নিভৃত যমুনা তীরে, বসিয়া রয়েছে কিরে
কমলা নীরদ দুই জনে?
যেন দোঁহে জ্ঞান হত—নীরব চিত্রের মত
দোঁহে দোঁহা হেরে এক মনে।
দেখিতে দেখিতে কেন-অবশ পাষাণ হেন
চখের পলক নাহি পড়ে।
শােণিত না চলে বুকে, কথাটি না ফুটে মুখে
চুলটিও না নড়ে না চড়ে!
মুখ ফিরাইল বালা, দেখিল জ্যোছনা মালা
খসিয়া পড়িছে নীল যমুনার নীরে—
অস্ফুট কল্লোল স্বর, উঠিছে আকাশ পর
অর্পিয়া গভীর ভাব রজনী গভীরে!
দেখিছে লুটায় ঢেউ, আবার লুটায়
দিগন্তে খেলায়ে পুনঃ দিগন্তে মিলায়।
দেখে শূন্য নেত্রতুলি—খণ্ডখণ্ড মেঘগুলি
জ্যোছনা মাখিয়া গায়ে উড়ে উড়ে যায়।
এক খণ্ড উড়ে যায় আর খণ্ড আসে
ঢাকিয়া চাঁদের ভাতি-মলিন করিয়া রাতী
মলিন করিয়া দিয়া সুনীল আকাশে।
পাখী এক গেল উড়ে নীল নভোতলে,
ফেন খণ্ড গেল ভেসে নীল নদী জলে,
দিবা ভাবি, অতিদূরে আকাশ সুধায় পুরে
ডাকিয়া উঠিল এক প্রমুগ্ধ পাপীয়া।
পিউ, পিউ, শূন্যে ছুটে উচ্চ হতে উচ্চে উঠে
আকাশ সে সূক্ষ্ম স্বরে উঠিল কঁপিয়া।
বসিয়া গণিল বালা কত ঢেউ করে খেলা
কত ঢেউ দিগন্তের আকাশে মিলায়
কত ফেন করি খেলা লুটায়ে চুম্বিছে বালা
আবার তরঙ্গে চড়ি সুদূরে পলায়।
দেখি দেখি থাকি থাকি আবার ফিরায়ে আঁখি
নীরদের মুখ পানে চাহিল সহসা—
আধেক মুদিত নেত্র—অবশ পলক পত্র
অপূর্ব্ব মধুর ভাবে বালিকা বিবশা!
নীরদ ক্ষণেক পরে উঠে চমকিয়া,
অপূর্ব্ব স্বপন হতে জাগিল যেন সে।
দূরেতে সরিয়া গিয়া—থাকিয়া থাকিয়া
বালিকার সম্বােধিয় কহে মৃদু স্বরে।
“সেকি কথা শুধাইছ বিপিন-রমণী!
ভাল বাসি কিনা আমি তােমারে কমলে?
পৃথিবী হাসিয়া যে লাে উঠিবে এখনি!
কলঙ্ক রমণী নামে রটিবে তা হ’লে?
ওকথা শুধাতে আছে? ওকথা ভাবিতে আছে?
ওসব কি স্থান দিতে আছে মনে মনে?
বিজয় তোমার স্বামী বিজয়ের পত্নী তুমি
সরলে! ওকথা তবে শুধাও কেমনে?
তবুও শুধাও যদি দিব না উত্তর!—
হৃদয়ে যা লিখা আছে দেখাবােনা কারো কাছে
হৃদয়ে লুকান রবে আমরণ কাল!
রুদ্ধ অগ্নি রাশিসম দহিবে হৃদয় মম
ছিড়িয়া খুঁড়িয়া যাবে হৃদি-গ্রন্থিজাল।
যদি ইচ্ছা হয় তবে, লীলাসমাপিয়া ভবে
শােণিত ধারায় তাহা করিব নির্ব্বাণ।
নহে অগ্নি-শৈলসম—জ্বলিবে হৃদয় মম
যত দিন দেহ মাঝে রহিবেক প্রাণ!
যে তােমারে বন হতে এনেছে উদ্ধারি,
যাহারে করেছ তুমি পাণি সমর্পণ,
প্রণয় প্রার্থনা তুমি করিও তাহারি—
তারে দিও যাহা তুমি বলিবে আপন!
চাইনা বাসিতে ভাল, ভাল বাসিব না!
দেবতার কাছে এই করিব প্রার্থনা—
বিবাহ করেছ যারে, সুখে থাক লয়ে তারে
বিধাতা মিটান তব সুখের কামনা!”
“বিবাহ কাহারে বলে জানিনা তা আমি”
কহিল কমলা তবে বিপিন-কামিনী!
“কারে বলে পত্নী আর কারে বলে স্বামী—
কারে বলে ভাল বাসা আজিও শিখিনী।
এই টুকু জানি শুধু এই টুকু জানি,
দেখিবারে আঁখি মাের ভাল বাসে যারে
শুনিতে বাসি গো ভাল যার সুধা বাণী—
শুনিব তাহার কথা দেখিব তাহারে!
ইহাতে পৃথিবী যদি কলঙ্ক রটায়
ইহাতে হাসিয়া যদি উঠে সব ধরা
বল গো নীরদ আমি কি করিব তার?
রটায়ে কলঙ্ক তবে হাসুক না তারা।
বিবাহ কাহারে বলে জানিতে চাহি না—
তাহারে বাসিব ভাল, ভাল বাসি যারে!
তাহারই ভাল বাসা করিব কামনা
যে মোরে বাসে না ভাল ভাল বাসি যারে।”
নীরদ অবাক রহি কিছুক্ষণ পরে
বালিকারে সম্বোধিয়া কহে মৃদুস্বরে,
“সে কি কথা বল বালা যেজন তোমারে
বিজন কানন হতে করিয়া উদ্ধার
আনিল রাখিল যত্নে সুখের আগারে—
সে কেন গো ভালবাসা পাবেনা তোমার?
হৃদয় সঁপেছে যেলো তোমারে নবীনা
সে কেন গো ভালবাসা পাবেনা তোমার?
কমলা কহিল ধীরে “আমি তা জানিনা।”
নীরদ সমুচ্চ স্বরে কহিল আবার—
“তবে যা লো দুশ্চারিনি! যেথা ইচ্ছা তোর
কর তাই যাহা তোর কহিবে হৃদয়—
কিন্তু যত দিন দেহে প্রাণ রবে মোর—
তোর এ প্রণয়ে আমি দিব না প্রশ্রয়!
আর তুই পাইবিনা দেখিতে আমারে—
জ্বলিব যদিন আমি জীবন অনলে—
স্বরগে বাসিব ভাল যা খুসী যাহারে—
প্রণয়ে সেথায় যদি পাপ নাহি বলে!
কেন বল্ পাগলিনী! ভালবাসি মোরে
অনলে জ্বালিতে চাস এ জীবন ভোরে
বিধাতা যে কি আমার লিখেছে কপালে!
যে গাছে রোপিতে যাই শুকায় সমূলে।”
ভর্ৎসনা করিবে ছিল নীরদের মনে—
আদরেতে স্বর কিন্তু হয়ে এল নত!
কমলা নয়নজল ভরিয়া নয়নে,
মুখ পানে চাহি রয় পাগলের মত!
নীরদ উদ্গামী অশ্রু করি নিবারিত
সবেগে সেখান হতে করিল প্রয়াণ।
উচ্ছ্বাসে কমলা বালা উন্মত্ত চিত
অঞ্চল করিয়া সিক্ত মুছিল নয়ান।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন