রোমান হোসাইন

আলোচনা - শিরোনাম: বর্তমানে মুসলিমরা পারমাণবিক শক্তিতে এত দুর্বল কেন?

লেখক: রোমান হোসাইন
প্রকাশ - সোমবার, ১৯ মে ২০২৫

শিরোনাম: বর্তমানে মুসলিমরা পারমাণবিক শক্তিতে এত দুর্বল কেন?
রোমান হোসাইন

ভূমিকা:

বিশ্ব রাজনীতিতে ও শক্তির ভারসাম্যে পারমাণবিক শক্তি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি শুধু যুদ্ধাস্ত্রের শক্তি নয়, বরং এটি একটি দেশের বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত এবং কৌশলগত ক্ষমতার প্রতীক। অথচ পৃথিবীর প্রায় ৫০টিরও বেশি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যে মাত্র একটি দেশ—পাকিস্তান—পারমাণবিক অস্ত্রধারী। প্রশ্ন ওঠে, এত বিশাল জনসংখ্যা, বিশাল ভূখণ্ড, প্রাকৃতিক সম্পদ ও ধর্মীয় ঐক্য থাকা সত্ত্বেও কেন মুসলিম বিশ্ব পারমাণবিক ক্ষেত্রে এতটা পিছিয়ে?

এই দীর্ঘ আলোচনা মুসলিম বিশ্বের পারমাণবিক দুর্বলতার ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক, ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করবে। আলোচনাটি ১০টি বিস্তৃত অধ্যায়ে বিভক্ত, যেখানে প্রতিটি অধ্যায়ে একটি নির্দিষ্ট দিক বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে প্রাসঙ্গিক তথ্য, তুলনামূলক বিশ্লেষণ, ঐতিহাসিক দলিল এবং বাস্তব কেস স্টাডিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অধ্যায় ১: ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার ও বিভক্তির রাজনীতি

১.১: ভূমিকা

ঔপনিবেশিক শাসন ছিল মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে একটি ভয়াবহ ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তারকারী অধ্যায়। ইউরোপীয় শক্তিগুলোর—বিশেষ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও পরবর্তীতে রাশিয়া ও আমেরিকার—প্রতিনিধিত্বশীল শাসন মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে। তারা শুধু মুসলিম ভূখণ্ড দখল করেনি, বরং মুসলিমদের আত্মপরিচয়, জ্ঞানচর্চা ও ঐক্যবোধকেও ভেঙে দিয়েছে।

১.২: ভূ-রাজনৈতিক কৌশল ও মুসলিম ভূমির বিভাজন

উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো মুসলিম বিশ্বের বিশাল ভূখণ্ডকে কৌশলগতভাবে বিভক্ত করেছে। ১৯১৬ সালের সাইক্স-পিকো চুক্তি ছিল এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ, যার মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন ও ফ্রান্স গোপনে অটোমান সাম্রাজ্যের মুসলিম অঞ্চলগুলো ভাগ করে নেয়।

সিরিয়া ও লেবানন যায় ফ্রান্সের দখলে,\\n- ইরাক ও প্যালেস্টাইন পড়ে ব্রিটেনের হাতে।\\n\\nএই বিভাজন শুধু ভূগোলের ছিল না; এটি ছিল চিন্তাধারা, ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থারও বিভাজন। ফলে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একে অন্যের প্রতি আস্থা ও সহযোগিতার জায়গায় সৃষ্টি হয় শঙ্কা ও অবিশ্বাস।

১.৩: উপনিবেশের জ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতির প্রভাব

ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো মুসলিম বিশ্বে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্তারকে সচেতনভাবে নিরুৎসাহিত করেছে। তারা শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে রূপান্তর করে, যাতে মুসলিম তরুণেরা কেবল প্রশাসনিক ও নিম্নস্তরের চাকরির উপযোগী হয়—কিন্তু গবেষণা ও উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিতে না পারে।

ভারতের মুসলিমদের জন্য ব্রিটিশ শাসনে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা অনেকাংশেই বন্ধ করে দেওয়া হয়,\\n- মিশরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় ইউরোপ নির্ভরতা গড়ে ওঠে,\\n- আফ্রিকার মুসলিম অঞ্চলগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় অনেক পরে, তাও ইউরোপীয় ভাষায় পাঠ্যক্রম নির্ভর করে।

১.৪: জাতিসংঘ ও মুসলিমদের প্রান্তিক অবস্থান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘে মুসলিম দেশগুলোর কোনো সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা ছিল না। বরং নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে যেসব দেশ জায়গা করে নেয়—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন—তারা কেউই মুসলিম বিশ্বকে ন্যায্য প্রযুক্তিগত শক্তি অর্জনে সহায়তা করেনি।

মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অধিকাংশই জাতিসংঘে নামমাত্র সদস্য—প্রভাবহীন ও সমন্বয়হীন।\\n- পারমাণবিক নীতি নির্ধারণ, অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ বা প্রযুক্তি বিনিময়ে তাদের কথার কোনো গুরুত্ব থাকে না।\\n\\nফলে মুসলিম বিশ্ব আন্তর্জাতিক পরমাণু নীতিনির্ধারক মহলে প্রান্তিক অবস্থানে থেকে যায়।

১.৫: উপনিবেশের পরবর্তী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুর্বলতা

ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো যখন মুসলিম দেশগুলো থেকে প্রত্যাহার করে, তখন তারা এমন রাজনৈতিক কাঠামো রেখে যায় যা ছিল দুর্বল, দুর্নীতিপূর্ণ ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের প্রতি সহানুভূতিশীল। এই কাঠামোতে প্রযুক্তি গবেষণার কোনো স্থায়ী নীতি বা বিনিয়োগের আগ্রহ থাকে না।

উদাহরণ: পাকিস্তানে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রযুক্তি উন্নয়নকে বাধা দেয়।\\n- ইরাকে ১৯৮০-৯০ এর দশকে যুদ্ধে জর্জরিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরমাণু গবেষণাকে সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলে।\\n\\nএই কারণে মুসলিম দেশগুলোর বিজ্ঞান ও প্রতিরক্ষা নীতি বারবার বাধার সম্মুখীন হয়েছে।

১.৬: ভিন্নমত, বিচ্ছিন্নতা ও পরস্পর দ্বন্দ্বের বীজবপন

ঔপনিবেশিক শক্তির অন্যতম বড়ো কৌশল ছিল “Divide and Rule”—ভাগ করে শাসন করা। তারা ধর্ম, ভাষা, জাতি ও গোত্রভিত্তিক বিভাজনকে উৎসাহিত করে এমন এক সমাজব্যবস্থা দাঁড় করায় যা মুসলিম উম্মাহর ঐক্যকে দুর্বল করে তোলে।

শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বকে কৌশলগতভাবে উসকে দেওয়া,\\n- আরব বনাম অ-আরবের সংকীর্ণ জাতিগত পরিচয়,\\n- দেশভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রসার ইত্যাদি এই বিভাজনের ফলাফল।\\n\\nএই পরিস্থিতিতে একে অপরের প্রতি আস্থা না থাকায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলো কোনও সম্মিলিত পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেনি।

১.৭: উপসংহার

ঔপনিবেশিক শাসন কেবল একটি সাময়িক দখল ছিল না; এটি ছিল বহু প্রজন্মব্যাপী একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক অধীনতা। এর ফলে মুসলিম বিশ্ব তার গবেষণা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত সম্ভাবনার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো এখনো উপনিবেশের সেই বিভাজনের রাজনীতি ও অকার্যকর কাঠামোর শিকার হয়ে আছে, যার ফলে পারমাণবিক শক্তির মতো কৌশলগত প্রযুক্তিতে তারা ঐক্যবদ্ধ বা স্বাধীন কোনো উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ।

অধ্যায় ২: মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিভাজন

২.১: ভূমিকা

যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব বহু ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিভেদের পরও সামরিক ও কৌশলগতভাবে একতাবদ্ধ (যেমন: ন্যাটো), সেখানে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ভাষা, বর্ণ, মতবাদ, নেতৃত্ব ও আঞ্চলিক স্বার্থের দ্বন্দ্বে এতটাই বিভক্ত যে তারা কখনোই একটি সমন্বিত শক্তির রূপ ধারণ করতে পারেনি। এ অধ্যায়ে বিশ্লেষণ করা হবে—এই বিভাজন কীভাবে মুসলিম বিশ্বের পারমাণবিক দুর্বলতাকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।

২.২: সৌদি আরব বনাম ইরান — মতবাদ ও আধিপত্যের সংঘাত

মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বড়ো বিভাজন তৈরি করেছে সৌদি আরব ও ইরানের দ্বন্দ্ব, যা মূলত শিয়া-সুন্নি মতবাদভিত্তিক হলেও রাজনৈতিক আধিপত্য ও আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণের কৌশলগত প্রতিযোগিতায় রূপ নিয়েছে।

ইরান একটি বিপ্লবী শিয়া ইসলামি মডেল অনুসরণ করে, যা আরব রাজতন্ত্রের জন্য হুমকি মনে করা হয়।\\n- সৌদি আরব, সুন্নি বিশ্বের ধর্মীয় কেন্দ্র হওয়ায় ইরানের ছায়া বিস্তারে শঙ্কিত।\\n\\nএই বৈরিতা দুই পক্ষের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা তৈরি করেছে, কিন্তু পারমাণবিক সহযোগিতাকে করেছে অসম্ভব। উপরন্তু, এই দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশকেও দুই শিবিরে ভাগ করে ফেলেছে।

২.৩: উপসাগরীয় ও উত্তর আফ্রিকার দ্বন্দ্ব

আবার অনেক সময় আরব বিশ্বের মধ্যেই পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস কাজ করে:

কাতার ও সৌদি আরব: ২০১৭ সালে কাতারকে অবরোধ করে সৌদি জোট।\\n- মিশর বনাম তুরস্ক: মুসলিম ব্রাদারহুড নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং ভিন্ন মতবাদীয় অবস্থান।\\n- মরক্কো ও আলজেরিয়া: সাহারার মালিকানা নিয়ে decades-long উত্তেজনা।\\n\\nএই অভ্যন্তরীণ সংঘাতগুলো মুসলিম বিশ্বে পারস্পরিক নিরাপত্তা চুক্তি, প্রযুক্তি স্থানান্তর, বা যৌথ গবেষণা প্রচেষ্টাকে প্রায় অসম্ভব করে তোলে।

২.৪: ওআইসি (OIC) এর নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা

মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘Organisation of Islamic Cooperation’ (OIC) — যেটি ৫৭টি মুসলিম দেশ নিয়ে গঠিত, কিন্তু বাস্তবতায় এটি কখনোই কার্যকরভাবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্য বা প্রযুক্তি সহযোগিতা গঠনে সক্ষম হয়নি।

এটি কোনো যৌথ সামরিক প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়তে পারেনি।\\n- বিজ্ঞান, গবেষণা ও পারমাণবিক শক্তি নিয়ে কোনো সম্মিলিত রোডম্যাপ প্রকাশ করেনি।\\n- সদস্য দেশগুলোর মধ্যে মতবিরোধ থাকায় একক মত গঠন দুরূহ হয়ে পড়ে।\\n\\nফলে ওআইসি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কেবল এক প্রতীকী জোটে পরিণত হয়েছে।

২.৫: প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিতে পারস্পরিক সন্দেহ

মুসলিম রাষ্ট্রগুলো একে অপরকে অবিশ্বাস করে বলেই অস্ত্র বা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে না।

পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর হলেও এটি কোনো আরব দেশের সঙ্গে সেই প্রযুক্তি ভাগ করেনি। কারণ, এটি নিজেকে আঞ্চলিক ক্ষমতা হিসেবেই দেখতে চায়।\\n- তুরস্ক তার ড্রোন প্রযুক্তি মজবুত করছে, কিন্তু তা মুসলিম জোট নয় বরং ন্যাটো’র ভিতরেই সীমিত।\\n- ইরান নিজের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে এতটাই কোণঠাসা যে সে কাউকেই সহযোগী হিসেবে টানতে পারছে না।\\n\\nফলে কোনো মুসলিম পারমাণবিক \’umbrella\’ বা নিরাপত্তা ঢাল সৃষ্টি হয়নি।

২.৬: ধর্মীয় মতবাদ ও রাজনৈতিক শত্রুতা

মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বহু রাষ্ট্র শিয়া-সুন্নি, সুফি-সেলাফি, বা রাজতন্ত্র-প্রজাতন্ত্র মতবাদে বিভক্ত। এই ধর্মীয় বিভাজন রাজনীতিকে প্রভাবিত করে এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতাও ব্যাহত করে।

উদাহরণস্বরূপ, ইরান ও ইরাকের মধ্যকার দীর্ঘ যুদ্ধ (১৯৮০–৮৮) কেবল রাজনৈতিক নয়, ধর্মীয় বিভাজনের ফলও ছিল।\\n- সৌদি আরব মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থিত দেশগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, ফলে সহযোগিতা ব্যাহত হয়।\\n\\nএমন অবস্থায় পারমাণবিক বা কৌশলগত প্রযুক্তি নিয়ে একে অপরের উপর বিশ্বাস গঠন হয় না।

২.৭: জাতীয় স্বার্থ বনাম উম্মাহর স্বার্থ

মুসলিম দেশগুলো প্রায়ই নিজেদের \’জাতীয় স্বার্থ\’কে \’উম্মাহর স্বার্থ\’ থেকে এগিয়ে রাখে। এই প্রবণতা তাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে দেয় না।

পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে পারমাণবিক শক্তি অর্জন করে, কিন্তু তা উম্মাহর নিরাপত্তার জন্য নয়—বরং জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য।\\n- সৌদি আরব কিংবা তুরস্ক, যারা সামরিক খাতে বিপুল ব্যয় করে, তারাও এই প্রযুক্তি নিজেদের হাতে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়।\\n\\nএই এককভাবে এগোনোর মনোভাব সম্মিলিত শক্তি অর্জনের পথে বড় বাধা।

২.৮: উপসংহার

মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, আঞ্চলিক এবং নেতৃত্বের বৈচিত্র্য একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে জন্ম দিয়েছে। এই বিভাজন একটি ঐক্যবদ্ধ পারমাণবিক কৌশল গঠনের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর উচিত নিজেদের ভেদাভেদ দূর করে অন্তত প্রতিরক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটি যৌথ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা—যেটি উম্মাহর নিরাপত্তা ও সম্মান রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে।

——

অধ্যায় ৩: বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও গবেষণায় মুসলিম বিশ্বের পশ্চাদপদতা

৩.১: ভূমিকা

একসময় মুসলিম সভ্যতাই ছিল জ্ঞান, বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনের কেন্দ্র। বাগদাদ, কায়রো, কুর্দুবা, দামেশক — এই নগরীগুলো ছিল জ্ঞানের বাতিঘর। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোর অধিকাংশই বৈজ্ঞানিক গবেষণা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৌশলগত উন্নয়নে বিশ্ব থেকে পিছিয়ে পড়েছে। এই পশ্চাদপদতা পরমাণু প্রযুক্তির মতো জটিল ও কৌশলগত ক্ষেত্রে প্রবেশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৩.২: ইসলামী স্বর্ণযুগে বিজ্ঞানচর্চা

৮ম থেকে ১৪শ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কে বলা হয় মুসলিম বিশ্বের ‘স্বর্ণযুগ’। তখনকার মুসলিম পণ্ডিতরা গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা ও দর্শনের ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখেছিলেন।

আল-খাওয়ারিজমি: অ্যালজেব্রার জনক\\n- ইবন সিনা: চিকিৎসাশাস্ত্রের ভিত্তি রচনা\\n- ইবন হাইথম: অপটিক্সে বিপ্লব ঘটান\\n- জাবির ইবনে হাইয়ান: আধুনিক রসায়নের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন\\n\\nএই ঐতিহ্য একসময় ইউরোপীয় রেনেসাঁকে উৎসাহিত করলেও পরবর্তীতে মুসলিমরা নিজস্ব উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

৩.৩: ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব

ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপীয় শক্তিগুলো মুসলিম দেশগুলোতে এমন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে যা ছিল প্রযুক্তি-বিমুখ, সৃজনশীলতাহীন এবং আত্মমর্যাদাহীনতার ধারক।

বিজ্ঞানচর্চা হয়েছে সীমিত ও প্রশাসনিক সুবিধা অর্জনের মাধ্যম।\\n- গবেষণার চেয়ে মুখস্থভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠা পায়।\\n- মাদ্রাসা ও আধুনিক শিক্ষার মাঝে একটি গভীর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।\\n\\nফলে মুসলিম যুবসমাজ বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনের পথে আগাতে পারেনি।

৩.৪: বর্তমান বৈজ্ঞানিক গবেষণায় মুসলিম বিশ্বের অবদান

বর্তমানে সারা বিশ্বের গবেষণা ও উদ্ভাবনে মুসলিম দেশগুলোর অবদান খুবই সীমিত। নিচে কিছু তথ্য:

বিশ্বের মোট বৈজ্ঞানিক গবেষণার ২% এরও কম আসে মুসলিম দেশগুলো থেকে।\\n- নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মুসলিম বিজ্ঞানীর সংখ্যা ৫-এরও কম।\\n- অধিকাংশ মুসলিম দেশের গবেষণা ব্যয় GDP’র ১% এর নিচে।\\n\\nএর বিপরীতে, ইসরায়েলের মতো একটি ছোট দেশেও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে লক্ষ লক্ষ ডলার বিনিয়োগ হয় এবং তারা বিশ্বে AI, ড্রোন, সাইবার নিরাপত্তা ও পরমাণু প্রযুক্তিতে অগ্রগামী।

৩.৫: গবেষণা অবকাঠামোর দুর্বলতা

মুসলিম দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা কেন্দ্র এবং গবেষণা প্রকল্পগুলোতে নিম্ন মান ও স্বল্প বাজেট বড় সমস্যা।

গবেষণার বাজেট অপ্রতুল: অধিকাংশ মুসলিম দেশের বাজেটের সিংহভাগ যায় সামরিক খাতে অথবা প্রশাসনিক ব্যয়ে।\\n- বিশ্বমানের গবেষক ও গবেষণাগার নেই: বিজ্ঞানীরা দেশের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হন (brain drain)।\\n- বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাংকিং খারাপ: ১০০ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মুসলিম দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।\\n\\nফলে দীর্ঘমেয়াদে পরমাণু বা রকেট প্রযুক্তির মতো উন্নত ক্ষেত্রগুলোতে তারা প্রতিযোগিতার বাইরে পড়ে যায়।

৩.৬: ধর্মের অপব্যাখ্যা ও বিজ্ঞানভীতি

কিছু মুসলিম সমাজে এখনো বিজ্ঞানকে “পশ্চিমা” বা “ধর্মবিরোধী” মনে করার প্রবণতা আছে। এই ভুল ধারণা মুসলিম তরুণদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেয়।

প্রযুক্তি ও গবেষণাকে ‘ইসলামবিরোধী’ ভাবা হয় অনেক স্থানে।\\n- বাস্তবমুখী গবেষণার চেয়ে আধ্যাত্মিকতা বা আড়ম্বরিকতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।\\n\\nঅথচ ইসলামে কুরআন বারবার “চিন্তা করো”, “অনুসন্ধান করো”, “তাদের দিকে তাকাও যারা জ্ঞান অর্জন করে” — এইভাবে বিজ্ঞানচর্চাকে উৎসাহিত করেছে।

৩.৭: মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে গবেষণা-সহযোগিতার অভাব

মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে গবেষণাভিত্তিক সহযোগিতা প্রায় অনুপস্থিত।

কোনো যৌথ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেই যা মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে পরমাণু, স্পেস বা AI-এর মতো ক্ষেত্রে কাজ করছে।\\n- প্রযুক্তি স্থানান্তর বা বৈজ্ঞানিক বিনিময়ের প্রকল্প প্রায় নেই বললেই চলে।\\n\\nএর ফলে মুসলিম গবেষকরা এককভাবে কম কাজ করেন এবং সম্মিলিত শক্তি গড়ে ওঠে না।

৩.৮: উপসংহার

মুসলিম বিশ্বের বৈজ্ঞানিক পশ্চাদপদতা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়—এটি ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক নানা বাধার সমষ্টি। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো যদি সত্যিই আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তির ভারসাম্যে নিজেদের সম্মানজনক অবস্থানে নিতে চায়, তবে প্রথম পদক্ষেপ হবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও গবেষণাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। মসজিদ-মাদ্রাসার পাশে বিজ্ঞানাগার, প্রযুক্তি পার্ক, ও গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে না তুললে একবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম উম্মাহ কেবল দর্শক হিসেবেই থাকবে।

——

অধ্যায় ৪: মুসলিম বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা

৪.১: ভূমিকা

একটি জাতির উন্নতির ভিত্তি গড়ে ওঠে তার শিক্ষাব্যবস্থার উপর। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই শিক্ষা এখনো একটি অবহেলিত খাত। এখানে জ্ঞানার্জনের চেয়ে ডিগ্রি অর্জনই মুখ্য, গবেষণার চেয়ে মুখস্থ, আর স্বাধীন চিন্তার চেয়ে বশ্যতা বেশি প্রাধান্য পায়। এই দুর্বলতা কেবল সাধারণ উন্নয়নেই বাধা নয়—বরং পরমাণু শক্তির মতো জটিল প্রযুক্তি অর্জনের পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৪.২: শিক্ষা ব্যয়ে পশ্চাদপদতা

বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের GDP-এর ৪–৭% শিক্ষা খাতে ব্যয় করে। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিম দেশে এ হার ২%–এর নিচে।

নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, মিসর, ইয়েমেন ইত্যাদি দেশে শিক্ষার বাজেট সীমিত ও অপ্রতুল।

কিছু দেশে সেনাবাহিনীর বাজেট শিক্ষার চেয়ে বহুগুণ বেশি।

ফলে স্কুল-কলেজে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, পাঠ্যবই মানহীন, আর গবেষণার তেমন অবকাঠামো গড়ে ওঠে না।

৪.৩: পাঠ্যবই ও পাঠ্যক্রমে সীমাবদ্ধতা

মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে শিক্ষাব্যবস্থা এখনো কলোনিয়াল যুগের কাঠামোর মধ্যে আটকে আছে।

পাঠ্যবইগুলোর অধিকাংশেই সৃজনশীলতা বা বাস্তবমুখী চিন্তার অভাব।

আধুনিক প্রযুক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যা বা মডার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জায়গা নেই বা খুবই সীমিত।

এছাড়া অনেক দেশেই ইতিহাস বিকৃতভাবে শেখানো হয়, যা একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করতে ব্যর্থ।

৪.৪: মাদ্রাসা ও আধুনিক শিক্ষার দ্বন্দ্ব

বেশ কিছু মুসলিম দেশে শিক্ষাব্যবস্থা দ্বৈত রূপে বিভক্ত—একদিকে মাদ্রাসা, অন্যদিকে আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

মাদ্রাসাগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষা গুরুত্ব পায়, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বা গবেষণাভিত্তিক জ্ঞান প্রায় অনুপস্থিত।

আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আবার ধর্মীয় মূল্যবোধের জায়গা অনেক সময় থাকে না।

দুই ধারার মধ্যে যোগাযোগ বা সমন্বয়ের অভাব থাকায়, সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে।

ফলে একটি ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তাশীল প্রজন্ম গড়ে ওঠে না, যারা একইসাথে নৈতিকতাসম্পন্ন এবং প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ হতে পারে।

৪.৫: শিক্ষক ও প্রশিক্ষণব্যবস্থার দুর্বলতা

শিক্ষকেরা হলেন জাতি গঠনের কারিগর। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের বহু দেশে শিক্ষক পেশা অবহেলিত ও দুর্বলভাবে ব্যবস্থাপিত।

অনেক দেশে শিক্ষক নিয়োগ হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়, যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়।

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব ব্যাপক।

শিক্ষকরা অনেক সময় দুর্বল বেতনে কাজ করতে বাধ্য হন, ফলে তারা অন্য পেশায় চলে যান বা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।

ফলে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোতেও ঠিকমতো দক্ষতা অর্জন করতে পারে না।

৪.৬: গবেষণা, উদ্ভাবন ও উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব

বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা ইনস্টিটিউট বা প্রযুক্তি কেন্দ্র মুসলিম বিশ্বে খুবই সীমিত।

শীর্ষ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় মাত্র কয়েকটি মুসলিম দেশের বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তাও নিন্ম পর্যায়ে।

অধিকাংশ দেশে গবেষণা করতে গেলে বাধা আসে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিকভাবে।

পরমাণু প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা, AI বা সেনা-প্রযুক্তিতে অগ্রসর হতে হলে এই ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে হবে।

৪.৭: শিক্ষার রাজনীতিকরণ ও দলীয়করণ

বিভিন্ন মুসলিম দেশে শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। ফলে পাঠ্যবইয়ে বিকৃতি আসে, যোগ্যতাবিহীন শিক্ষক নিয়োগ হয়, এবং শিক্ষার মান নেমে যায়।

কেউ কেউ ইতিহাস বিকৃত করে \’নিজেদের গৌরব\’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।

আবার কিছু দেশে ‘পশ্চিমা সংস্কৃতির ভয়’ দেখিয়ে আধুনিক শিক্ষা ব্যাহত করা হয়।

এই দ্বৈত চাপে শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হয় এবং ভবিষ্যতে কোনো বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত প্রয়োগে নেতৃত্ব দিতে পারে না।

৪.৮: নারীদের শিক্ষা সীমাবদ্ধ

বেশ কিছু মুসলিম দেশে নারীদের শিক্ষায় সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় বাধা এখনো প্রবল। অথচ নারীশিক্ষা পিছিয়ে থাকলে জাতির অর্ধেক অংশ অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়ে।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত, রোবোটিক্স, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে নারীদের অংশগ্রহণ খুবই কম।

অনেক সময় পরিবার থেকেই নিরুৎসাহিত করা হয়, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মে প্রযুক্তিতে অংশগ্রহণ কমিয়ে দেয়।

৪.৯: উপসংহার

শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, তাহলে মুসলিম বিশ্বের মেরুদণ্ড দুর্বল। এই দুর্বল শিক্ষা কাঠামো প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার অন্যতম মূল কারণ। বিশেষ করে পরমাণু প্রযুক্তি, যা উচ্চপর্যায়ের পদার্থবিদ্যা, ইঞ্জিনিয়ারিং, নিরাপত্তা ও বিশ্লেষণক্ষমতা দাবি করে, তার জন্য একটি শক্তিশালী, বিজ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী শিক্ষা ব্যবস্থা অপরিহার্য। যদি উম্মাহকে প্রযুক্তিগতভাবে আত্মনির্ভর করতে হয়, তবে শিক্ষা সংস্কার, গবেষণা উন্নয়ন এবং চিন্তাশীল প্রজন্ম গড়ে তোলা এখনই শুরু করতে হবে।

——

অধ্যায় ৫: মুসলিম দেশগুলোর অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও পরমাণু প্রযুক্তির খরচ

৫.১: ভূমিকা

পরমাণু শক্তি অর্জন শুধু প্রযুক্তি বা জ্ঞাননির্ভর নয়—এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, দীর্ঘমেয়াদী এবং বহুস্তর বিশিষ্ট অর্থনৈতিক বিনিয়োগ দাবি করে। একটি দেশকে পরমাণু শক্তিধর করতে হলে গবেষণা, পরিকাঠামো, বিজ্ঞানী, নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক প্রস্তুতিতে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশ অর্থনৈতিকভাবে এতটা স্থিতিশীল নয় যে তারা এমন প্রকল্প টানতে পারে।

৫.২: মুসলিম বিশ্বের অর্থনৈতিক বাস্তবতা

মুসলিম দেশগুলোর একটি বড় অংশ এখনো উন্নয়নশীল বা অনুন্নত অবস্থায় রয়েছে।

অনেক দেশই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর কাছে ঋণগ্রস্ত।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক কম এবং বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি প্রবল।

সেক্টরভিত্তিক বৈচিত্র্য না থাকায় আয় নির্ভর হয় কেবল তেল বা প্রবাসী আয়ে।

উদাহরণস্বরূপ:

দেশ জিডিপি (প্রতি ব্যক্তি) বৈদেশিক ঋণ গবেষণায় ব্যয় (GDP %)

বাংলাদেশ $২,৮০০ উচ্চ ০.৪% এর নিচে
পাকিস্তান $১,৬০০ উচ্চ ০.৩% এর নিচে
ইয়েমেন $৯০০ খুব উচ্চ ন্যূনতম
ইরান $৪,০০০ মাঝারি ০.৭%

অন্যদিকে পরমাণু শক্তিধর দেশগুলো যেমন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স—এসব দেশের জিডিপি, বৈজ্ঞানিক বাজেট ও গবেষণা অবকাঠামো অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী।

৫.৩: পরমাণু প্রযুক্তির খরচের ধারণা

একটি কার্যকর পরমাণু শক্তি বা অস্ত্র কর্মসূচি শুরু করতে গেলে বিভিন্ন পর্যায়ে বিপুল ব্যয় প্রয়োজন হয়।

ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও গবেষণা চুল্লি তৈরি – কয়েক শত মিলিয়ন ডলার

পারমাণবিক বোমার গবেষণা ও নকশা – কয়েক বিলিয়ন ডলার

নিরীক্ষণ, সুরক্ষা, পরিদর্শন ও জ্বালানি ব্যবস্থাপনা – স্থায়ী খরচ

ব্যালিস্টিক মিসাইল ডেলিভারি সিস্টেম – বিলিয়ন ডলার পর্যায়ে

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলার কূটনৈতিক প্রস্তুতি – আলাদা বাজেট

উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তান তার পরমাণু বোমা কর্মসূচির জন্য আনুমানিক $৫–৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে ১৯৭৬–১৯৯৮ এর মধ্যে। এই বিপুল খরচ তখন দেশটির অর্থনীতির উপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করেছিল।

৫.৪: দরিদ্রতা ও মানবিক চাহিদার চাপ

মুসলিম দেশের অনেক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এসব দেশে সরকারকে খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান ও প্রাথমিক শিক্ষার জন্যই যথেষ্ট ব্যয় করতে হয়।

উদাহরণ: বাংলাদেশে ২০ কোটির বেশি জনগণের একটি বড় অংশ এখনো স্বাস্থ্যসেবা ও সুশৃঙ্খল বাসস্থানের বাইরে।

ইয়েমেন ও সিরিয়ার মতো দেশগুলো যুদ্ধবিধ্বস্ত, যেখানে পরমাণু প্রযুক্তি অর্জন তো দূরের কথা, নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতেই ব্যর্থ হচ্ছে।

আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোতে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, জলবায়ু দুর্যোগ, দুর্নীতির প্রভাব এত প্রবল যে জাতীয় প্রযুক্তি উন্নয়নের স্বপ্ন বিলাসিতা মনে হয়।

এই প্রেক্ষাপটে পরমাণু শক্তির মতো বিলিয়ন ডলারের প্রযুক্তি প্রোজেক্টে বিনিয়োগ রাজনৈতিকভাবে অজনপ্রিয় ও আর্থিকভাবে দুর্বোধ্য।

৫.৫: সামরিক বাজেট বনাম উন্নয়ন বাজেট

মুসলিম বিশ্বের বেশ কিছু দেশে সামরিক বাজেট বিশাল হলেও তা পরমাণু প্রযুক্তি নয়, বরং অস্ত্র ক্রয় ও সীমান্ত নিরাপত্তা কেন্দ্রিক।

সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত – বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনে, নিজস্ব প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করে না।

মিশর, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া – সামরিক খাতে বাজেট দেয় কিন্তু গবেষণায় না।

তুরস্ক ব্যতিক্রম, তারা কিছু গবেষণাভিত্তিক সামরিক উন্নয়নে মনোযোগ দিচ্ছে, তবে তা এখনো সীমিত।

এই ভুল বিনিয়োগ পরিকল্পনার কারণে পরমাণু প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক অবকাঠামো গড়ে ওঠে না।

৫.৬: দুর্নীতি ও বাজেট অপচয়

অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার সঙ্গে যুক্ত হয় প্রশাসনিক দুর্নীতি ও অপচয়।

বহু দেশে গবেষণার জন্য বরাদ্দ অর্থ ব্যয় হয় ভ্রমণ, সেমিনার বা ব্যক্তিগত স্বার্থে।

প্রকল্পের নামে অনুৎপাদনশীল কর্মসূচি চালানো হয় যাতে জনসেবার চেয়ে দলীয় ও ব্যক্তিক স্বার্থ প্রাধান্য পায়।

ফলে অর্থনৈতিক চাপ দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায়, আর উচ্চ প্রযুক্তির দিকে যাত্রা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

৫.৭: ইসলামের অর্থনীতি ও সম্ভাব্য সমাধান

যদি ইসলামি অর্থনীতির নীতিগুলো অনুসরণ করে সম্পদ বণ্টন ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিশ্চিত করা যেত, তাহলে বহু মুসলিম দেশই অর্থনৈতিকভাবে অনেক উন্নত হতে পারত।

যাকাত, ওয়াকফ, বায়তুল মাল – সঠিকভাবে পরিচালনা করলে সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হতো।

অলস অর্থ বিদেশে জমা না রেখে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ করা যেত।

ধনীদের ওপর নৈতিক চাপ সৃষ্টি করে গবেষণায় দান করার সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব।

এইভাবে দীর্ঘমেয়াদে পরমাণু প্রযুক্তির মতো উচ্চ ব্যয়ের উদ্যোগেও মুসলিম বিশ্বের অংশগ্রহণ সম্ভব হতে পারে।

৫.৮: উপসংহার

অর্থনৈতিক দুর্বলতা পরমাণু প্রযুক্তির পথে মুসলিম বিশ্বের একটি বড় বাধা। যদিও কিছু দেশ যেমন পাকিস্তান—সাহসিকতা ও জাতীয় সংকল্পের মাধ্যমে এই পথ অতিক্রম করেছে, তবে অধিকাংশ দেশ এখনো অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অভ্যন্তরীণ চাহিদার চাপে উচ্চ প্রযুক্তির উদ্যোগ নিতে সাহস করে না। যদি মুসলিম দেশগুলো অর্থনৈতিক সংস্কার, দুর্নীতি হ্রাস, প্রযুক্তিমুখী বাজেট পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তবে ধীরে ধীরে তারা এই ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারে। একে অপরকে সহযোগিতার মনোভাবেও কাজ করতে হবে।

——

অধ্যায় ৬: মুসলিম দেশগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সহযোগিতার অভাব

৬.১: ভূমিকা

“উম্মাহ” শব্দটি ইসলামে একটি মহৎ আদর্শ—যেখানে সব মুসলমান একটি দেহের অঙ্গের মতো পরস্পরের পাশে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে মুসলিম বিশ্ব বহু জাতি, ভাষা, বর্ণ, রাজনীতি ও স্বার্থে বিভক্ত। এই বিভাজন এতটাই গভীর যে মুসলিম দেশগুলো পরমাণু প্রযুক্তির মতো জটিল ও স্পর্শকাতর ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।

৬.২: মুসলিম বিশ্বের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিভাজন

মুসলিম দেশগুলো তিনটি মহাদেশে বিস্তৃত—এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে। এই বিস্তৃতির মধ্যে রয়েছে:

বিভিন্ন ভাষা: আরবি, ফার্সি, উর্দু, তুর্কি, বাংলা, মালয়, হাউসা ইত্যাদি।

বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থা: রাজতন্ত্র (সৌদি আরব), সামরিক শাসন (মিশর), গণতন্ত্র (ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ), আধা-স্বৈরতন্ত্র (ইরান)।

বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাঠামো: তেলভিত্তিক, কৃষিনির্ভর, শিল্পনির্ভর।

এই ভিন্নতা স্বাভাবিকভাবে চ্যালেঞ্জ হলেও, তা অতিক্রম করা যেত যদি ঐক্যের চেষ্টা থাকত। দুর্ভাগ্যবশত, বাস্তবে তা হয়নি।

৬.৩: ঐতিহাসিক আস্থা সংকট ও আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব

মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একাধিক ঐতিহাসিক শত্রুতা ও অবিশ্বাস রয়েছে, যেমন:

সৌদি আরব বনাম ইরান – সুন্নি-শিয়া বিভাজনের কেন্দ্রবিন্দু।

তুরস্ক বনাম আরব জগৎ – উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর আরবদের বিদ্বেষ।

পাকিস্তান বনাম আফগানিস্তান – সীমান্ত ও জাতিগত দ্বন্দ্ব (দুরান্ড লাইন)।

মিশর বনাম কাতার/তুরস্ক – মুসলিম ব্রাদারহুডকে কেন্দ্র করে।

এইসব দ্বন্দ্ব শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায়ও রূপ নেয়, ফলে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পারমাণবিক বা সামরিক প্রযুক্তি নিয়ে কোনো রকম যৌথ উদ্যোগ দেখা যায় না।

৬.৪: মুসলিম ব্লকের অনুপস্থিতি

যেখানে ইউরোপে NATO, এশিয়ায় ASEAN, আফ্রিকায় AU—তাদের নিজেদের প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক ব্লক আছে; সেখানে মুসলিম বিশ্বের ৫০+ দেশের মধ্যে কোনো কার্যকর মুসলিম প্রতিরক্ষা জোট নেই।

১৯৬৯ সালে গঠিত OIC (Organisation of Islamic Cooperation) মূলত কূটনৈতিক বৈঠকের সংগঠন, বাস্তব সামরিক বা প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এর নেই।

কিছু সামরিক জোট যেমন ISMC বা ইসলামিক মিলিটারি কাউন্টার টেরোরিজম অ্যালায়েন্স (সৌদি নেতৃত্বাধীন)—তা নিরপেক্ষ নয় এবং তাতে ইরান, সিরিয়া, কাতার অনুপস্থিত।

ফলে মুসলিম দেশগুলো একসাথে প্রযুক্তিগত জোট গঠন বা গবেষণা ভিত্তিক একাডেমিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে।

৬.৫: পারমাণবিক প্রযুক্তিতে সহযোগিতার অযোগ্যতা ও অনীহা

যদি মুসলিম দেশগুলো একে অপরের ওপর আস্থা রাখত, তাহলে তারা যৌথভাবে পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করতে পারত। কিন্তু বাস্তবতা হলো—

পাকিস্তানের পারমাণবিক প্রযুক্তি আজও কোনো মুসলিম দেশকে দেওয়া হয়নি (ব্যতিক্রম সন্দেহাতীত সহযোগিতার অভিযোগ যেমন উত্তর কোরিয়া)।

ইরান পারমাণবিক গবেষণায় এগোলেও তাকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় ফেলতে মুসলিম দেশগুলো একজোট হয়নি।

মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ ইত্যাদি দেশ গবেষণার চেষ্টা করলেও তেমন মুসলিম-টু-মুসলিম সহযোগিতা পায়নি।

এমনকি পাকিস্তান, যেটি বিশ্বের একমাত্র মুসলিম পরমাণু শক্তিধর দেশ, সে-ও তার জ্ঞান বা প্রযুক্তি মুসলিম ভ্রাতৃত্বের নামে শেয়ার করেনি।

৬.৬: জাতীয়তাবাদ ও সংকীর্ণ স্বার্থপরতা

বিশ শতকের শুরুতে মুসলিম দুনিয়ার মধ্যে যে সামান্য ঐক্যবোধ ছিল, সেটিও আজ হারিয়ে গেছে।

জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ ও ভাষাভিত্তিক অহংকার মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে।

আরব-নন-আরব, শিয়া-সুন্নি, তুর্কি-ফার্সি-দক্ষিণ এশিয়ান — এই বিভক্তির কারণে মুসলমানরা নিজেরাই একে অপরকে অবিশ্বাস করে।

কিছু দেশে (যেমন, আরব রাজতন্ত্রে) তারা নিজেরা আধিপত্য চায়, অন্য মুসলিম রাষ্ট্র শক্তিশালী হোক তা চায় না।

এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পারমাণবিক ক্ষমতার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আন্তর্পারস্পরিক সহযোগিতার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

৬.৭: পশ্চিমা বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাব

পশ্চিমা শক্তিগুলো বরাবরই মুসলিম বিশ্বে \”Divide and Rule\” নীতি প্রয়োগ করে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন চায় না মুসলিম বিশ্ব একত্রিত হোক।

তারা কূটনীতির মাধ্যমে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে, যেমন সৌদি-ইরান শত্রুতা বাড়ানো, কুর্দি-বিষয়কে কেন্দ্র করে তুরস্ক-বিভাজন ইত্যাদি।

অনেক সময় তারা পারমাণবিক গবেষণার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালায় এবং কিছু মুসলিম সরকার সেই চাপে পড়ে নিজ দেশের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তি কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়।

৬.৮: সমাধানের পথ ও করণীয়

১. OIC-কে পুনর্গঠন করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জোট গঠন: যেমন ‘Islamic Nuclear Research & Development Council’।

2. যৌথ বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা: মুসলিম দেশগুলোর সেরা বিজ্ঞানীদের একত্র করে পরমাণু পদার্থবিদ্যা, নিউক্লিয়ার মেডিসিন, শক্তি ও প্রযুক্তি গবেষণা চালানো।

3. পারস্পরিক কূটনৈতিক আস্থা ও সমঝোতা তৈরি: দ্বন্দ্ব নিরসনে সংলাপ ও মধ্যস্থতা বাড়ানো।

4. জ্ঞান ও প্রযুক্তি শেয়ারের ইসলামী দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা: এটি শুধু ভ্রাতৃত্ব নয়, বরং উম্মাহ রক্ষার কৌশলও।

5. আঞ্চলিক গবেষণাকেন্দ্র গঠন: যেমন আরব অঞ্চলে একটি, দক্ষিণ এশিয়ায় একটি, আফ্রিকায় একটি।

৬.৯: উপসংহার

ঐক্যহীনতা মুসলিম বিশ্বের এক স্থায়ী ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। যদি এই অবিশ্বাস, বিভাজন ও আত্মঘাতী প্রতিযোগিতা চলতে থাকে, তবে মুসলমানরা কেবল পরমাণু প্রযুক্তি নয়—সামগ্রিকভাবেই আধুনিক সভ্যতার নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়বে। ‘উম্মাহ’ শব্দটি যদি বাস্তবে অর্থবহ করতে হয়, তাহলে পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা ও গবেষণায় একত্র হওয়া এখন সময়ের দাবি।

——

অধ্যায় ৭: বিজ্ঞান ও গবেষণায় পিছিয়ে পড়া মুসলিম বিশ্ব

৭.১: ভূমিকা

ইসলামের সূচনালগ্নেই জ্ঞান অর্জনের প্রতি ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। পবিত্র কুরআনে বারবার চিন্তা-ভাবনা, পর্যবেক্ষণ, গবেষণা ও শিক্ষা অর্জনের কথা বলা হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন: “জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ।” অথচ, আজকের মুসলিম বিশ্ব সেই গৌরবময় ঐতিহ্য হারিয়ে এক হতাশাজনক স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। প্রযুক্তি, চিকিৎসা, মহাকাশ কিংবা পারমাণবিক গবেষণা—প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুসলিম বিশ্ব বিশ্বব্যাপী পিছিয়ে।

৭.২: ইসলামের স্বর্ণযুগে মুসলমানদের বিজ্ঞান নেতৃত্ব

৮ম থেকে ১৩শ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম সভ্যতা ছিল বিজ্ঞান ও জ্ঞানের কেন্দ্রস্থল। তখনকার মুসলিম বিজ্ঞানীদের কিছু কীর্তি:

ইবনে সিনা (Avicenna) – চিকিৎসা ও দর্শনে অগ্রগণ্য।

আল-খাওয়ারিজমি – অ্যালজেব্রার জনক, \”Algorithm\” শব্দটির উৎপত্তি তাঁর নাম থেকে।

আল-হায়থাম – আধুনিক পদার্থবিদ্যার ভিত্তি স্থাপনকারী (বিশেষত অপটিক্সে)।

আল-বিরুনী – জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূগোলবিদ।

জাবির ইবনে হাইয়ান – রাসায়নিক বিজ্ঞানের পথিকৃৎ।

এইসব মনীষীদের গবেষণা ইউরোপীয় রেনেসাঁর ভিত্তি গড়ে দেয়। কিন্তু তারপর শুরু হয় মুসলিম বিশ্বের পতন।

৭.৩: পতনের কারণসমূহ

(ক) উপনিবেশবাদ ও জ্ঞানচর্চার ধ্বংস

১৭-২০ শতকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো মুসলিম বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করে:

মাদ্রাসা, পাঠাগার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে।

স্থানীয় ভাষায় জ্ঞানচর্চা নিষিদ্ধ করে দেয়।

পাশ্চাত্য পদ্ধতির অন্ধ অনুসরণ শুরু হয়।

(খ) ধর্ম ও বিজ্ঞানকে মুখোমুখি দাঁড় করানো

কিছু মুসলিম সমাজে বিজ্ঞানকে “ধর্মবিরোধী” মনে করা শুরু হয়, ফলে:

গবেষণাকে শত্রু ভাবা হয়।

নবীনরা মাদ্রাসায় শুধু তাফসির ও ফিকহ শিখে, বিজ্ঞানকে বাদ দেয়।

(গ) রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের অভাব

মধ্যপ্রাচ্যের বহু ধনী দেশ GDP-এর ১% এরও কম গবেষণায় ব্যয় করে।

উন্নয়নশীল মুসলিম দেশগুলোতে গবেষণার জন্য নেই আধুনিক ল্যাব, স্কলারশিপ বা বিজ্ঞান তহবিল।

৭.৪: বর্তমান মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞান ও গবেষণার করুণ চিত্র

(ক) গবেষণাপত্র ও পেটেন্টে পিছিয়ে

বিশ্বের মোট বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রের মাত্র ২.৫% মুসলিম দেশগুলো থেকে আসে, যদিও তারা বিশ্বের ২৫% জনসংখ্যা।

মুসলিম দেশগুলোর মিলিত পেটেন্টের সংখ্যা এককভাবে ইসরায়েলের চেয়েও কম।

(খ) বিশ্ববিদ্যালয়ের মান

বিশ্বের শীর্ষ ২০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় মুসলিম বিশ্বের মাত্র ২-৩টি বিশ্ববিদ্যালয় ঠাঁই পায়।

উন্নত গবেষণাগার, জার্নাল, এক্সপেরিমেন্টাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার – এগুলোর অভাব প্রকট।

(গ) ‘Brain Drain’ সমস্যা

মুসলিম বিশ্বের প্রতিভাবান ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চশিক্ষার জন্য পশ্চিমে পাড়ি জমায় এবং অধিকাংশই আর ফেরে না।

এতে জ্ঞান ও দক্ষতার এক বিশাল ক্ষতি হয়।

৭.৫: পরমাণু প্রযুক্তিতে গবেষণার ঘাটতি

পারমাণবিক প্রযুক্তি অত্যন্ত জটিল, বহুবিধ ক্ষেত্রজোড়া গবেষণা প্রয়োজন:

নিউক্লিয়ার ফিজিক্স

নিউট্রন রিয়্যাক্টর ডিজাইন

রেডিওলজিক্যাল প্রোটেকশন

নিউক্লিয়ার মেডিসিন

ইলেকট্রনিক্স ও সেন্সর প্রযুক্তি

কিন্তু এসব ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোর বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান, গবেষণা তহবিল, এবং মানবসম্পদ যথেষ্ট নয়।

উদাহরণস্বরূপ:

পাকিস্তান ছাড়া কোনো মুসলিম দেশের নিজস্ব গবেষণায় পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা নেই।

ইরান অনেক এগিয়েছে বটে, তবে সেটা নিষেধাজ্ঞায় বন্দী।

বাংলাদেশ রূপপুর প্রকল্প করেছে ঠিকই, তবে তা রাশিয়ার উপর ৯৯% নির্ভরশীল।

৭.৬: মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞানমনস্ক নেতৃত্বের ঘাটতি

যে সকল দেশ প্রযুক্তিতে এগিয়েছে, তাদের নেতৃত্ব ছিল:

বিজ্ঞানমনস্ক (যেমন: সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ),

শিক্ষাবান্ধব,

এবং গবেষণায় বিনিয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়া।

কিন্তু মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রনায়ক:

বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দেন না।

শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রযুক্তি উন্নয়নকে দ্বিতীয় শ্রেণির বিষয় ভাবেন।

নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়িয়ে, গবেষণা খাতে কৃচ্ছ্রসাধন করেন।

৭.৭: বিজ্ঞান ও ইসলাম — প্রকৃত সম্পর্ক

অনেক মুসলমান মনে করে, বিজ্ঞান পশ্চিমা ধারণা। কিন্তু এটি ভুল। ইসলাম শুরু থেকেই বিজ্ঞানকে উৎসাহ দিয়েছে:

কুরআনে প্রায় ৭৫০ আয়াতে প্রকৃতি, সৃষ্টি, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসার ইঙ্গিত আছে।

রাসূল (সা.) স্বয়ং চিকিৎসা, কৃষি ও জ্যোতির্বিদ্যায় আগ্রহ দেখিয়েছেন।

তাই বিজ্ঞানচর্চা ইসলামী আদর্শের বিরুদ্ধ নয়, বরং তারই ধারাবাহিকতা।

৭.৮: করণীয় ও উত্তরণের পথ

১. জ্ঞানকে ফরজ হিসেবে পুনর্বিন্যস্ত করা — শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞানকে ফরজে আইন হিসেবে প্রচার।

2. বিজ্ঞান গবেষণায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়ানো — মুসলিম দেশগুলোকে কমপক্ষে GDP-র ২% গবেষণায় বরাদ্দ দিতে হবে।

3. উন্নত বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় ও ল্যাব গঠন — আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব, রিয়্যাক্টর, মডেল প্ল্যান্ট তৈরি।

4. ইসলামি বিজ্ঞানীদের পুনরাবিষ্কার ও শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্তি — স্বর্ণযুগের বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যকে আধুনিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা।

5. যৌথ গবেষণাকেন্দ্র গঠন — মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মিলে একটি \”Islamic Science Consortium\” গঠন করতে পারে।

৭.৯: উপসংহার

যতদিন না মুসলমানরা আবার জ্ঞানকে তাদের অস্তিত্ব ও অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে, ততদিন তাদের হাতে পরমাণু শক্তি আসবে না, আর এলেও তা টিকবে না। বিজ্ঞান ও গবেষণা কোনো বিলাসিতা নয়, বরং এটি আজকের দুনিয়ায় সারভাইভাল টুল। ইসলাম আমাদের যে জ্ঞান-বিশ্ব গড়ে দিতে চেয়েছিল, আমরা তা থেকে বিচ্যুত হয়েছি। এখন সময় এসেছে ফিরে তাকানোর, নতুনভাবে জেগে ওঠার।

—অধ্যায় ৮: পরমাণু প্রযুক্তির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ

৮.১: ভূমিকা

পরমাণু শক্তি শুধু একটি প্রযুক্তিগত বিষয় নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতি, ভূরাজনীতি ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের একটি কৌশলী হাতিয়ার। বিশ্বে কয়েকটি মাত্র দেশ এই শক্তির অধিকারী, এবং তারা বাকি দেশগুলোকে এটি অর্জন করতে বাধা দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। মুসলিম বিশ্বের দুর্বলতা কেবল প্রযুক্তিগত নয়, বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিসরেও সুগভীর।

৮.২: আন্তর্জাতিক পরমাণু রাজনীতির পর্দা-পেছনের বাস্তবতা

বিশ্বে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কয়েকটি শক্তিধর দেশ:

(ক) পরমাণু শক্তিধর দেশসমূহ:

আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স — বৈধভাবে স্বীকৃত।

ভারত, পাকিস্তান, ইসরায়েল — স্বীকৃতি ছাড়াই শক্তিধর।

উত্তর কোরিয়া — নিষিদ্ধ হলেও সক্ষমতা অর্জন করেছে।

(খ) NPT (Non-Proliferation Treaty)

পারমাণবিক বিস্তার রোধে গঠিত।

মুসলিম দেশগুলোকে বাধ্য করা হয় এটিতে সই করতে।

নিজস্ব শক্তি অর্জনের চেষ্টাকে \”অবৈধ\” বলে দমন করা হয়।

(গ) IAEA (International Atomic Energy Agency)

পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের নজরদারি সংস্থা।

বাস্তবে এটি পশ্চিমা বিশ্ব ও UNSC (জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ)-এর হাতিয়ার।

ফলাফল: মুসলিম বিশ্বের গবেষণা, রিয়্যাক্টর, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া সবই কঠোর নজরদারিতে থাকে।

৮.৩: মুসলিম দেশগুলোর রাজনৈতিক দুর্বলতা

(ক) রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনির্বাচিত শাসন

মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশে রাজতন্ত্র বা সামরিক শাসন বিরাজমান।

এসব দেশে দীর্ঘমেয়াদি বিজ্ঞাননীতি প্রণয়ন হয় না।

সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে গবেষণার ধারা ভেঙে যায়।

(খ) পশ্চিমা প্রভাব ও অনুগত নীতিনির্ধারক

বহু মুসলিম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতি নির্ধারিত হয় বিদেশি চাপে।

পরমাণু প্রযুক্তি অর্জনের আগ্রহ থাকলেও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর চাপে তা পরিত্যাগ করা হয়।

উদাহরণ:
লিবিয়ার গাদ্দাফি পরমাণু প্রযুক্তি চেয়েছিলেন, পরে চাপের মুখে পরিত্যাগ করেন। তার কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি পশ্চিমাদের হামলায় নিহত হন।

৮.৪: মুসলিম বিশ্বের অর্থনৈতিক বাস্তবতা

পরমাণু শক্তি অর্জন ও পরিচালনায় বিপুল অর্থ ব্যয় হয়:

(ক) একটি পরমাণু শক্তি কর্মসূচির ব্যয়:

গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D)

ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ

নিরাপত্তা ইনফ্রাস্ট্রাকচার

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

মানবসম্পদ প্রশিক্ষণ

গড় খরচ: ৫-১০ বিলিয়ন ডলার (প্রকল্পভেদে ভিন্ন)

(খ) অধিকাংশ মুসলিম দেশের বৈদেশিক ঋণ ও ঘাটতি

বিশ্বব্যাংক, IMF এর চাপে সামাজিক খাতে ব্যয় কমাতে হয়।

রুটিন বাজেটেই ঘাটতি থাকে, গবেষণায় বরাদ্দ হয় না।

(গ) তেলনির্ভরতা ও বৈচিত্র্যের অভাব

মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি এককেন্দ্রিক — শুধু তেলভিত্তিক।

গবেষণা, উৎপাদন, প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ খুবই সীমিত।

৮.৫: মুসলিম দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ

(ক) দুর্নীতি ও অপচয়

প্রকল্পে দুর্নীতি হলে গবেষণা ধীরগতির হয়।

অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের বিকল্প কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়।

(খ) জনসমর্থনের অভাব ও শিক্ষিত শ্রেণির বিমুখতা

পরমাণু প্রযুক্তি সম্পর্কে জনসচেতনতা কম।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তরুণদের আকর্ষণ কমছে।

(গ) আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ভয়

ইরান যখন পরমাণু কর্মসূচি চালু করে, তখনই তার উপর অবরোধ আরোপ হয়।

অন্য মুসলিম দেশগুলো ভয় পায় যেন “ইরান বানিয়ে দেওয়া না হয়।”

৮.৬: পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতি

(ক) ইসরায়েলের পরমাণু অস্ত্র:

গোপনে শক্তি অর্জন করেও, পশ্চিমা বিশ্ব কিছু বলেনি।

আমেরিকা ইসরায়েলকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে।

(খ) পাকিস্তানের চাপে থাকা:

পাকিস্তান মুসলিম বিশ্বে একমাত্র সফল পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হলেও:

আন্তর্জাতিক চাপ প্রায়ই মুখ থুবড়ে ফেলার মতো ছিল।

তাকে “অস্থির”, “ঝুঁকিপূর্ণ” বলা হয়।

(গ) মুসলিম দেশের প্রকল্পে বাধা দেওয়া:

সৌদি আরব, তুরস্ক বা বাংলাদেশ পরমাণু চুক্তি করতে গেলে শর্তারোপ হয়:

\’অস্ত্র নয়, শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করতে হবে।\’

৮.৭: পরমাণু সক্ষমতার দিকে এগিয়ে যেতে হলে কী করা প্রয়োজন?

১. নিজস্ব রাজনৈতিক স্বকীয়তা অর্জন

স্বাধীন কূটনীতি ও বহুপাক্ষিক জোট গঠন (যেমন: ওআইসি ভিত্তিক জোট)।

পরমাণু গবেষণা বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা।

২. বিকল্প অর্থনৈতিক মডেল তৈরি

শুধুমাত্র তেলনির্ভর না হয়ে প্রযুক্তি, উৎপাদন, কৃষি খাতে বৈচিত্র্য আনতে হবে।

গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য বাজেট সংস্কার দরকার।

৩. দুর্নীতি রোধ ও জবাবদিহিতা

বৈজ্ঞানিক প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা জরুরি।

গবেষণার জন্য নিয়োজিত অর্থ যাতে অপচয় না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

৪. আন্তর্জাতিক মিত্রতা ও আইনগত প্রস্তুতি

IAEA-র সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো রেখে শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

একইসাথে বৈশ্বিক ডিপ্লোম্যাসিতে এমন অবস্থান নিতে হবে যাতে “দ্বৈত নীতির” শিকার না হয়।

৮.৮: উপসংহার

পরমাণু শক্তি অর্জন কেবলমাত্র প্রযুক্তিগত নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, এবং কৌশলগত কূটনীতির পরীক্ষাও বটে। মুসলিম বিশ্ব এই তিন দিকেই এখনো দুর্বল। যতদিন মুসলমানরা নিজেদের রাজনীতিতে স্বাধীনতা, অর্থনীতিতে সক্ষমতা, এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করতে না পারবে — ততদিন পরমাণু শক্তি তাদের অধরা স্বপ্নই থেকে যাবে।—

অধ্যায় ৯: মুসলিম বিশ্বের সফল উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

৯.১: ভূমিকা

যদিও মুসলিম বিশ্ব সামগ্রিকভাবে পরমাণু শক্তিতে পিছিয়ে রয়েছে, তবুও কিছু ব্যতিক্রমী উদাহরণ এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার ঝলক রয়েছে। পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক, সৌদি আরবসহ কিছু দেশ পরমাণু প্রযুক্তিতে আংশিক বা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। এসব থেকে শিক্ষা নিয়ে গোটা মুসলিম জগৎ একটি সম্মিলিত লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারে।

৯.২: পাকিস্তান – মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র

(ক) পারমাণবিক বোমা তৈরির ইতিহাস

১৯৭৪ সালে ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষার পর পাকিস্তান পরমাণু কর্মসূচি শুরু করে।

১৯৯৮ সালে পাকিস্তান সফলভাবে ৬টি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় (চাগাই পাহাড়ে)।

ড. আব্দুল কাদির খান ছিলেন এই সফলতার রূপকার।

(খ) পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সাফল্য

পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারতের বাধা সত্ত্বেও পাকিস্তান গোপনে প্রযুক্তি সংগ্রহ করে।

অভ্যন্তরীণভাবে বিজ্ঞানীদের উৎসাহ, সরকারী সহযোগিতা এবং জনগণের সমর্থন ছিল মূল চালিকা শক্তি।

(গ) শিক্ষা: রাজনৈতিক সংকল্প, বিজ্ঞানমনস্ক নেতৃত্ব, এবং ঐক্যবদ্ধ জাতি একটি দেশকে কীভাবে শক্তিশালী করতে পারে তা পাকিস্তান প্রমাণ করেছে।

৯.৩: ইরান – শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তির সংগ্রামী রাষ্ট্র

(ক) ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি

১৯৭০-এর দশকে কর্মসূচি শুরু, তবে ইসলামি বিপ্লবের পর বাধা আসে।

২০০০-এর পর থেকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও গবেষণায় মনোযোগ দেয়।

(খ) আন্তর্জাতিক চুক্তি ও চাপ

JCPOA (Joint Comprehensive Plan of Action) ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত হয়।

ইরান তাদের কর্মসূচি সীমিত রাখার শর্তে কিছু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার পায়।

(গ) শিক্ষা: অর্থনৈতিক চাপ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সত্ত্বেও নিরবিচারে কাজ করে যাওয়া ইরান একটি উদাহরণ। মুসলিম দেশগুলোর উচিত ইরানের মতো নিজস্ব বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা গড়ে তোলা।

৯.৪: তুরস্ক – সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ

(ক) পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র নির্মাণ

Akkuyu Nuclear Power Plant (রাশিয়ার সহযোগিতায় নির্মিত), ২০২4–2025 সালের মধ্যে চালু হবে।

এটি পূর্ণ সক্ষমতায় কাজ করলে তুরস্কের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ১০% পূরণ করতে পারবে।

(খ) নিজস্ব গবেষণার পরিকল্পনা

তুরস্ক গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।

ভবিষ্যতে দেশীয়ভাবে পরমাণু প্রযুক্তি তৈরি করতেও আগ্রহী।

(গ) শিক্ষা: আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে মুসলিম দেশগুলোরও শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি অর্জন সম্ভব।

৯.৫: সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোর পদক্ষেপ

(ক) সৌদি আরব

সৌদি আরব পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করছে।

তারা নিজস্ব ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রযুক্তি অর্জনের চেষ্টা চালাচ্ছে।

পাকিস্তান বা চীন থেকে সহায়তা নেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে।

(খ) UAE (সংযুক্ত আরব আমিরাত)

Barakah Nuclear Power Plant সফলভাবে কাজ করছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার সহযোগিতায় নির্মিত এই কেন্দ্র শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মডেল।

(গ) শিক্ষা: মুসলিম দেশগুলো চুক্তিভিত্তিক বিদেশি সহায়তায় শক্তি উৎপাদনে পারমাণবিক প্রযুক্তি গ্রহণ করতে পারছে, যা ভবিষ্যতের ভিত্তি হতে পারে।

৯.৬: সম্মিলিত উদ্যোগের সম্ভাবনা

(ক) OIC ভিত্তিক পরমাণু গবেষণা জোট

ওআইসি সদস্য দেশগুলোর মধ্যে একটি যৌথ ‘নিউক্লিয়ার রিসার্চ কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাব হতে পারে।

অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞানী ও অর্থ একত্রিত করে একটি মুসলিম পারমাণবিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব।

(খ) Muslim Nuclear Consortium

মডেল হতে পারে EU-এর মতো একক গবেষণা সংস্থা।

লক্ষ্য হবে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি অর্জন ও নিজেদের মধ্যে প্রযুক্তি ভাগাভাগি।

(গ) প্রযুক্তি স্থানান্তর ও প্রশিক্ষণ

উন্নত মুসলিম রাষ্ট্রগুলো দুর্বল দেশগুলোকে ট্রেনিং ও স্কলারশিপ দিতে পারে।

যৌথ গবেষণা প্রকল্পে ছাত্র ও গবেষকরা অংশ নিতে পারবে।

৯.৭: ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা – কীভাবে এগিয়ে যেতে পারি?

পদক্ষেপ ব্যাখ্যা

১. জাতীয় বিজ্ঞাননীতি প্রতি মুসলিম দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
২. শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন STEM (Science, Tech, Engineering, Math) শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
৩. গবেষণা বাজেট বৃদ্ধি GDP-এর কমপক্ষে ২% গবেষণায় ব্যয় করার পরিকল্পনা গ্রহণ।
৪. বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীর মর্যাদা বৃদ্ধি মুসলিম দেশগুলোতে গবেষকদের বেতন, সম্মান এবং উৎসাহ বাড়াতে হবে।
৫. গণসচেতনতা জনগণের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে গণমাধ্যম ব্যবহার।

৯.৮: উপসংহার

পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক, সৌদি আরব ও UAE এর মতো দেশগুলো প্রমাণ করেছে যে মুসলিম বিশ্ব চাইলেই পরমাণু প্রযুক্তিতে এগিয়ে যেতে পারে। প্রয়োজন শুধু একাগ্রতা, দূরদর্শিতা, এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা। মুসলমানরা যদি নিজেদের শেকড়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে – জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথ আবার গ্রহণ করে – তবে একদিন অবশ্যই মুসলিম বিশ্ব পরমাণু শক্তিতে একটি সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে।

——

অধ্যায় ১০: করণীয় ও সুপারিশমালা

১০.১: ভূমিকা

পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে কেন মুসলিম বিশ্ব পারমাণবিক শক্তিতে দুর্বল, কোথায় ঘাটতি এবং কোথায় সম্ভাবনা রয়েছে। এই অধ্যায়ে আমরা সেই বিশ্লেষণের আলোকে একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ উপস্থাপন করবো—যা মুসলিম দেশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে পারমাণবিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে।

১০.২: রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে করণীয়

(১) বিজ্ঞান-প্রযুক্তিনির্ভর জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ

প্রতিটি মুসলিম দেশের উচিত জাতীয়ভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০–৩০ বছরের সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা।

এই পরিকল্পনায় পারমাণবিক শক্তি অর্জন হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।

(২) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বাজেট বৃদ্ধি

জাতীয় বাজেটে অন্তত GDP-এর ২%-৩% গবেষণা ও উন্নয়নে বরাদ্দ করতে হবে।

বিশেষ করে পারমাণবিক শক্তি, নবায়নযোগ্য শক্তি, মহাকাশ প্রযুক্তি ও AI-এর গবেষণায় বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।

(৩) পারমাণবিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও আধুনিকায়ন

দেশীয়ভাবে নিউক্লিয়ার রিসার্চ ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে হবে।

পুরনো গবেষণাগার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আধুনিকায়ন জরুরি।

(৪) আইনি ও কূটনৈতিক প্রস্তুতি

IAEA ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কৌশলী সম্পর্ক বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি চালু রাখা।

যাতে ভবিষ্যতে সামরিক প্রয়োজনে প্রয়োগযোগ্য সক্ষমতা গোপনে বা যৌথভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়।

১০.৩: মুসলিম বিশ্বের সম্মিলিত করণীয় (Collective Strategy)

(১) OIC-এর কার্যকর ভূমিকা

ওআইসি’র মাধ্যমে একটি “Muslim Nuclear Consortium” গঠন করা যেতে পারে।

এই কনসোর্টিয়াম সদস্যদের মধ্যে তথ্য, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিনিময় করবে।

(২) পারমাণবিক সংহতি তহবিল (Islamic Nuclear Development Fund)

ধনী মুসলিম রাষ্ট্রগুলো (যেমন সৌদি আরব, কাতার, তুরস্ক) মিলে একটি ফান্ড গঠন করতে পারে।

যেটি গরিব মুসলিম দেশগুলোর বিজ্ঞান, গবেষণা ও শিক্ষা খাতে সহায়তা প্রদান করবে।

(৩) বিজ্ঞানী বিনিময় ও সম্মিলিত গবেষণা কর্মসূচি

পারমাণবিক প্রযুক্তিতে পারদর্শী বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন মুসলিম দেশে পাঠিয়ে “Joint Research Project” পরিচালনা।

এতে কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা সমভাবে বৃদ্ধি পাবে।

১০.৪: শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন

(১) স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে STEM শিক্ষার প্রসার

বিজ্ঞান, গণিত, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিতে আগ্রহী প্রজন্ম তৈরি করতে হবে।

বিজ্ঞান শিক্ষাকে জীবনের সাথে যুক্ত করে তোলা প্রয়োজন।

(২) বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পারমাণবিক ও অ্যাডভান্সড টেকনোলজির বিভাগ চালু

প্রত্যেক বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং, রেডিয়েশন সেফটি, পার্টিকল ফিজিক্স, ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

(৩) স্কলারশিপ ও গবেষণা অনুদান

মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য গবেষণাভিত্তিক স্কলারশিপ চালু করা প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাঠিয়ে বিজ্ঞানী তৈরি করতে হবে।

১০.৫: জনসচেতনতা ও সাংস্কৃতিক রূপান্তর

(১) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা

মিডিয়া, বই, সিনেমা, নাটক, ইউটিউব কনটেন্টে বিজ্ঞানমনস্ক বার্তা ছড়াতে হবে।

মুসলিম সভ্যতার অতীতের বৈজ্ঞানিক অবদান তুলে ধরতে হবে।

(২) ধর্ম ও বিজ্ঞানকে সাংঘর্ষিক নয় বরং সম্পূরক হিসেবে উপস্থাপন

ইসলামে জ্ঞানচর্চার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।

কোরআনের আয়াত ও হাদিস থেকে বিজ্ঞান অনুপ্রেরণা পাওয়ার প্রচার চালাতে হবে।

১০.৬: ব্যক্তিগত ও নাগরিক পর্যায়ে করণীয়

(১) নিজ নিজ পেশায় পেশাগত দক্ষতা অর্জন

ছাত্রছাত্রীদের উচিত নিজ নিজ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন করে জাতির জন্য সম্পদে পরিণত হওয়া।

(২) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আগ্রহী প্রজন্ম গড়ে তোলা

শিক্ষক, অভিভাবক ও সমাজের সকল স্তরের মানুষের উচিত শিশুদের ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের দিকে উদ্বুদ্ধ করা।

(৩) গবেষণাপ্রিয়তা ও উদ্ভাবনী চিন্তার চর্চা

সমস্যা সমাধানে মৌলিক চিন্তা ও গবেষণার প্রতি আকৃষ্ট হতে হবে।

স্টার্টআপ, হ্যাকাথন, বিজ্ঞানমেলা ইত্যাদি আয়োজন বাড়ানো উচিত।

১০.৭: বিশেষ সুপারিশমালা (Summary of Action Points)

ক্ষেত্র সুপারিশ

রাষ্ট্রীয় জাতীয় বিজ্ঞাননীতি, গবেষণা বাজেট বৃদ্ধি, পরমাণু গবেষণাগার স্থাপন
আন্তর্জাতিক Muslim Nuclear Consortium, সম্মিলিত তহবিল, প্রযুক্তি ভাগাভাগি
শিক্ষা STEM শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয়ার বিভাগ, স্কলারশিপ
জনসচেতনতা মিডিয়ায় বিজ্ঞান বার্তা, ধর্ম ও বিজ্ঞানের সমন্বয়
ব্যক্তি পর্যায় গবেষণার প্রতি আগ্রহ, পেশাগত উন্নয়ন, নতুন প্রজন্ম গঠন

১০.৮: উপসংহার

মুসলিম বিশ্বের দুর্বলতা কোনো স্থায়ী সত্য নয়। ইতিহাসে মুসলমানরাই ছিলেন বিশ্বের প্রধান বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও উদ্ভাবক। আমরা সেই উত্তরাধিকারকে ফিরিয়ে আনতে পারি যদি পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাই। পরমাণু শক্তির মতো উচ্চ প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের প্রয়োজন দৃঢ় মনোবল, ঐক্য, সুশিক্ষা, এবং আল্লাহর উপর ভরসা রেখে নিরবিচারে চেষ্টা।

একটি বিজ্ঞানমনস্ক, প্রযুক্তিনির্ভর, আত্মনির্ভরশীল মুসলিম জগৎ গড়ে তোলাই হোক আমাদের লক্ষ্য।

১৪১
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন