রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কবিতা - অরণ্যে অৰ্জ্জুন (চিত্রাঙ্গদা)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অৰ্জ্জুন

আমি যেন পাইয়াছি, প্রভাতে জাগিয়া
ঘুম হ’তে, স্বপ্নলব্ধ অমূল্য রতন।
রাখিবার স্থান তা’র নাহি এ ধরার
মৃত্তিকায়; ধরে’ রাখে এমন কিরীট
নাই, গেঁথে’ রাখে হেন সূত্র নাই, ফেলে’
যাই হেন নরাধম নহি; তা’রে ল’য়ে
চিররাত্রি চিরদিন ক্ষত্রিয়ের বাহু
বন্ধ হ’য়ে পড়ে’ আছে কর্ত্তব্যবিহীন।

( চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ)

চিত্রাঙ্গদা

কি ভাবিছ?

অৰ্জ্জুন

ভাবিতেছি মৃগয়ার কথা।
ওই দেখ বৃষ্টিধারা আসিয়াছে নেমে
পর্ব্বতের পরে; অরণ্যেতে ঘনঘাের
ছায়া; নির্ঝরিণী উঠেছে দুরন্ত হ’য়ে,
কলগর্ব্ব-উপহাসে তটের তর্জ্জন
করিতেছে অবহেলা; মনে পড়িতেছে
এমনি বর্ষার দিনে, পঞ্চভ্রাতা মিলে

{
চিত্রক অরণ্যতলে যেতেম শিকারে।
সারাদিন রৌদ্রহীন স্নিগ্ধ অন্ধকারে
কাটিত উৎসাহে; গুরু গুরু মেঘমন্দ্রে
নৃত্য করি’ উঠিত হৃদয়; ঝরঝর
বৃষ্টিজলে, মুখর নির্ঝরকলোল্লাসে
সাবধান পদশব্দ শুনিতে পেত না
মৃগ; চিত্রব্যাঘ্র পঞ্চনখচিহ্নরেখা
রেখে যেত পথপঙ্কপরে, দিয়ে যেত
আপনার গৃহের সন্ধান। কেকারবে
ধ্বনিত’ অরণ্যভূমি। শিকার সমাধা
হ’লে পঞ্চসঙ্গী পণ করি’ সন্তরণে
হইতাম পার, বর্ষার সৌভাগ্যগর্ব্বে
স্ফীত তরঙ্গিণী। সেই মত বাহিরিব
মৃগয়ায়, করিয়াছি মনে।

চিত্রাঙ্গদা

হে শিকারি,
যে মৃগয়া আরম্ভ করেছ, আগে তাই
হােক্ শেষ। তবে কি জেনেছ স্থির
এই স্বর্ণ মায়ামৃগ তােমারে দিয়েছে
ধরা? নহে, তাহা নহে। এ বন্য-হরিণী
আপনি রাখিতে নারে আপনারে ধরি’!
চকিতে ছুটিয়া যায় কে জানে কখন

স্বপনের মত। ক্ষণিকের খেলা সহে,
চিরদিবসের পাশ বহিতে পারে না।
ওই চেয়ে দেখ, যেমন করিছে খেলা
বায়ুতে বৃষ্টিতে,—শ্যাম বর্ষা হানিতেছে
নিমেষে সহস্র শর বায়ুপৃষ্ঠপরে,
তবু সে দুরন্ত মৃগ মাতিয়া বেড়ায়
অক্ষত অজেয়;—তােমাতে আমাতে, নাথ,
সেই মত খেলা, আজি বরষার দিনে;—
চঞ্চলারে করিবে শিকার প্রাণপণ
করি’; যত শর, যত অস্ত্র আছে তূণে
একাগ্র আগ্রহভরে করিবে বর্ষণ।
কভু অন্ধকার, কভু বা চকিত আলো
চমকিয়া হাসিয়া মিলায়, কভু স্নিগ্ধ
বৃষ্টিবরিষণ, কভু দীপ্ত বজ্রজ্বালা।
মায়ামৃগী ছুটিয়া বেড়ায়, মেঘাচ্ছন্ন
জগতের মাঝে, বাধাহীন চিরদিন।

২৪
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন