তোমরা সকলেই বোধহয় কবিতা পড়্তে ভালোবাস। নানান্ গন্ধের ফুল যেমন তোমাদের প্রাণমন মাতিয়ে তোলে, তেমনি নানান্ ছন্দের, নানান্ ভাবের কবিতা পড়েও তোমরা নিশ্চয়ই খুব খুশী হও। নয় কি?
ছন্দ কোথায় নেই?—গাড়ীর যাওয়া-আসার শব্দে, মানুষের কথাবার্ত্তায়, ফেরী-ওয়ালার ডাক-হাঁকে, পশুদের চীৎকারে, পাখীদের গানে, ভোমরার গুঞ্জনে, নদীর কল্লোলে,—পাতার মর্ম্মর-ধ্বনিতে—সবার ভিতরেই বিভিন্ন ছন্দ বাঁধা আছে। ঐ সব ছন্দ আবার কবিতায় সুন্দরভাবে ধরা যেতে পারে। আজ তোমাদের কয়েকটি নতুন ধরণের মজার ছন্দের নমুনা দেব।
ষ্টেশনে গাড়ী থেমেছে, অমনি খাবার-ওয়ালারা চীৎকার করে’ উঠ্ল—
‘পুরী-মিঠাই’,—
‘গরম চা-চা গরম!’এই ছন্দ এখন কবিতায় ধরা যাক্,—
পুরী-মিঠাই
পুরী-মিঠাই—
আরো কি চাই?

বাবু দেখুন্
ভাবেন্ কি ছাই?
কিনে ফেলুন্
গরম গরম,—
খেয়ে দেখুন্,
কেমন নরম!
বসে’ কেবল
ভাবেন বৃথাই—
পুরী-মিঠাই
পুরী-মিঠাই।
গরম চা—চা গরম
গরম চা—চা গরম—
সহিত তার কেক্ নরম—
নেবেন তো—নিন্ না ছাই,
সময় আর নাইরে নাই।
সহরের রাস্তায় অলিতে গলিতে ফেরী-ওয়ালা চীৎকার করে’ যাচ্ছে—
‘মালাই বরফ্’, ‘চুড়ী চাই’
মালাই বরফ্
মালাই বরফ্!
খেয়েই দেখুন—
কেমন সোয়াদ্,
আরও কি গুণ!
এমন মালাই
কোথায় পাবেন?
বারেক খেলেই
আবার খাবেন—
বরফ বেচেই
আমার গরব—
মালাই বরফ্
মালাই বরফ!
চুড়ী চাই
চুড়ী চাই
চুড়ী চাই—
সারাদিন
হেঁকে যাই,
কোনো পথ
বাকি নাই—
চুড়ী চাই
চুড়ী চাই!
ঐ যে গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে একটি গরীবের ছেলে ভিক্ষা করছে—‘একটি পয়সা—দে মা!’ এখন এটাকে ছন্দে ধরা যাক্—
একটি পয়সা দে মা
একটি পয়সা দে মা,
মুখটি শুক্নো যে মা,
খাইনি আজ্কে যে গো,
একটি পয়সা দে গো!
অন্ধ দুঃখী ছেলে
দ্যাখ্না চক্ষু মেলে,
আর তো পারছি নে মা–
একটি পয়সা দে মা!
‘ম্যাচ’ জিতে একদল ছেলে ভীষণ হল্লা করে বাড়ী ফির্ছে—‘হিপ্ হিপ্ হুররে—!’ ছন্দে ধরা যাক—
হিপ্ হিপ্ হুর্রে
হিপ্ হিপ্ হুর্রে—
বুক্ দুর্ দুর্ রে—
উল্লাস চীৎকার
উৎকট সুর্রে।
আজ আর কাজ নয়
রাস্তায় ঘুর্রে—
হিপ্ হিপ্ হুর্ রে।
রাস্তা দিয়ে একদল লোক একটি মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানে চলেছে—‘বল হরি— হরি বোল্।’ ছন্দে ধরা গেল—
বল হরি হরিবোল্
বল হরি—হরি বোল্,
মরে গেছে—খাটে তোল্।
চল ত্বরা— শ্মশানেই
মরে গেলে—দশা এই।
দুনিয়াতে—যারা ভাই
বেঁচে থেকে—করে জাঁক
তাহাদেরে-ডেকে আন্
এসে তারা—দেখে যাক্।
মরে গেলে— সকলেই
শ্মশানে কি—কবরেই
যাবে, এতে—নাহি গোল্
বল হরি—হরি বোল্।
ঝমাঝম্ বৃষ্টি হচ্ছে। নালার জলে কাগজের নৌকো ভাসিয়ে—পাড়ার ফ্যালা সুর করে’ গান ধরেছে—
আয় বৃষ্টি হেনে
আয় বৃষ্টি হেনে
ছাগ্ কাট্ব মেনে,
মেঘ গর্জ্জে ডাকে
ভেক্ তর্জ্জে হাঁকে।
গাছ কাঁপ্ছে ঝড়ে
বুক্ কাঁপছে ডরে!
একদল লোক একটা ভারী জিনিষ তুল্ছে আর চীৎকার করছে—‘হেঁইয়ো হো’। এটাকে ছন্দে রূপ দেওয়া যাক্—
হেঁইয়ো হো
হেঁইয়ো হো
চুপ্ রহো—
বাঃ সাবাস্,
বাস্রে বাস।
মর্দ্দ কে
সদ্য রে?
করতে কাজ
নয়ক আজ
হদ্দ যে,—
মর্দ্দ সে।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে—দূরের শাল-বনে শেয়াল ডেকে উঠ্ল—‘হুক্কা হুয়া।’
হুক্কা হুয়া
হুক্কা হুয়া
শব্দ শোনো—
বন্-কিনারে
ওই এখনো।
‘হুক্কা হুয়া’
‘হুক্কা হুয়া’

জানছ কি গো
বল্ছে উহা?
বল্ছে ডেকে
ঝোপ্টি থেকে,
বিশ্বে নাকি
সবই ভূয়া—
হুক্কা হুয়া
হুক্কা হুয়া।
এখন, বিদেশী ছন্দ বাংলায় কেমন সুন্দর করে ধরা যায় তার নমুনা দেখ—
Half a league, half a league
Half a league, onward—
চল্ রে চল্, চল্ রে চল্
চল্ রে চল, সম্মুখেই—
কিম্বা—
Twinkle, twinkle, little star—
চঞ্চল, চঞ্চল, তারার সার।
এ-রকম অনেক ছন্দই বাংলায় হতে পারে। আরো নতুন নতুন ছন্দের নমুনা বইখানিতে তোমরা পাবে।
শান্ত দুপুর। রাঙ্গা মাটির পথ এঁকে বেঁকে চলে গেছে—ঐ দূরের নীল জংলা পাহাড়টার কোলে; একটা গরুর গাড়ী চলেছে ঐ পথ ধরে’ ধীরে ধীরে।—একঘেয়ে আওয়াজ কানে আসছে—“ক্যাঁচোর কোঁচ্, ক্যাঁচোর কোঁচ্।” আওয়াজটাকে ছন্দে ধরা গেল।—
ক্যাঁচোর কোঁচ্
ক্যাঁচোর কোঁচ্
ক্যাঁচোর কোঁচ্—
পথের ধার
আওয়াজ রোজ;
চালক ঠায়
তামাক খায়,
তাকায় ওই
পাকায় মোচ্।
গরুর গায়
কেবল, হায়
লাগায় জোর
লাঠির খোঁচ।

বলদ্ গাই
কাতর তাই,
দ্যাখায় ফের
ভুরুর ঘোঁচ্।
ক্যাঁচোর কোঁচ্
ক্যাঁচোর কোঁচ্
দূরের একটা পোড়ো বাড়ীর খোড়ো চালে করুণ সুরে একটা পায়রা ডেকে ডেকে হয়রান্—“বক্ বকম্ বক্।” ও কি বল্ছে কে জানে! যাই-হোক্ আমাদের ছন্দের আর একটি খোরাক্ জুট্লো।
বক্ বকম্ বক্
বক্ বকম্ বক্
বক্ বকম্ বক্
দ্যাখ্—রকম দ্যাখ্
দূর চালায় এক—
কোন্ পাখীর আজ
প্রাণ উতল্ ভাই,
ওই শীতল ছায়
গান্ শুনায় তাই।
কোন্ পাখীর আজ
গান্ গাবার সখ্—
বক্ বকম্ বক্।
—“হুঁই দাব্ড়ে, হুকুম্ দাব্ড়ে”—ও আবার কি? মেঠো রাস্তা ধরে’ একটা পাল্কী এদিকে আস্ছে। চলার তালে তালে ছড়া বল্ছে। উড়ে বাহকদের ছড়াগুলি কি অদ্ভুত! তা হোক্ না—পদ্যে ধরা যাক্।
হুঁই দাব্ড়ে
হুঁই দাব্ড়ে হুকুম্ দাব্ড়ে,
বাপ্ আজ্ কি রোদের তাপ্ রে
চল্ ভাইয়া কিসের ভয় রে?
বল ভাইয়া― মোদের জয় রে।

চল্ আজ্কে তুরগ্ ছন্দে
নয় নাম্বে আঁধার সন্ধ্যে।
পথ্ মস্ত অনেক দীর্ঘ
ফ্যাল ফ্যাল্ রে চরণ শীঘ্র।
রোয় বউটি কপাল্ চাপ্ড়ে।
হুঁই দাব্ড়ে হুকুম দাব্ড়ে।
—“হাম্বা”—
বুধী গাইটার বাছুরটা অমন স্বরে ডাক্ছে কেন? নিশ্চয়ই খুব তেষ্টা পেয়েছে,—‘ওরে পট্লা শীগ্গির এক বাল্তী জল নিয়ে আয় তো!’—এই সুযোগে একটা ছন্দ করে ফ্যালা যাক্।
হাম্বা হাম্বা
হাম্বা হাম্বা
ডাক্ছে বাচ্চা।
ঝ’রছে ঘাম্ বা।
শোন্ রে শোন্ রে
যায় রে প্রাণ্ বা।
হাম্বা—হাম্বা।
তেঁতুল গাছে শীতল বাতাসের মাতামাতি! হঠাৎ গাছের উপর—“কোয়াক্ কোয়াক্ কোয়াক্।” কে বাপু তুমি! নাম নেই ধাম্, নেই—হঠাৎ বাজখাঁই আলাপ্। তোমার সুরের ছন্দটা মন্দ নয়—এসো ছন্দে তোমার সঙ্গে আলাপ্ করা যা’ক্।
কোয়াক্ কোয়াক্ কোয়াক্
কোয়াক্ কোয়াক্ কোয়াক্,
নীরব নিঝুম্ দুপুর,
হঠাৎ গাছের উপুর
জানাও প্রাণের সোহাগ্—
কোয়াক্ কোয়াক্ কোয়াক্।
ভারী সুন্দর এই ঘুঘুর ডাক্টা। সুরে প্রাণ উদাস্ করে’ দ্যায়। ঐ কান পেতে শোনো-দূরের ঝোপ্টাতে এক টানা সুরে ডেকে যাচ্ছে বিরাম নেই—বিশ্রাম নেই—“ঘুঘু-ঘু”; এমন একটা ডাক ছন্দে ধরব না!—
ঘুঘু—ঘু
ঘুঘু—ঘু
ঘুঘু—ঘু
সারা—ভূ
শুধু—যে

ধূধূ―রে,
উহু―হু
ঘুঘু―ঘু।
ঘোষেদের ছোট মেয়ে মালতী তার সই টেঁপীর বাড়ী চলেছে পুতুল খেল্তে। পায়ের ঘুমুর বেশ মিঠে বাজ্ছে কিন্তু। ছন্দে ধরব না কি?
ঝুম্ ঝুম্ ঝুমুর
ঝুম্ ঝুম্―ঝুমুর
বাজ্ বাজ্—ঘুমুর!
ওই তান্ —মধুর
শোন্ শোন্—অদূর;
পায় পায়—খুকুর
বাজ্ সাঁঝ্—দুপুর।
বেলা পড়ে এসেছে,—দূর দিগন্তে দিনের চিতা জ্বলে উঠলো, ওপারের শালবন হয়ে এলো ঝাপসা,—সন্ধ্যা নামে নামে। আজ এই সন্ধ্যার অন্ধকারে ছন্দের খেই হারিয়ে ফেল্লাম, তাই এই প্রবন্ধ এই খানেই শেষ করতে বাধ্য।

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন