মনোযোগ অর্থনীতি: আধুনিক যুগের অদৃশ্য মুদ্রা
মনোযোগ অর্থনীতি: আধুনিক যুগের অদৃশ্য মুদ্রা
নন্দ দুলাল মন্ডল

আলোচনা - মনোযোগ অর্থনীতি: আধুনিক যুগের অদৃশ্য মুদ্রা

লেখক: নন্দ দুলাল মন্ডল
প্রকাশ - মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

Attention Economy (মনোযোগ অর্থনীতি) :

যুগের অনন্ত প্রাচীরে যখন প্রযুক্তি আঘাত হানল, তখন শব্দ, দৃশ্য ও বার্তার বিস্ফোরণে মনুষ্যচেতনায় ঘটল এক বিপ্লব। ইতিহাসের এই বাঁকে আবির্ভূত হলো এক নতুন শক্তি—মনোযোগ অর্থনীতি, যা অর্থ, তথ্য ও সময়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মানুষের চেতনার সর্বোচ্চ সম্পদটিকে টেনে আনল বাজারের অদৃশ্য গর্ভে।
এই ধারণার শিকড় খুঁজে পাই বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন তথ্য-বিপ্লব ধীরে ধীরে দিগন্তে রক্তিম ছায়া ফেলছে। ১৯৭১ সালে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ হার্বার্ট সাইমন প্রথম বলেছিলেন—

“তথ্যের প্রাচুর্য মানে মনোযোগের দারিদ্র্য।”

এই বাক্যটি যেন ছিল ভবিষ্যতের এক গূঢ় ভবিষ্যদ্বাণী।
তথ্য যত বাড়তে থাকল, মানুষের মনোযোগ তত টুকরো টুকরো হয়ে গেল। তখন থেকেই বিজ্ঞাপনদাতা, মিডিয়া প্রতিষ্ঠান, এবং পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তি জায়ান্টরা অনুধাবন করল—এই বিচরণশীল মনই আসল পণ্য।

তথ্যের সাগরে আমরা যেভাবে ভাসছি, তার তলে গভীর এক বস্তু লুকিয়ে আছে—মনোযোগ। তথ্যের অজস্র প্রবাহে হারিয়ে যাওয়া মানুষের মনোযোগ আজ পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান অদৃশ্য মুদ্রা। এই অর্থনীতির কূটচালনা আমাদের সময়কে নিয়ন্ত্রণ করে, আমাদের চেতনার গভীরতম স্তর স্পর্শ করে।

আমাদের মনোযোগ এখন আর শুধু ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, বরং একটি মহাসামাজিক সম্পত্তি, যা প্রতিটি তথ্যবহুল প্রতিষ্ঠান চরম আকর্ষণীয় রূপে দাবি করে।

“মনোযোগ যেন প্রহরী,
তথ্যের দুর্গে দরজা রক্ষক স্নিগ্ধ।”

★ কিভাবে মনোযোগ অর্থনীতি কাজ করে?

ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম সহ অনলাইন বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ডিজাইন করা হয় মনোযোগ ধরে রাখার জন্য। ছোট ছোট ভিডিও, আকর্ষণীয় ছবি, চটকদার শিরোনাম—এসব কিছু মানুষের চোখ আটকে রাখতে সাহায্য করে। বিজ্ঞাপনদাতারা এই প্ল্যাটফর্মগুলোকে ব্যবহার করে তাদের পণ্য বা সেবা প্রচার করে, যেখানে তারা ব্যবহারকারীর মনোযোগকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করে।

আমাদের মনোযোগই হলো মূলধন, যা বিনিময় হয় বিজ্ঞাপনদাতাদের অর্থের সাথে। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো এমনকি আমাদের স্বভাব, পছন্দ, চিন্তা-ভাবনা পর্যবেক্ষণ করে মনোযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করে। এর ফলে আমাদের তথ্যের মাঝে আমরা প্রায়ই বিভ্রান্ত হই, বা অতিরিক্ত সময় ব্যয় করি, যা অনেক সময় আমাদের জীবনের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।
– কল্পনা করুন, একটি বিশাল গ্রন্থাগার, যেখানে হাজার হাজার বই সাজানো। প্রতিটি বই আকর্ষণীয়, গদ্য, পদ্য, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, ইতিহাস, কলা—তবে পাঠকের চোখের পাতা মাত্র একবার পলকে ধরা পড়বে। এই সীমিত চোখের পাতা, অর্থাৎ মানুষের মনোযোগই হলো সেই গ্রন্থাগারের “মূল্যবান চাবি”। যার কাছে বেশি মনোযোগ, তারই অধিক প্রভাব, অধিক শক্তি।
অতিপ্রচুর তথ্যের এই গ্রন্থাগারে মনোযোগ হারানো মানে নিজেকে হারানো।

মনোযোগ অর্থনীতির সৃষ্টিকর্তা
হার্বার্ট সাইমন একটি সময় বলেছিলেন,
“তথ্যের অতিভাস আমাদের মনোযোগকে দখল করে নিয়েছে।”
যা অর্থাৎ, তথ্যের অপরিসীম প্রবাহ মানুষের মনস্তত্ত্বে বিভ্রান্তি এবং বিভাজন সৃষ্টি করে। এই প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানি মনোযোগ আকৃষ্টকরণের কৌশল সাজায়, যেন তারা মানুষের মনকে একটি চৌকাঠের ভিতরে বন্দি করে রাখে।

‌★ প্রযুক্তি ও মনোযোগের নাটকীয় মিলন :-

আজকের ডিজিটাল বিশ্ব মানেই একটি বিশাল থিয়েটার, যেখানে আমাদের মনোযোগ হচ্ছে প্রধান অভিনেতা এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নিয়ন্ত্রণকর্তা পরিচালক।
স্ক্রিনের নানান গিজমো, নোটিফিকেশন, লাইক, শেয়ার—এসব নাচের ছন্দে মনোযোগের যজ্ঞ চলছে। এই যজ্ঞে আমরা কখনো নাচের সুর বুঝি না, শুধু ছন্দের পালে পালে দৌড়াই।

এমন সময় একটি দুঃখান্ত বাণী মনে পড়ে যায়—

“মনোযোগের জালে জড়াই,
স্বপ্নের বাণী কেবল নীরব কাহিনী।”

★ মনোযোগ অর্থনীতির প্রভাব ও পরিণতি :-

আমাদের মনোযোগ যদি একটি নদী হয়, তবে আজ তা বাধাহীন প্রবাহিত হচ্ছে অসংখ্য বাঁধ এবং বাঁধের পেছনে লুকানো শত্রুদের বিরুদ্ধে। আমাদের মস্তিষ্ক যেন এককালে শান্ত স্বচ্ছ জল ছিল, আজ তা তুফানমুখর স্রোত।

– অতিরিক্ত মনোযোগ দিতে দিতে মানুষ উদ্বিগ্ন,এবং একাকিত্বে ভুগতে শুরু করে দিয়েছে। মনোযোগে স্থিরতা না থাকায় মানসিক চাপ বেড়ে যায়।
– আমরা প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানোর বদলে ফোন স্ক্রিনের দিকে বেশি মনোযোগ দিই, যার ফলে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ছে।
– মনোযোগ বিঘ্নিত হলে পড়াশোনা ও কাজের মান কমে যায়। বহুবিধ তথ্যের মাঝে বিচলিত মস্তিষ্কে স্থিরতা থাকে না।
– মনোযোগ অর্থনীতির প্ল্যাটফর্মগুলো রাজনৈতিক ও সামাজিক মতবাদের ওপর প্রভাব ফেলে। মিথ্যা খবর, সন্ত্রাসী তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে।
এছাড়াও প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে  আরও বহু প্রভাব ফেলে চলেছে ক্রমশ।
আর আমি আপনি ধীরে ধীরে এক একটা লোভনীয় প্রোডাক্টে পরিণত হচ্ছি ক্রমশ।
সাম্প্রতিক সময়ে গবেষক Matthew Crawford, Tim Wu, এবং Shoshana Zuboff এর মতো চিন্তাবিদগণ মনোযোগ অর্থনীতিকে সভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, কিভাবে এই অর্থনীতি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা, গভীর ভাবনা, এমনকি নৈতিক চেতনাকেও নিয়ন্ত্রণ করছে।
মনোযোগ অর্থনীতির ইতিহাস এক মৃদু বাতাসের মতো শুরু হলেও আজ তা এক প্রলয়ংকারী ঝড়ে রূপান্তরিত হয়েছে। এই ঝড়ের মধ্যে মানুষ হারাচ্ছে তার অভ্যন্তরীণ নীরবতা, সৃজনশীলতা, ও স্বাধীন মানসিক পরিসর।
এখন সময় এসেছে যাতে আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মনোযোগকে ফিরিয়ে আনতে পারি তার প্রকৃত মালিকের কাছে: “নিজের কাছে” ।

• বিদ্র: আলোচনাটি শুধুমাত্র শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যের জন্য,
ছবি-সংগৃহীত ।

৫১
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন