রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গল্প - কর্ম্মফল (অষ্টম পরিচ্ছেদ)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কর্মফল
শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫ অন্যান

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

নলিনী। সতীশ, আমি তোমাকে কেন ডেকে পাঠিয়েচি বলি, রাগ কোরো না!

সতীশ। তুমি ডেকেচ বলে রাগ করব আমার মেজাজ কি এতই বদ্‌?

নলিনী। না ও সব কথা থাক! সকল সময়েই নদী সাহেবের চেলাগিরি কোরো না! বল দেখি আমার জন্মদিনে তুমি আমাকে অমন দামী জিনিস কেন দিলে?

সতীশ। যাঁকে দিয়েচি তাঁর তুলনায় জিনিসটার দাম এমনই কি বেশী!

নলিনী। আবার ফের নন্দীর নকল!

সতীশ। নন্দীর নকল সাধে করি। তার প্রতি যখন ব্যক্তিবিশেষের পক্ষপাত—

নলিনী। তবে যাও, তোমার সঙ্গে আর। আমি কথা কব না। সতীশ। আচ্ছা মাপ কর,আমি চুপ করে গুনব।

নলিনী। দেখ সতীশ, মিষ্টার নন্দী আমাকে নির্ব্বোধের মত একটা দামী ব্রেস্‌লেট পাঠিয়ে ছিলেন, তুমি অমনি নির্ব্বুদ্ধিতার সুর চড়িয়ে তার চেয়ে দামী একটা নেক্‌লেস্‌ পাঠাতে গেলে কেন?

সতীশ। যে অবস্থায় লোকের বিবেচনাশক্তি থাকে না সে অবস্থাটা তোমার জানা নেই বলে তুমি রাগ করচ নেলি!

নলিনী। আমার সাত জন্মে জেনে কাজ নেই। কিন্তু এ নেক্‌লেস্‌ তোমাকে ফিরে নিয়ে যেতে হবে।

সতীশ। ফিরে দেবে?

নলিনী। দেব। বাহাদুরি দেখাবার জন্য যে দান, আমার কাছে সে দানের কোন মূল্য নেই!

সতীশ। তুমি অন্যায় বলছ নেলি।

নলিনী। আমি কিছুই অন্যায় বলচিনে—তুমি। যদি আমাকে একটি ফুল দিতে আমি ঢের বেশী খুসি হতেম। তুমি যখন-তখন প্রায়ই মাঝে-মাঝে আমাকে কিছুনা কিছু দামী জিনিস পাঠাতে আরম্ভ করেছ। পাছে তোমার মনে লাগে বলে আমি এতদিন কিছুই বলি নি। কিন্তু ক্রমেই মাত্রা বেড়ে চলেছে আর আমার চুপ করে থাকা উচিত নয়। এই নাও তোমার নেক্‌লেস্।

সতীশ। এ নেক্‌লেস্ তুমি রাস্তায় টান মেরে ফেলে দাও কিন্তু আমি এ কিছুতেই নেবনা।

নলিনী। আচ্ছ সতীশ, আমি ত তোমাকে ছেলেবেলা হতেই জানি, আমার কাছে ভাঁড়িয়োনা। সত্য করে বল তোমার কি অনেক টাকা ধার হয় নি?

সতীশ। কে তোমাকে বলেচে? নরেন বুঝি?

নলিনী। কেউ বলে নি। আমি তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারি। আমার জন্য তুমি এমন অন্যায় কেন করচ?

সতীশ। সময়বিশেষে লোকবিশেষের জন্য মানুষ প্রাণ দিতে ইচ্ছে করে; আজকালকার দিনে প্রাণ দেবার অবকাশ খুঁজে পাওয়া যায় না—অন্ততঃ ধার করবার দুঃখটুকু স্বীকার করবার যে সুখ তাও কি ভোগ করতে দেবেনা? আমার পক্ষে যা দুঃসাধ্য আমি তোমার জন্য তাই করতে চাই নেলি একেও যদি তুমি নন্দী সাহেবের নকল বল তবে আমার পক্ষে মর্ম্মান্তক হয়।

নলিনী। আচ্ছা তোমার যা করবার তা ত করেচ—তোমার সেই ত্যাগস্বীকারটুকু আমি নিলেম—এখন এ জিনিসটা ফিরে নাও!

সতীশ। ওটা যদি আমাকে ফিরিয়ে নিতে হয় তবে ঐ নেক্‌লেস্‌টা গলায় ফাঁস লাগিয়ে দম বন্ধ করে আমার পক্ষে মারা ভাল।

নলিনী। দেন। তুমি শোধ করবে কি করে?

সতীশ। মার কাছ হতে টাকা পাব।

নলিনী। ছি ছি, তিনি মনে করবেন আমার জন্যই তাঁর ছেলের দেনা হচে।

সতীশ। সে কথা তিনি কখনই মনে করবেন না, তাঁর ছেলেকে নেক্‌লেস্‌ দিন হতে জানেন।

নলিনী। আচ্ছা সে যাই হোক তুমি প্রতিজ্ঞা কর এখন হতে তুমি আমাকে দামী জিনিষ দেবে না। বড় জোর ফুলের তোড়ার বেশী আর কিছু দিতে পারবে না।

সতীশ। আচ্ছা সেই প্রতিজ্ঞাই করলেম। নলিনী। যাক্‌, এখন তবে তোমার গুরু নন্দী সাহেবের পাঠ আবৃত্তি কর! দেখি স্তুতিবাদ করবার বিদ্যা তোমার কতদূর অগ্রসর হল। আচ্ছা আমার কানের ডগা সম্বন্ধে কি বলিতে পার বল— আমি তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিলেম।

সতীশ। যা বলব তাতে ঐ ডগাটুকু লাল হয়ে উঠবে।

নলিনী। বেশ বেশ, ভূমিকাটা মন্দ হয়নি। আজকের মত ঐটুকুই থাক বাকিটুকু আর একদিন হবে। এখনি কান ঝাঁ ঝাঁ করতে সুরু হয়েছে।

৪১
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন