অর্জ্জুন
অর্জ্জুন
কাহারে হেরিনু? সে কি সত্য, কিম্বা মায়া?
নিবিড় নির্জ্জন বনে নির্ম্মল সরসী;—
এমনি নিভৃত নিরালয়, মনে হয়
নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে সেথা বনলক্ষীগণ
স্নান করে’ যায়; গভীর পূর্ণিমারাত্রে,
সেই সুপ্ত সরসীর স্নিগ্ধ শস্পতটে
শয়ন করেন সুখে নিঃশঙ্ক বিশ্রামে
ঙ্খলিত অঞ্চলে।
সেথা বনঅন্তরালে
অপরাহ্ন বেলা, ভাবিতেছিলাম কত
আশৈশব জীবনের কথা; সংসারের
মূঢ় খেলা দুঃখ সুখ উলটি পালটি;
জীবনের অসন্তোষ; অসম্পূর্ণ আশা
অনন্ত দারিদ্র এই মর্ত্ত্য মানবের।
হেন কালে ঘনতরু অন্ধকার হ’তে
ধীরে ধীরে বাহিরিয়া, কে আসি দাঁড়াল,
সরােবর-সােপানের শ্বেত শিলাপটে।
কি অপূর্ব্ব রূপ! কোমল চরণতলে
ধরাতল কেমনে নিশ্চল হ’য়ে ছিল?
ঊষার কনক মেঘ, দেখিতে দেখিতে
যেমন মিলায়ে যায়, পূর্ব্ব পর্ব্বতের
শুভ্র শিরে অকলঙ্ক নগ্ন শােভা করি’
বিকাশিত, তেমনি বসনখানি তা’র
অঙ্গের লাবণ্যে মিলাতে চাহিতেছিল
মহাসুখে। নামি’ ধীরে সরােবরতীরে
কৌতূহলে দেখিল সে নিজ মুখচ্ছায়া;
উঠিল চমকি’। ক্ষণপরে মৃদু হাসি’
হেলাইয়া বাম বাহুখানি, হেলাভরে
এলাইয়া দিল কেশপাশ; মুক্তকেশ
পড়িল বিহ্বল হয়ে চরণের কাছে।
অঞ্চল খসায়ে দিয়ে হেরিল আপন
অনিন্দিত বাহুখানি—পরশের রসে
কোমল কাতর, প্রেমের করুণামাখা।
নিরখিলা নত করি’ শির, পরিস্ফুট
দেহতটে যৌবনের উন্মুখ বিকাশ।
দেখিলা চাহিয়া নব গৌরতনুতলে
আরক্তিম আলজ্জ আভাস; সরােবরে
পা দুখানি ডুবাইয়া দেখিলা আপন
চরণের আভা।—বিস্ময়ের নাই সীমা।
সেই যেন প্রথম দেখিল আপনারে।
শ্বেত শতদল যেন কোরক বয়স
যাপিল নয়ন মুদি’,—যেদিন প্রভাতে
প্রথম লভিল পূর্ণ শােভা, সেইদিন
হেলাইয়া গ্রীবা, নীল সরােবরজলে
প্রথম হেরিল আপনারে, সারাদিন
রহিল চাহিয়া সবিস্ময়ে। ক্ষণপরে,
কি জানি কি দুখে, হাসি মিলাইল মুখে,
ম্লান হ’ল দুটি আঁখি; বাঁধিয়া তুলিল
কেশপাশ; অঞ্চলে ঢাকিল দেহখানি;
নিশ্বাস ফেলিয়া, ধীরে ধীরে চলে’ গেল;
সােনার সায়াহ্ন যথা ম্লান মুখ করি’
আঁধার রজনীপানে ধায় মৃদুপদে।
ভাবিলাম মনে, ধরণী দেখায়ে দিল
ঐশ্বর্য্য আপন। কামনার সম্পূর্ণতা
ক্ষণতরে দেখা দিয়ে গেল।—ভাবিলাম
কত যুদ্ধ, কত হিংসা, কত আড়ম্বর,
পুরুষের পৌরুষগৌরব, বীরত্বের
নিত্য কীর্ত্তিতৃষা, শান্ত হ’য়ে লুটাইয়া
১৭
5-2
পড়ে ভূমে, ওই পূর্ণ সৌন্দর্য্যের কাছে;
পশুরাজ সিংহ যথা সিংহবাহিনীর
ভুবনবাঞ্ছিত অরুণ-চরণতলে।
আর একবার যদি -কে দুয়ার ঠেলে!
( দ্বার খুলিয়া )
এ কি! সেই মূর্তি! শান্ত হও হে হৃদয়
কোনাে ভয় নাই মােরে বরাননে! আমি
ক্ষত্রকুলজাত, ভয়ভীত দুর্ব্বলের
ভয়হারী।
চিত্রাঙ্গদা
আর্য্য, তুমি অতিথি আমার।
এ মন্দির আমার আশ্রম। নাহি জানি
কেমনে করিব অভ্যর্থনা, কি সৎকারে
তােমারে তুষিব আমি।
অর্জ্জুন
অতিথিসৎকার
তব দরশনে, হে সুন্দরি! শিষ্টবাক্য
সমূহ সৌভাগ্য মাের। যদি নাহি লহ
অপরাধ, প্রশ্ন এক শুধাইতে চাহি,
চিত্ত মাের কুতূহলী।
চিত্রাঙ্গদা
শুধাও নির্ভয়ে।
অর্জ্জুন
শুচিস্মিতে, কোন্ সুকঠোর ব্রত লাগি’
হেন রূপরাশি জনহীন দেবালয়ে
হেলায় দিতেছ বিসর্জ্জন, হতভাগ্য
মর্ত্ত্যজনে করিয়া বঞ্চিত।
চিত্রাঙ্গদা
গুপ্ত এক
কামনা সাধনাতরে, এক মনে করি
শিবপূজা।
অর্জ্জুন
হায়, কারে করিছে কামনা
জগতের কামনার ধন।—সুদর্শনে,
উদয়শিখর হ’তে অস্তাচলভূমি
ভ্রমণ করেছি আমি; সপ্তদ্বীপ মাঝে
যেখানে যা কিছু আছে দুর্লভ সুন্দর,
অচিন্ত্য মহান, সকলি দেখেছি চোখে;
কি চাও, কাহারে চাও, যদি বল মোরে
মাের কাছে পাইবে বারতা।
চিত্রাঙ্গদা
ত্রিভুবনে
পরিচিত তিনি, আমি যারে চাহি।
অর্জ্জুন
নর কে আছে ধরায়! কার যশােরাশি
অমরকাঙিক্ষত তব মনোেরাজ্যমাঝে
করিয়াছে অধিকার দুর্লভ আসন।
কহ নাম তা’র, শুনিয়া কৃতার্থ হই।
চিত্রাঙ্গদা
জন্ম তাঁর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ নরপতিকূলে,
সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বীর।
অর্জ্জুন
মিথ্যা খ্যাতি বেড়ে ওঠে
মুখে মুখে কথায় কথায়; ক্ষণস্থায়ী
বাষ্প যথা ঊষারে ছলনা করে’ ঢাকে
যতক্ষণ সূর্য নাহি ওঠে। হে সরলে,
মিথ্যারে কোরাে না উপাসনা, এ দুর্লভ
সৌন্দর্যসম্পদে। কহ শুনি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ
কোন্ বীর, ধরণীর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ কুলে।
চিত্রাঙ্গদা
পরকীর্ত্তি-অসহিষ্ণু কে তুমি সন্যাসি!
কে না জানে এ ভুবনে কুরুবংশ সর্বব-
রাজবংশচূড়া।
অর্জ্জুন
কুরুবংশ!
চিত্রাঙ্গদা
সেই বংশে
কে আছে অক্ষয়যশ বীরেন্দ্রকেশরী
নাম শুনিয়াছ?
অর্জ্জুন
বল, শুনি তব মুখে।
চিত্রাঙ্গদা
অর্জ্জুন, গাণ্ডীবধনু, ভুবনবিজয়ী।
সে অক্ষয় নাম, সমস্ত জগৎ হ’তে
করিয়া লুণ্ঠন, লুকায়ে রেখেছি যত্নে
কুমারী-হৃদয় পূর্ণ করি। ব্রহ্মচারি,
কেন এ অধৈর্য তব?
তবে মিথ্যা এ কি
মিথ্যা সে অৰ্জ্জুন নাম? কহ এই বেলা
মিথ্যা যদি হয় তবে হৃদয় ভাঙিয়া
ছেড়ে দিই তা’রে, বেড়াক সে উড়ে উড়ে
মুখে মুখে বাতাসে বাতাসে, তা’র স্থান
নহে নারীর অন্তরাসনে।
অর্জ্জুন
বরাঙ্গনে,
সে অৰ্জ্জুন, সে পাণ্ডব, সে গাণ্ডীবধনু,
সেই ভাগ্যবান চরণে শরণাগত।
নাম তা’র, খ্যাতি তা’র, বীর্য তা’র, মিথ্যা
হােক সত্য হােক, যে দেবদুর্লভ লোকে
করেছ তাহারে স্থান দান, সেথা হ’তে
আর তা’রে কোরাে না বিচ্যুত, ক্ষীণপুণ্য
হৃতস্বর্গ হতভাগ্যসম।
চিত্রাঙ্গদা
তুমি পার্থ?
আমি পার্থ, দেবি, তােমার হৃদয়দ্বারে
প্রেমার্ত্ত অতিথি।
চিত্রাঙ্গদা
শুনেছিনু ব্রহ্মচর্য্য
পালিছে অৰ্জ্জুন দ্বাদশবরষব্যাপী।
সেই বীর কামিনীরে করিছে কামনা
ব্রত ভঙ্গ করি’! হে সন্ন্যাসি, তুমি পার্থ?
অর্জ্জুন
তুমি ভাঙিয়াছ ব্রত মাের। চন্দ্র উঠি’
যেমন নিমেষে ভেঙে দেয় নিশীথের
যােগনিদ্রা-অন্ধকার।
চিত্রাঙ্গদা
ধিক্, পার্থ, ধিক্!
কে আমি, কি আছে মোর, কি দেখেছ তুমি,
কি জান আমারে। কার লাগি আপনারে
হতেছ বিস্মৃত। মুহূর্ত্তেকে সত্য ভঙ্গ
করি’, অৰ্জ্জুনেরে করিতেছ অনৰ্জ্জুন
কার তরে? মাের তরে নহে। এই দুটি
নীলােৎপল নয়নের তরে; এই দুটি
নবনীনিন্দিত বাহুপাশে সব্যসাচী
অর্জ্জুন দিয়াছে ধরা দুই হস্তে ছিন্ন
করে’ ফেলে’ সত্যের বন্ধন। কোথা গেল
প্রেমের মর্যাদা? কোথায় রহিল পড়ে’
নারীর সম্মান? হায়, আমারে করিল
অতিক্রম আমার এ তুচ্ছ দেহখানা,
মৃত্যুহীন অন্তরের এই ছদ্মবেশ
ক্ষণস্থায়ী। এতক্ষণে পারিনু জানিতে
মিথ্যা খ্যাতি, বীরত্ব তােমার।
অর্জ্জুন
খ্যাতি মিথ্যা,
বীর্য্য মিথ্যা আজ বুঝিয়াছি। আজ মােরে
সপ্তলােক স্বপ্ন মনে হয়।শুধু একা
পূর্ণ তুমি সর্ব্ব তুমি, বিশ্বের ঐশ্বর্য্য
তুমি, এক নারী সকল দৈন্যের তুমি
মহা অবসান, সকল কর্মের তুমি
বিশ্রামরূপিণী। কেন জানি অকস্মাৎ
তােমারে হেরিয়া—বুঝিতে পেরেছি আমি
কি আনন্দকিরণেতে প্রথম প্রত্যুষে
অন্ধকার মহার্ণবে সৃষ্টিশতদল
দিগ্বিদিকে উঠেছিল উন্মােষিত হ’য়ে
এক মুহূর্তের মাঝে। আর সকলের
পলে পলে তিলে তিলে তবে জানা যায়
বহুদিনে;—তােমাপানে যেমনি চেয়েছি
অমনি সমস্ত তব পেয়েছি দেখিতে
তবু পাই নাই শেষ। -কৈলাসশিখরে
একদা মৃগয়াশ্রান্ত তৃষিত তাপিত
গিয়েছিনু দ্বিপ্রহরে কুসুমবিচিত্র
মানসের তীরে। যেমনি দেখিনু চেয়ে
সেই সুর-সরসীর সলিলের পানে
অমনি পড়িল চোখে অনন্ত অতল।
স্বচ্ছ জল, যত নিম্নে চাই। মধ্যাহ্নের
রবিরশ্মিরেখাগুলি স্বর্ণনলিনীর
সুবর্ণ মৃণাল সাথে মিশি’ নেমে গেছে
অগাধ অসীমে কাঁপিতেছে; আঁকিবাঁকি
জলের হিল্লোলে, লক্ষকোটি অগ্নিময়ী
নাগিনীর মত। মনে হ’ল ভগবান
সূর্য্যদেব সহস্র অঙ্গুলি নির্দ্দেশিয়া
দিলেন দেখায়ে, জন্মশ্রান্ত কর্ম্মক্লান্ত
মর্ত্ত্যজনে, কোথা আছে সুন্দর মরণ
অনন্ত শীতল। সেই স্বচ্ছ অতলতা
দেখেছি তােমার মাঝে। চারিদিক হতে
দেবের অঙ্গুলি যেন দেখায়ে দিতেছে
মােরে, ওই তব অলােক আলােকমাঝে
কীর্ত্তিক্লিষ্ট জীবনের পূর্ণনির্ব্বাপন।
চিত্রাঙ্গদা
আমি নহি, আমি নহি, হায়, পার্থ, হায়
কোন্ দেবের ছলনা! যাও যাও ফিরে
যাও, ফিরে যাও বীর! মিথ্যারে কোরাে না
উপাসনা। শৌর্য্য বীর্য্য মহত্ত্ব তােমার
দিয়াে না মিথ্যার পদে। যাও, ফিরে যাও!
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন