দিনগুলি রাতগুলি (রচনা ১৯৪৯-৫৫। প্রকাশ ১৯৫৬)
দিনগুলি রাতগুলি
[ইভাকে]
৭ জানুয়ারি। রাত্রি
হে আমার সুনিবিড় তমস্বিনী ঘনভার রাত্রি, আমাকে হানো।
ঐ তার আলুলায়িত বেদনার কালো, তারই চুপে দীর্ঘকাল এ আমার স্নান,
বন্ধমোহ গতশ্বাস আলুথালু বাঁচা–
কী লাভ কী লাভ তাকে অবিশ্রাম ক্লীবত্বের জ্বালাময় দৈন্যে পুঞ্জ ক’রে?
কিংবা তাকে মহত্ত্বের শিখরে ছুটিয়ে নিয়ে অবশেষে নির্বাধ প্রপাতে
অন্তহীন অন্তহীন অন্ধকারে বিসর্জন ক’রে
কী লাভ কী লাভ?
তাই
এমন আকাশ হবে তোমার চোখের মতো ভাষাহীন নির্বাক পাথর, দৃষ্টি তার স্থির
হবে মৃতের প্রাণের মতো উদাসীন নির্মম শীতল, তুমি আছো সর্বময় রাত্রির গহনে
মিশে আমি এক ক্লান্তির কফিনে, তুমি যদি মৃত্যু আনো অবসাদে মূক আর কঠিন
কুটিল রাত্রি জুড়ে–
হে আমার তমস্বিনী মর্মরিত রাত্ৰিময় মালা,
মৃত্যুফুলে বেদনার প্রাণদাহী ফুলে ফুলে হে আমার উদাসীন মালা,
আমার জীবন তুমি জর্জরিত করো এই দিনে রাত্রে দুপুরে বিকেলে
এবং আমাকে বলল, ‘মাটির প্রবল বুকে মিশে যাও তৃণের মতন’:
আমি হব তাই
তৃণময় শান্তি হব আমি।
৮ জানুয়ারি। সকাল
ধীরে, আরো ধীরে সূর্য। উঠো না উঠো না। আবার প্রভাত হলে পৃথিবী
উন্মুখ হবে, রৌদ্র হবে ব্যাধের মতন। আমাকে হানবে তারা বড়ো!
তার চেয়ে তমস্বিনী রাত্রি ভালো আজ, তামসীরে মেরো না মেরো না–
ধীরে, আরো ধীরে সূর্য। উঠো না উঠো না।
৮ জানুয়ারি। দুপুর।
হাহাতপ্ত জ্বালাবাষ্প দিনের শিয়রে কাঁপে হৃদয় আমার।
আকাশ, প্রসন্ন হও। রৌদ্রহর মেঘে মেঘে ঝাঁকালো করো দিগঞ্চল- দীর্ঘ
করো তামসগুণ্ঠন। আমাকে আবৃত করা ছায়াস্তৃত একখানি ধূসর-বাতাস-
ঢালা অকরুণ আলোর মালায়,
আমাকে গোপন করো তুমি।
.
৮ জানুয়ারি। রাত্রি
আকাক্ষা উন্মত্ত হয়, প্রেমের বিষাণে তারা ছুটে ছুটে মাথা কুটে মরে, ভয়ে
কাঁপে দূর-দূরান্তর।
কত বলি, কত ভালোবেসে মৃদু স্বরে-সুরে বলি তাকে, রে দুরন্ত চোখ, স্পর্শ
তাকে কোরো না কোরো না। সে তবু শোনে না। বারংবার ঘুরে ঘুরে একই
বৃত্তে অন্তহীন সে পেয়েছে শুধু একখানি
অবসন্ন দীন ছায়ামাখা ভারি কৃপণ আকাশ
সেই তার ভালো।
কত বলি, শোনো তুমি অবকাশহারা গুঢ় ব্যথায় আরক্ত-চিত্ত, শোনো। লজ্জার
আনীল বিষে মুখ তুমি ঢেকো না ঢেকো না। সে তবু শোনে না। বারংবার ঘুরে
ঘুরে একই বৃত্তে অবিরাম সে এনেছে একখানি শুধু
যন্ত্রণার ডালা।
সেই তার ভালো।
৯ জানুয়ারি। সকাল।
‘এখানে ঘুমায় এক মানবহৃদয়, তার জলে লেখা নাম।’
কবিদেব, কেবল বেদনা- আহা কেবল বেদনা বুঝি ভালোবাসে তোমার হৃদয়!
মাটির শীতল স্পর্শে অবিরাম অবিরাম কবর কামনা করো তাই? কতদিন
মুঠো মুঠো এমন প্রভাত তুমি ধরেছ কিশোর? কতদিন সূর্য থেকে মাটি থেকে
শূন্য থেকে ধরেছ আকুল মনোভারে
একখানি শিথিল প্রণয়?
অবশেষে একদিন জলে-লেখা-নাম কবি মাটির বাসরে ঘুম রচে।
কবি তুমি যেয়ো না যেয়ো না
বেদনার শাদা ফুলে আকাশ নিবিড় হবে, অবকাশে ভরে যাবে প্রাণ। অবশ
বিরামভরা এ পদচারণা তার পুঞ্জ হবে ভাষার আলোকে। আকুঞ্চিত দুটি হাতে
আঙুলে আঙুলে তুমি টেনে নেবে গান–
অবশেষে থরে থরে কথার কাকলি তুলে বীথিকুঞ্জ সাজাবে প্রণয়ী, উচ্চকিত
পৃথিবীর দুর্বার প্রতাপ তুচ্ছ করে, কবিতার লেখে-লেখে সুন্দর-আশ্লেষ-ধন্য
মেঘকুঞ্জ কথার প্রণয়ী
রাত্রির আবেশে মগ্ন হবে–
তবু সে প্রেমের রাত্রি তার!
কবি তুমি যেয়ো না যেয়ো না।
.
১১ জানুয়ারি। দুপুর
সুন্দর কবিতা সখী!
যখন বিষণ্ণ তাপে প্রধূম গোধুলি তার করুণাবসন ফেলে সূর্যমুখী পৃথিবীকে ঢাকে,
কঠিন বিলাপে কাপে উপশিরা-শিরা, জ্যোতিষ্কলোকের রূপসীরা একে একে
ছিন্ন করে দয়িত-আকাশ, যখন প্রেমের সত্য ভুবনে ভুবনে ফেরে করুণ লেখায়,
তুমিও আসন্ন চন্দ্রে মেলে দাও হৃদয় তোমার, আমি থরোথরো শীতে যন্ত্রণার
শিখা মেলি আতপ-ত্যিক, যখন পৃথিবী কাপে মৃততেজা মুঠোতে আমার
তখন কবিতা মিতা, প্রিয় থেকে প্রিয় সখী, সুহৃদ, সুন্দর!
জলের ডালায় যদি হৃদয় প্রসার করি, তোমারই বিকাশ।
মেঘের গুহায় ঢালি হৃদয় যখন, দেখি তোমারই বিকাশ।
কুয়াশা-উথাল জটা দিক দিক ভরে যদি, তোমারই বিকাশ।
স্মরণ যেখানে, প্রাণ যেখানেই, সেখানেই তোমার বিকাশ।
তখন কবিতা মিতা প্রিয় থেকে প্রিয় সখী সুহৃদ সুন্দর!
কবি রে, তোর শূন্য হাতে
আকাশ হবে পূর্ণ–
উদাস পাগল গভীর সুরে
ডাক দে তারে ডাক দে!
ভাঙতে কাঁকন, ছিঁড়তে বাঁধন কু
লোয় না তার সাধ্যে
কবি রে, আজ প্রেমের মালায়
ঢেকে নে তোর দৈন্য!
বহো রে আলোর মালা অবশা রাত্রি ঘিরে
মেঘের ওই আকাশ ছিঁড়ে ঝরে রে বেদন-সুরা
কবিতা কল্পলতা আকুলা চঞ্চলতা
বাঁধে রে যন্ত্রণা তার বাঁধে সে তমস্বিনী।।
বহো রে আলোর মালা গগনে দাও ছড়িয়ে
দহনে দগ্ধ ক’রে হৃদয়ে ঝিলিক করো–
মেঘে কে জাগছ তুমি জাগো কে শূন্যপুরে?
কবিতা সূর্যলতা হৃদয়ে চক্ষে জ্বলে।।
বহো রে আলোর মালা তামসী কণ্ঠ জুড়ে–
তবু কে কাঁদছে সুরে? কবি কি নিত্য কাঁদে?
কবি সে, নিত্য কাঁদে আকাশে নিত্য বেদন
বহো রে আলোর মালা ছেঁড়ো রে কালোর বাঁধন।।
১২ জানুয়ারি। রাত্রি
বাসনা-বিদ্যুতে তুমি ছিন্ন করো চরিত্রের মেঘ। প্রভূত-আবেগ-পুঞ্জ চেতনার বৃষ্টি করো আলুথালু প্রকৃতির মুখে। রজনী শাঙন-ঘন, জীবন ময়ূর, দুঃখ কাপে দুর্বল দারুণ।
প্রেমের বিকীর্ণ শাখা ফুলে-ফলে জ্বলে। জেগে ওঠে ধীরে ধীরে একখানি তপ্তহত পরিপূর্ণ মুখ। রাত্রির কলস ভেঙে প্রভাত গড়ায় দিকে দিকে।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন