সুনির্মল বসু

গল্প - মিল ও ছন্দ

সুনির্মল বসু | ছন্দের টুং টাং
বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫ ছোটদের

কবিতা লিখ‍্তে যেমন ছন্দের দরকার, মিলের দরকার ঠিক ততখানিই। খুব সুন্দর ছন্দের আর গভীর ভাবের কবিতাতেও যদি মিলের দোষ থাকে তবে তা’ ঠুটো-কার্ত্তিকের মতোই অশোভন হ’বে। খারাপ মিলের সুছন্দ-কবিতা ঠিক পরমা-সুন্দরী রাজকুমারী—যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চল্‌ছেন, সুরূপা নর্ত্তকীর অপরূপ নাচে যেন নূপুর ঠিক মতো বাজ‍্ছে না। কাজে কাজেই ভালো কবিতার প্রধান অঙ্গ যেমন ছন্দ, তেমনি ভালো মিলও অবশ্য দরকার। ওস্তাদের বীণার ঝঙ্কারের সঙ্গে পাখোয়াজের বোল্ ঠিক সমান তালেই চলা দরকার, না হলে রসিক শ্রোতা সভা ছেড়ে চলে আসবেন।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে—ভালো ‘মিল’ কাকে বলে! দুই একটা উদাহরণ দিলেই তোমরা কিছুটা বুঝ‍্তে পারবে হয় তো। দুই একজন প্রাচীন গ্রাম্য কবির কবিতা দিয়ে দৃষ্টান্ত দেই:—
“শীতে ভাজি মুড়ি খই,
গর্ম্মি-কালে ঘোল মই,
বার মাস ভিঁয়াই সন্দেশে,
খাইতে ভোলার গোল্লা
ফিরিঙ্গী এণ্টনী মোল্লা
হল্লা করে’ তাল্লা দিয়ে বসে।”

এখানে “খই” “মই” আর “গোল্লা” “মোল্লা”র মিল বেশ ভালো হয়েছে। কিন্তু “সন্দেশে” আর “বসে” এই দুটো শব্দের ‘মিল’ হলেও ভালো ‘মিল’ হয় নি কিছুতেই। “সন্দেশে”র “দেশে”র সঙ্গে “বসে” কথাটার মিল না হ’য়ে “এসে” “শেষে” “হেসে” এই রকম কিছু মিল হওয়া উচিত ছিল। কারণ “সন্দেশে” কথাটার মধ্যে আমরা মিল পাচ্ছি ‘এশে’ (সন্দ্+এশে) আর ‘বসে’ কথাটাতে পাচ্ছি ‘অসে’ (ব্+অসে), কাজে কাজেই “এশে”র সঙ্গে “অসে”র মিল কোনো রকমেই যুক্তি-যুক্ত নয়। আর একটা উদাহরণ নেওয়া যাক্:—

“ত্রিভঙ্গ হইয়ে বাঁশীটি বাজায়ে
বসিয়া কদম্ব-মূলে—
রাধা রাধা বলে’ ডাকিতে ডাকিতে
আসিব যমুনা-জলে।”

এখানেও আমরা “মূলে”র সঙ্গে “জলে”র মিল পাচ্ছি। প্রাচীন কবিটির যদি ভালো. মিল-জ্ঞান থাক্‌তো তবে তিনি “মূলে”র সঙ্গে অনায়াসেই এখানে “কূলে” কথাটা বসিয়ে মিল বজায় রাখতে পারতেন।

আজকালকার ভালো লেখকদের কবিতায় তোমরা রাশি রাশি ভালো ‘মিল’ দেখ‍্তে পাবে। যিনি ছন্দ আর ভাব বজায় রেখে মিলের যত বাহাদুরী দেখাতে পারেন—তিনি রসিক সমাজে হাততালি পান তত বেশী।

অনেক ছেলেমেয়ে আমাকে প্রশ্ন করেছে—কবিতা লিখ‍্তে অক্ষর গুণ‍্তে হয় নাকি! তার উত্তরে আমি বলি-কবিদের অক্ষর গুণ‍্তে হয় না। জ্যোৎস্না যেমন চাঁদ ছুঁয়ে নেমে আসে,—কবিতাও তেমনি কবির ভাবুক-হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসে অমিয়-নির্ঝরের মত—পাথীর সহজ গানের মত। মিল তাঁকে আপনি ধরা দেয়। ছন্দ ঠিক রাখ‍্তে কাণের দরকার সবচেয়ে বেশী।

ছন্দ ঠিক হলেই অক্ষরও ঠিক হয়। তবে ঠিক আঠারো অক্ষরের নীচে ঠিক আঠারো অক্ষরই যে বস‍্বে তার কোনো মানে নেই। বইখানির প্রথম প্রবন্ধের থেকে একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক্:—

পুরী মিঠাই
ভাবেন্ কি ছাই,—

এখানে “পুরী মিঠাই” পাঁচ অক্ষর; আর “ভাবেন কি ছাই” ছয় অক্ষর। তাতে ছন্দের কোনো গোলোযোগ হয় নি। কারণ “ন”এ হসন্ত আছে বলে “ন” টা পূরোপুরি উচ্চারণ হচ্ছে না—সামান্য একটু আভাস পাওয়া যাচ্ছে মাত্র। কিন্তু “ন” অক্ষরটা যদি ওখানে পূর্ণ উচ্চারণ হোত তা হলেই ছন্দের গোলমাল্ বেধে যেত। সাঁওতালী ছন্দের একটা উদাহরণ:—

আটার রুটী নাই পেলাম
ভুট্টাদানা নাই খেলাম—!

উপরে আছে দশ অক্ষর, নীচে আছে নয় অক্ষর। কিন্তু ছন্দ পতন হয় নি। “ভুট্টা” কথাটা হচ্ছে “ভুট্‌-টা”।
অক্ষর নিয়ে সব সময় মারামারি কর‍্লে চলে না। বড় বড় নাম-জাদা কবিদের এমন লেখা তোমরা আজকাল ঢের পাবে যার প্রথম লাইনে হয়তো দুই অক্ষর, তার নীচেই হয়তো বত্রিশ অক্ষর, আবার তার নীচে দশ অক্ষর—এই রকম স্বেচ্ছাচারিতা অথচ ছন্দ-পতন হয় নি। কারণ ওগুলি “অ-সম” ছন্দ। এরকম ছন্দের নমুনা তোমরা আজকালকার কাগজে ঢের পাবে, তাই আর তার নমুনা এখানে দিলাম না!

অনেক বিদেশী ছন্দ আজকাল বাংলা-সাহিত্যকে সম্পদশালী করছে। এই সব ছন্দকে নিজের করে’ নেওয়ায় এক দিকে যেমন আনন্দ আর অন্যদিকে তেমনি গৌরব। অবশ্য এই নিজের করে’ নেওয়াটাতে খুব বড় ওস্তাদের হাত দরকার। খুব পাকা ওস্তাদের হাতেই বিদেশী ময়ূর নাচ‍্তে পারে, বিদেশী বুলবুল্ গান গাইতে পারে।

বিদেশী ছন্দের উদাহরণ কয়েকটা আমি আগেই দিয়েছি; এখানেও আর দুই-একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে প্রবন্ধ শেষ করি। ইংরাজী ঘুমপাড়ানী ছন্দের একটা নমুনা দেখ:—

“Hush a— bye, ba-by, on the tree-top”
আস্তে— ভাই, খু-কু, ওই যে ঘুম যায়
উচ্চ— গাছ্, তা-তে, দোল‍্না দোল্ খায়,
ভাঙ‍্‌বে— ডাল, আ-হা, বইলে জোর বায়,
পড়‍্বে— হায়, খু-কু, লাগ‍্‌বে তার গায়।
‘ছন্দ-হিল্লোল’ প্রবন্ধে যে “ঝিনিক ঝিন্ ঝিন্” ছন্দটা আছে ওটা আরবী “হজ্ য” ছন্দের অনুরূপ!

৩ ২ ২
ঝিনিক্ ঝিন্ ঝিন্
ফুরায় ক্ষীণ্ দিন।
প্রতি তৃতীয় অক্ষরে, পঞ্চম অক্ষরে আর সপ্তম অক্ষরে হসন্ত পড়‍্ছে। এই হসন্তের একটু গোলযোগ হলেই ‘হজ‍্ যে’র আরবী নাচ থেমে যাবে। ধর এখানে যদি এরকম হয়:

ঝিনিক্ ঝিন্ ঝিন্—
ফুরায় ছোট দিন্,

এখানে অক্ষর ঠিক আছে, ছন্দেরও কোনো গোলমাল নেই, কিন্তু দ্বিতীয় লাইনে “ছোট” শব্দে “ট” কথাটা পূরো উচ্চারণ হচ্ছে বলে’ “হজয” হিসাবে ছন্দ-পতন হোলো। “ক্যাঁচোর কুর্ কুর্” ছন্দটাও “হজয”। এখানেও ঠিক আগের নিয়মই খাট্‌ছে। ছন্দ-হিল্লোল প্রবন্ধে।—
৩ ২ ৩ ২
ছলাৎ ছল্ ছলাৎ ছল্
অধীর আজ্ নদীর জল,—
এই কবিতাটিও আরবী ছন্দের, তবে এটাতে সংস্কৃত “ভুজঙ্গ-প্রয়াত” ছন্দেরও কিছু আভাস পাওয়া যায়। এর প্রত্যেক লাইনে তৃতীয় অক্ষর, পঞ্চম অক্ষর, অষ্টম অক্ষর আর দশম অক্ষরে হসন্ত পড়‍্ছে। এই ছন্দের একটা নতুন উদাহরণ দিয়ে আজ তোমাদের কাছে বিদায় চাই:—

তোদের্ প্রাণ্ সুখের হোক্
নতুন গান্ মুখেই রোক্,—
নতুন গান্ নতুন প্রাণ্
দেখুক ভাই সকল লোক্‌।
মধুর দিন সুমঙ্গল্
কবির প্রাণ্ সুচঞ্চল,—
আশিস্ তাই তোদের ভাই
জানায় আজ সুনির্ম্মল!
কবিতা সম্বন্ধে অনেক কিছু জানবার আছে, তবে একসঙ্গে সব বলতে গেলে তোমরা সব গোলমাল করে’ ফেলবে। তবে মোটামুটি এখন এইটুকু জানলেই চলবে।

পরে পড়বো
১৯
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন