অর্জ্জুন ও চিত্রাঙ্গদা
চিত্রাঙ্গদা
প্রভু, মিটিয়াছে সাধ? এই সুললিত
সুগঠিত নবনী-কোমল সৌন্দর্য্যের
যত গন্ধ যত মধু ছিল, সকলি কি
করিয়াছ পান! আর কিছু বাকি আছে?
আর কিছু চাও? আমার যা কিছু ছিল
সব হয়ে গেছে শেষ?—হয় নাই প্রভু!
ভালাে হােক, মন্দ হােক, আরাে কিছু বাকি
আছে, সে আজিকে দিব।
প্রিয়তম, ভালাে
লেগেছিল বলে’ করেছিনু নিবেদন
এ সৌন্দর্য-পুষ্পরাশি চরণকমলে—
নন্দনকানন হ’তে তুলে’ নিয়ে এসে
বহু সাধনায়। যদি সাঙ্গ হ’ল পূজা
তবে আজ্ঞা কর প্রভু, নির্ম্মাল্যের ডালি
ফেলে দিই মন্দির বাহিরে। এইবার
প্রসন্ন নয়নে চাও সেবিকার পানে।
যে ফুলে করেছি পূজা, নহি আমি কভু
সে ফুলের মত প্রভু এত সুমধুর,
এত সুকোমল, এত সম্পূর্ণ সুন্দর।
দোষ আছে, গুণ আছে, পাপ আছে, পুণ্য
আছে; কত দৈন্য আছে; আছে আজন্মের
কত অতৃপ্ত তিয়াষা। সংসার-পথের
পান্থ, ধূলিলিপ্ত বাস, বিক্ষত চরণ;
কোথা পাব কুসুম-লাবণ্য, দুদণ্ডের
জীবনের অকলঙ্ক শােভা! কিন্তু আছে
অক্ষয় অমর এক রমণী-হৃদয়?
দুঃখ সুখ আশা ভয় লজ্জা দুর্ব্বলতা
ধূলিময়ী ধরণীর কোলের সন্তান,
তা’র কত ভ্রান্তি, তা’র কত ব্যথা,
কত ভালবাসা, মিশ্রিত জড়িত হ’য়ে
আছে এক সাথে।—আছে এক সীমাহীন
অপূর্ণতা, অনন্ত মহৎ। কুসুমের
সৌরভ মিলায়ে থাকে যদি, এইবার
সেই জন্ম-জন্মান্তের সেবিকার পানে
চাও।
সূর্য্যোদয়
( অবগুণ্ঠন খুলিয়া)
আমি চিত্রাঙ্গদা। রাজেন্দ্রনন্দিনী:
হয় ত পড়িবে মনে, সেই একদিন
সেই সরােবরতীরে, শিবালয়ে, দেখা
দিয়েছিল এক নারী, বহু আবরণে
ভারাক্রান্ত করি’ তা’র রূপহীন তনু।
কি জানি কি বলেছিল নির্লজ্জ মুখরা,
পুরুষেরে করেছিল পুরুষ-প্রথায়
আরাধনা; প্রত্যাখ্যান করেছিলে তা’রে।
ভালোই করেছ। সামান্য সে নারীরূপে
গ্রহণ করিতে যদি তা’রে, অনুতাপ
বিঁধিত তাহার বুকে আমরণ কাল।
প্রভু, আমি সেই নারী। তবু আমি সেই
নারী নহি; সে আমার হীন ছদ্মবেশ।
তার পরে পেয়েছিনু বসন্তের বরে
বর্ষকাল অপরূপ রূপ। দিয়েছিনু
শ্রান্ত করি’ বীরের হৃদয়, ছলনার
ভারে। সেও আমি নহি।
আমি চিত্রাঙ্গদা।
দেবী নহি, নহি আমি সামান্যা রমণী।
পূজা করি’ রাখিবে মাথায়, সেও আমি
নই, অবহেলা করি’ পুষিয়া রাখিবে
পিছে সেও আমি নহি। যদি পার্শ্বে রাখ
মােরে সঙ্কটের পথে, দুরূহ চিন্তার
যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি কর’
৬৫
5-5
কঠিন ব্রতের তব সহায় হইতে,
যদি সুখে দুখে মােরে কর সহচরী,
আমার পাইবে তবে পরিচয়। গর্ভে
আমি ধরেছি যে সন্তান তােমার, যদি
পুত্র হয়, আশৈশব বীরশিক্ষা দিয়ে
দ্বিতীয় অর্জ্জুন করি’ তা’রে একদিন
পাঠাইয়া দিব যবে পিতার চরণে,
তখন জানিবে মােরে প্রিয়তম!
আজ
শুধু নিবেদি চরণে, আমি চিত্রাঙ্গদা,
রাজেন্দ্রনন্দিনী।
প্রিয়ে, আজ ধন্য আমি
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন