আমাদের দেশে ছড়ার তো ছড়াছড়ি। ঘুম্-পাড়ানী ছড়া, ছেলে-ভুলানো ছড়া, খেলাধুলার ছড়া, ব্রত-পার্ব্বণের ছড়া—— আরো কত যে ছড়া আছে, তার আর শেষ নাই। সেই ছেলে বেলায় মা দিদিমার মুখে যে সব মিষ্টি ছড়া শুনেছি—এখনো যেন তা মধুর মত কাণে লেগে আছে,—প্রাণে বেজে আছে। সে সব ছড়া শুনতে শুনতে কখনো মন উধাও হয়ে ছুটে চলে যেত সাত সমুদ্দুর তের নদী পার হয়ে কোন্ এক কঙ্কাবতী রাজকন্যার দেশে,—কখনো চোখের সামনে ভেসে উঠ্ত তেপান্তরের সীমাহীন ধূ-ধূ মাঠ—রাজপুত্তুর ঘোড়ায় চ’ড়ে টগ্বগিয়ে ছুটে চলেছেন, গজমোতির মালা তাঁর বুকে দুলছে —কখনো ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর ডাক স্পষ্ট যেন কাণে শুন্তে পেতাম। মনে হয় আবার সেই অতীত ছেলেবেলার যুগে ফিরে যাই—আবার সেই মায়ের মুখের মিষ্টি সুরের মধুর ছড়া শুন্তে শুন্তে ঘুমিয়ে পড়ি—আবার সেই সব আজব রঙ্গীন্ কল্পনায় বুঁদ হ’য়ে থাকি। কিন্তু দুঃখ করে আর কি হবে, তা’ তো আর হবার নয়!
অর্থ খুঁজ্তে গেলে হয়তো অনেক ছড়ার কোন যুক্তিপূর্ণ মানেই খুঁজে পাওয়া যাবে না—কিন্তু তাদের প্রতি ছত্রে যেন স্বর্গের অমৃত ঝরে’ পড়ছে। বাংলার বাইরে আমি অনেক জায়গায় ঘুরেছি, নানান্ জায়গার ছড়া শুনে আমার ধারণা হয়েছে—কি ভাবে, কি মাধুর্য্যে, কি সুরের মিষ্টতায়, বাংলার ছড়ার থেকে তারা কিছু মাত্র কম নয়। আমি কয়েকটি সাঁওতালী ও বিহারী ছড়ার বাংলা ভাবানুবাদ করেছিলাম। শিল্পাচার্য্য শ্রীযুক্ত অবনীন্দ্র নাথ ঠাকুর মহাশয় এ-বিষয় আমাকে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছেন।
আজ তোমাদের কয়েকটি বিদেশী (ইয়োরোপায়) ছড়ার নমুনা উপহার দিলাম। কবিতাগুলি কিন্তু ঠিক অনুবাদ নয়, ভাবানুবাদ। সম্পূর্ণ বাংলা ছাঁদে গড়লেও মূল ভাব বজায় আছে। এ সব ছড়াগুলি কিন্তু অর্থহীন নয়। ওদের দেশে এগুলিকে বলে ‘Nursery Rhyme’। মায়েরা ছোট ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়াতে পাড়াতে সুর ক’রে এ সব গান করেন,— ঠাকুর্দ্দারা নাতি-নাতিনীদের নিয়ে এসব ছড়া কেটে রসিকতা করেন। এগুলি ওদের দেশে খুব চল্তি।
এক বুড়ীর গল্প শোন:—
এক যে ছিল বুড়ী,
খুব ছিল থুত্থুরি,
তার ছিল তিন ছেলে
হিরু, বীরু, ধীরু,—

হিরু গেল কাশীতে, মর্ল সেথা ফাঁসিতে;
বারু গেল পুকুরে, মর্ল ডুবে দুপুরে;
বন জঙ্গল ছাড়িয়ে ধীরু গেল হারিয়ে।
বাড়্লো বুড়ীর শোক;
ঝাপ্সা হোলো চোখ্,
তিন ছেলে আর রইল না তার
হিরু, বারু, ধীরু॥
আহা, বুড়ীর দুঃখে আর্ত পাষণ্ডের চোখেও জল আসে। এইবার শোনো কালা-বুড়োর কথা:—
খোকা—বুড়ো বুড়ো তুমি আমায় পয়সা দেবে ধার!
বুড়ো— কি বল্ছ, বুঝ্ছি না ছাই—কাণ কালা আমার।
খোকা—বুড়ো বুড়ো— আমার বাড়ী তোমার নিমন্ত্রণ।
বুড়ো—হ্যা হ্যা হ্যা চল চল, সোণার যাদু-ধন।
কেমন মজার কালা বলতো?
পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা সাঁতার কাট্তে চলেছে, ছোট খুকুরও হয়েছে তাই সাধ। মার হুকুম ছাড়া তো তার যাবার উপায় নেই। মাও তাকে দুঃখ দিতে রাজী ন’ন।
“মাগো আমি সাঁতার কাটি গিয়ে?
তুমি কিছু মনে ভেবো না!”
“যাও গো বাছা জুতো মোজা খুলে,
খুব হুঁসিয়ার, জলে নেবো না।”
গাছের উপর সবুজ টিয়ে দেখে পোকা ছুঁড়ে মেরেছে তার দিকে এয়া এক ঢিল। কিন্তু খোকার হাতের টিপ কেমন তা সে নিজেই তোমাদের বলছে―
“গাছের উপর সবুজ টিয়ে,
তাক্ করেছি তাকে,—
ফস্কে গিয়ে ঢিলটি লাগে
ঠাকুর্দ্দাদার টাকে।”
এইবার শোনো এক আশ্চর্য ঘটনা—
দেখে এসো ও-পাড়ায় তিন মেয়ে থাকে,
কাণ দিয়ে শোনে তাই,
মুখে কথা বলে, ভাই
হাস্ছ কি,—নিশ্বাস নেয় তারা নাকে।”
কেমন মজার নয়! তোমাদের ভিতর এ রকম অদ্ভুত মেয়ে কেউ আছ নাকি! এইবার জোর ক’রে গল্প বলার ধরণ শোনো:—
“গল্প বলি, গল্প বলি,—
তোমরা শোনো মন দিয়ে,
ওকি, কোথায় পালাও বাপু,
না শোন্বার ফন্দি এ।
শোনো,—ছিল একটি মেয়ে,
একটি ছেলে দুরম্ভ,
তাদের ছিল মেনী বেড়াল,
একটা পাখী উড়ন্ত।
এই মরেছে,—যেই করেছি
গল্প সুরু, অম্নি ভাই,
গল্পটা ছাই ঘুলিয়ে গেল,
কাজেই এখন বিদায় চাই।”
আর সঙ্গে সঙ্গে আমিও আজ তোমাদের কাছ থেকে বিদায় চাইছি।

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন