উত্তীর্ণ পঞ্চাশ : বনবাস প্রাচ্য প্রাজ্ঞদের মতে
অতঃপর অনিবারণীয় ; এবং বিজ্ঞানবলে
পশ্চিম যদিও আয়ুর সামান্য সীমা বাড়িয়েছে
ইদানীং, তবু সেখানেই মৃত্যুভয় যৌবনের
প্রভু, বার্ধক্যের আত্মাপহারক | আশ্রুত তারক
অন্যত্রও অনাগত ; জ্ঞাতিভেদে বিবিক্ত মানুষ ;
নিরঙ্কুশ একমাত্র একনায়কেরা | কিন্তু তারা
প্রাচীর, পরিখা, রক্ষী, গুপ্তচর ঘেরা প্রাসাদেও
উন্নিদ্র যেহেতু, তাই ভগ্ন সেতু নদীতে নদীতে,
মরু নগরে নগরে | পক্ষান্তরে অতিবেল কারা
তথা সংক্রমিত মেরু ব্যক্তির ধ্বংসাবশেষ : দ্বেষে
পুষ্ট চীন থেকে পেরু ; প্রতিহিংসা মানে না সিন্ধুর
মানা | নৈশ হানা, আত্মঘাতী অঙ্গীকার, বিচারের
সম্মত বিকার বা স্বস্হ ধিক্কার অড়িয়ে যে যায়
ভাগ্যগুণে, চোখে চোখে তাকে অদৃশ্য শকুনে
প্রবাসেও অহরহ : যথাকালে অমৃতের দায়
সাশ্রু সন্ততিকে সঁপে, অন্তিম শয্যায় নিকামত
পারে না আশ্রয় নিতে ; ঊষর ধূলিতে নিষ্পিষ্ট সে,
ইতিহাসনিষ্ক্রান্তও বটে | অর্থাৎ কৃতান্ত আজ
ব্যক্ত সর্ব ঘটে ; এবং, প্রৌঢ়ের কেন, সকলেরই
কর্তব্য যেমন অরণ্যে রোদন, তেমনই সম্প্রতি
সাধ্য লোকালয়ে সে-বৃথা বিলাপ ||
. অবশ্য আমার
পক্ষে সংগত যে নয় অনুতাপ, সে-কথা স্বীকার
করি ; কারণ যদিচ মগ্ন শৈলে আমার মাতাল
নৌকা বানচাল হয়ে, বর্তমান বিশ্লিষ্ট কঙ্কাল—
অপ্রাপ্তসত্কার শব প’চে প’চে অস্থিসার যেন—
তথাপি যেকালে নিরুদ্দেশ যাত্রার সংজ্ঞায় হেন
দুরবস্থা শুধু সম্ভাব্যই নয়, অবশ্যম্ভাবীও
বটে, অশোভন তখন নির্বেদ | তা ছাড়া স্বকীয়
সিদ্ধি প্রার্থনীয় নয় সূত্রধার গণেশের কাছে ;
অকূল পাথারে অযাচিত সাম্রাজ্য একদা বাচে
যারা জিতেছিল, অন্তত তাদের অনন্য সম্বল
ছিল প্রাণপাত পৌরুষ এবং রুদ্র কৌতুহল—
নিতান্ত নিরুপলক্ষ | তরল অনলে পরিণত
ঝলমল জল ; গলিত অম্বরতল ; অনুগত
দিগ্বধূর আঁখি ছলছল কষ্টকল্পনায় ; মেঘে
অন্তর্হিত চূড়া, পদান্ত ঊর্মির মুখর উদ্বেগে
প্রতিষ্ঠিত অস্তগিরি, ইত্যাদি বিবাদী লক্ষণের
অলৌকিক নির্বিরোধ তথা সে-সমন্বয়ের জের
স্মিত বিদেশিনীর অভয়ে, এবং সোনার তরী
তাদের ডাকে নি অজানার অভিসারে | হিংস্র অরি
বন্দরে বন্দরে, অবিশ্বাস্য অনুচর, অবহেলা
চরমে নিশ্চিত জেনেই, বেরিয়েছিল তারা ||
. ভেলা
আমি ভাসিয়েছিলুম একদা তাদেরই মতো, আজ
এটুকুই আমার পরম পরিচয় | আমাকেও
লক্ষ্যভেদী নিষাদের উল্বণ উল্লাস উদাসীন
নদীর উজানে দিয়েছিল অব্যাহতি মাল্লাদের
গুণটানা থেকে | গাঁঠ গাঁঠ বিলাতী বস্ত্রের ভার,
রাশি রাশি মার্কিনী গমের ভাবনা ও প্রতিযোগী
ব্যাপারীর বাদ-বিসংবাদ সঙ্গে গিয়েছিল
চুকে ; এবং হঠাৎ অধোগতি অনুকূল স্রোতে ;
হয়েছিল অবারিত | অন্তরীক্ষ বিদীর্ণ বিদ্যুতে ;
ভ্রমি ; ভঙ্গ জলস্তম্ভ ; সমুখ প্রত্যষ কপোতের
পক্ষবিধূনন ; সন্নত সবিতা বেগুনী শোণিতে
লুপ্ত রহস্যের বীভত্স প্রতীক ; ফুটন্ত জলার
জালে জর্জরিত তিমি ; শেষনাগ শিথিলকুণ্ডলী,
মত্কুণের উপজীব্য ; অপ্রেময় নির্বাতমণ্ডলে
বিধ্বস্ত সলিল ; ঊর্ধ্বশ্বাস বরুণের বিপরীত
রতি—সবই দেখেছিলুম আমিও, না দেখে দেখেছি
ব’লে ভাবি নি অথবা অস্বীকার করি নি দেখার
পরে ; এবং এখন স্বভাবের অনুমোদনেই
আমার অনন্য স্বপ্ন প্রাচীন প্রাকারে সুরক্ষিত
জনপদ, স্নিগ্ধ, সান্দ্র সন্ধ্যায় যেখানে খিন্ন শিশু
ভঙ্গুর তরণী-সহ মুকুরিত নিকষ গোষ্পদে ||
কিন্তু গত শতকেও উল্লিখিত গ্রামের সন্ধান
পায় নি স্বয়ং ব়্যাঁবো, সার্বজন্য রসের নিপান
মৃগতৃষ্ণানিবারণে অসমর্থ ব’লে, সে যদিও
ছুটেছিল জনশূন্য পূর্ব আফ্রিকায়, পরকীয়
সাম্রাজ্যবাদের প্রায়শ্চিত্তকল্পে যেন ( সাকী আর
কবিতা সেখানে যেমন অভাবনীয়, মদিরার
অপার্যাপ্তি তেমনি দারুণ ) | আমি বিংশ শতাব্দীর
সমানবয়সী ; মজ্জমান বঙ্গোপসাগরে ; বীর
নই, তবু জন্মাবধি যুদ্ধে যুদ্ধে, বিপ্লবে বিপ্লবে
বিনষ্টির চক্রবৃদ্ধি দেখে, মনষ্যধর্মের স্তবে
নিরুত্তর, অভিব্যক্তিবাদে অবিশ্বাসী, প্রগতিতে
যত না পশ্চাত্পদ, ততোধিক বিমুখ অতীতে |
কারণ ভূতের নির্বন্ধাতিশয়ে, তথা ভবিষ্যের
নিষেধে, অধুনা ত্রিশঙ্কু, এবং সে-খণ্ডে বিশ্বের
মধ্যে দ্বৈপায়ন আমরা সকলে, জানি কি না জানি,
নাস্তিরই বিবর্তবাদ | এমনকি উপস্থিত হানি
সম্ভবত অবাস্তব সুললিত সে-পদ্যের মতো,
যাতে রেণু, বেণু, কদাচ ধেনুও, মিলে, ক্রমাগত
অভিভাবে আত্মোপলব্ধির অভাব লুকিয়ে রাখে ;
এবং অলীক ভেবে, উচ্ছ্বসিত স্বপ্নরচনাকে
যখন করেছি ত্যাগ, সেকালে স্বকপোলকল্পিত
সর্বনাশে হাহুতাশ অবৈধ ও সাফল্যবর্জিত ||
উপরন্তু, দেবযানী-শর্মিষ্ঠার কলহকলাপে
আমার অদ্বৈতসিদ্ধি পণ্ড হয়ে থাক বা না থাক,
অকাল জরায় আমি অবরূদ্ধ নই শুক্রশাপে ;
অজাত পুরুর সঙ্গে ব্যতিহার্য নয় দুর্বিপাক |
অর্থাৎ প্রকট ব’লে সম্ভোগের অনন্ত বঞ্চনা,
পঞ্চাশে পা না দিতেই, অন্তর্যামী নৈমিষে নির্বাক :
এবং রটায় বটে মাঝে মাঝে আজও উদ্ভাবনা
পরিপূর্ণ মহাশূন্য ভস্মীভূত জ্যোতিষ্কের প্রেতে,
প্রাক্তন অভ্যাসদোষে ভুলে যায় মৌনের মন্ত্রণা
উন্নীত অমর কাব্যে কাগজের সুকুমার শ্বেতে ;
কিন্তু চিত্তবিক্ষেপেও অভিব্যাপ্ত বর্তুল সংসার
যেখানে আসক্তি, ঘৃণ্য ভিন্ন শুধু প্রাগ্বর্তী সংকেতে,
এবং চক্রান্তভুক্ত পূর্বাপর নিপাত, উদ্ধার
যেহেতু, আমাকে তাই অনুযোগ, শোচনা, ঈর্ষ্যাদি
ক্ষেপাতে পারে না আর | চরাচরে নেতির বিস্তার
নির্বিকার, হয়তো বা নিরাকার ব্রহ্মের সমাধি :
অন্তত এ-পরিবেশে মানুষের প্রার্থনাসমূহ
জাতিস্মর অভিমন্যু ; তবু স্তব্ধ বিধাতাকে সাধি—
মেনে নিতে পারি যেন অপ্রতর অসীমের ব্যূহ,
স্বপ্নে, জাগরণে যেন মনে রাখি নয় কল্পতরু
ঊর্ধ্বমূল, অধঃশাখ, দুর্নিরীক্ষ্য সেই মহীরুহ,
যাকে কেন্দ্র ক’রে ছোটে দিগ্ বিদিকে সমুদ্র— না মরু ?
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন