচ্চস্বরে কুরআন পাঠ করা
আধ্যাত্মিক শিক্ষা ধ্যান
সূরা আল-রহমান
(অরণ্য 🌺) #অনিকেত-কান্তা
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন