রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কবিতা - বন-ফুল (পঞ্চম সর্গ)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিজয় নিভৃতে—কি কহে নিশীথে?
কি কথা শুধায়—নীরজা বালায়—
দেখেছ, দেখেছ হোথা ?
ফুল পাত্রহতে, ফুল তুলি হাতে
নীরজা শুনিছে কুসুম গুণিছে
মুখে নাই কিছু কথা!
বিজয় শুধায়—কমলা তাহারে
গোপনে, গোপনে ভালবাসে কিরে?
তার কথা কিছু বলে কি সখীরে?
যতন করে কি তাহার তরে।
আবার কহিল, “বলো কমলায়—
বিজ কানন হইতে যে তায়—
করিয়া উদ্ধার সুখের ছায়ায়—
আনিব, হেলা কি করিবে তারে?

যদি সে ভাল না বাসে আমায়
আমি কিন্তু ভাল বাসিব তাহায়—
যতদিন দেহে শোণিত চলে।”
বিজয় যাইল আবাস ভবনে
নিদ্রায় সাধিতে কুসুম শয়নে ।
বালিকা পড়িল ভূমির তলে।
বিবর্ণ হইল কপোল বালার—
অবশ হইয়ে এল দেহ ভার—
শোণিতের গতি থামিল যেন!
ওকথা শুনিয়া নীরজা সহসা
কেন ভূমি তলে পড়িল বিবশা?
দেহ থর থর কাঁপিছে কেন?
ক্ষণেকের পরে লভিয়া চেতন,
বিজয়-প্রাসাদে করিল গমন
দ্বারে ভর দিয়া চিন্তায় মগন
দাঁড়ায়ে রহিল কেন কে জানে?
বিজয় নীরবে ঘুমায় শয্যায়,
ঝুরু ঝরু ঝরু বহিতেছে বায়,
নক্ষত্র নিচয় খোলা জানালায়
উঁকি মারিতেছে মুখের পানে!

খুলিয়া, মেলিয়া অসংখ্য নয়ন
উঁকি মারিতেছে যেনরে গগন,
জাগিয়া ভাবিয়া দেখিলে তখন
অবশ্য বিজয় উঠিত কাঁপি!
ভয়ে, ভয়ে ধীরে মুদিত নয়ন
পৃথিবীর শিশু ক্ষুদ্র প্রাণমণ—
অনিমেষ আঁখি এড়াতে তখন,
অবশ্য দুয়ার ধরিত চাপি!
ধীরে, ধীরে, ধীরে খুলিল দুয়ার,
পদাঙ্গুলি পরে সপি দেহভার—
কেও বামা ডরে প্রবেশিছে ঘরে—
ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলিয়া ভয়ে
এক দৃষ্টে চাহি বিজয়ের মুখে
রহিল দাঁড়ায়ে শয্যার সমুখে,
নেত্রে বহে ধারা মরমের দুখে,
ছবিটির মত অবাক হয়ে
ভিন্ন ওষ্ঠ হতে বহিছে নিশ্বাস—
দেখিছে নীরজা ফেলিতেছে শ্বাস
সুখের স্বপন দেখিয়ে তখন
ঘুমায় যুবক প্রফুল্ল মুখে!

‘ঘুমাও বিজয়! ঘুমাও গভীরে
দেখোনা দুখিনী, নয়নের নীরে
করিছে রোদন, তোমারি কারণ
ঘুমাও বিজয় ঘুমাও সুখে!
দেখোনা তোমারি তরে একজন
লার। নিশি দুখে করি জাগরণ—
বিছানার পাশে করিছে রোদন—
তুমি ঘুমাইছ—ঘুমাও ধীরে
দেখোনা বিজয়! জাগি সারা নিশি—
প্রাতে অন্ধকার যাইলে গো মিশি—
আবাসেতে ধীরে—যাইব গো ফিরে—
তিতিয়া বিষাদে নয়ন, নীরে—
ঘুমাও বিজয়! ঘুমাও ধীরে!

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন