চিত্রাঙ্গদা, মদন ও বসন্ত
চিত্রাঙ্গদা
তুমি পঞ্চশর?
মদন
আমি সেই মনসিজ,
নিখিলের নরনারী হিয়া টেনে আনি
বেদনা বন্ধনে।
চিত্রাঙ্গদা
কি বেদনা কি বন্ধন
জানে তাহা দাসী। প্রণমি তোমার পদে
প্রভু, তুমি কোন্ দেব?
বসন্ত
আমি ঋতুরাজ।
জর মৃত্যু দুই দৈত্য নিমেষে নিমেষে
বাহির করিতে চাহে বিশ্বের কঙ্কাল;
আমি পিছে পিছে ফিরে’ পদে পদে তা’রে
করি আক্রমণ; রাত্রিদিন সে সংগ্রাম।
আমি অখিলের সেই অনন্ত যৌবন।
চিত্রাঙ্গদা
প্রণাম তোমারে ভগবন্। চরিতার্থ
দাসী দেব-দরশনে।
মদন
কল্যাণি, কি লাগি’
এ কঠোর ব্রত তব? তপস্যার তাপে
করিছ মলিন খিন্ন যৌবন-কুসুম,
অনঙ্গ পূজার নহে এমন বিধান।
কে তুমি, কি চাও ভদ্রে!
চিত্রাঙ্গদা
দয়া কর যদি,
শোন মোর ইতিহাস। জানাব প্রার্থনা
তা’র পরে।
মদন
শুনিবারে রহিমু উৎসুক।
চিত্রাঙ্গদা
আমি চিত্রাঙ্গদা। মণিপুর-রাজ-সুতা।
মোর পিতৃবংশে কভু কন্যা জন্মিবে না—
দিয়াছিলা হেন বর দেব উমাপতি
তপে তুষ্ট হ’য়ে। আমি সেই মহাবর
ব্যর্থ করিয়াছি। অমোঘ দেবতা-বাক্য
মাতৃগর্ভে পশি, দুর্বল প্রারম্ভ মোর
পারিল না পুরুষ করিতে শৈবতেজে,
এমনি কঠিন নারী আমি।
মদন
শুনিয়াছি
বটে। তাই তব পিতা পুত্রের সমান
পালিয়াছে তোমা। শিখায়েছে ধনুর্ব্বিদ্যা
রাজদণ্ডনীতি।
চিত্রাঙ্গদা
তাই পুরুষের
বেশে, যুবরাজরূপে, করি রাজকাজ,
ফিরি স্বেচ্ছামতে; নাহি জানি লজ্জা ভয়,
অন্তঃপুরবাস; নাহি জানি হাব ভাব,
বিলাস-চাতুরী; শিখিয়াছি ধনুর্ব্বিদ্যা,
শুধু শিখি নাই, দেব, তব পুষ্পধনু
কেমনে বাকাতে হয় নয়নের কোণে।
বসন্ত
সুনয়নে, সে বিদ্যা শিখে না কোনো নারী;
নয়ন আপনি করে আপনার কাজ,
বুকে যার বাজে সেই বোঝে।
চিত্রাঙ্গদা
একদিন
গিয়েছিনু মৃগ-অন্বেষণে একাকিনী
ঘন বনে, পূর্ণ নদীতীরে। তরুমূলে
বাঁধি’ অশ্ব, দুর্গম কুটিল বনপথে
পশিলাম মৃগপদচিহ্ন অনুসরি’।
ঝিল্লিমন্দ্রমুখরিত নিত্যঅন্ধকার
লতাগুল্মে-গহন গম্ভীর মহারণ্যে,
কিছুদূর অগ্রসরি’ দেখিনু সহসা
রুধিয়া সঙ্কীর্ণ পথ রয়েছে শয়ান
ভূমিতলে, চীরধারী মলিন পুরুষ।
উঠিতে কহিনু তা’রে অবজ্ঞার স্বরে
সরে যেতে,—নড়িল না, চাহিল না ফিরে’
উদ্ধত অধীর রোষে ধনু-অগ্রভাগে
করিমু তাড়না;—সরল সুদীর্ঘ দেহ
মুহূর্ত্তেই তীরবেগে উঠিল দাঁড়ায়ে
সম্মুখে আমার,—ভস্মসুপ্ত অগ্নি যথা
ঘৃতাহুতি পেয়ে শিখারূপে উঠে উর্দ্ধে
চক্ষের নিমেষে। শুধু ক্ষণেকের তরে
চাহিল আমার মুখপানে,—রােষদৃষ্টি
পলকে মিলায়ে গেল; গুপ্ত কৌতুকের
মৃদুহাস্যরেখা নাচিল অধরপ্রান্তে,
বুঝি সে বালক-মূর্তি হেরিয়া আমার।
শিখে’ পুরুষের বিদ্যা, পরে’ পুরুষের
বেশ, পুরুষের সাথে থেকে, এতদিন
ভুলে ছিনু যাহা, সেই মুখে চেয়ে, সেই
আপনাতে-আপনি-অটলমূর্তি হেরি,
সেই মুহূর্তেই জানিলাম মনে, নারী
আমি। সেই মুহূর্তেই প্রথম দেখিনু
সম্মুখে পুরুষ মাের।
মদন
সে শিক্ষা আমারি
সুলক্ষণে! আমিই চেতন করে’ দিই
একদিন জীবনের শুভ পুণ্যক্ষণে
নারীরে হইতে নারী, পুরুষে পুরুষ।
কি ঘটিল পরে?
চিত্রাঙ্গদা
সভয় বিস্ময়কণ্ঠে
শুধানু “কে তুমি?” শুনিনু উত্তর “আমি
পার্থ, কুরুবংশধর।”
রহিনু দাঁড়ায়ে
চিত্রপ্রায়, ভুলে’ গেনু প্রণাম করিতে।
এই পার্থ? আজন্মের বিস্ময় আমার?
শুনেছিনু বটে, সত্য পালনের তরে
দ্বাদশ বৎসর বনে বনে ব্রহ্মচর্য্য
পালিছে অৰ্জ্জুন। এই সেই পার্থবীর!
বাল্য-দুরাশায় কতদিন করিয়াছি
মনে, পার্থকীর্ত্তি করিব নিস্প্রভ আমি
নিজ ভুজবলে; সাধিব অব্যর্থ লক্ষ্য;
পুরুষের ছদ্মবেশে মাগিব সংগ্রাম
তাঁর সাথে, বীরত্বের দিব পরিচয়।
হারে মুগ্ধে, কোথায় চলিয়া গেল সেই
স্পর্দ্ধা তাের! যে ভূমিতে আছেন দাঁড়ায়ে
সে ভূমির তৃণদল হইতাম যদি,
শৌর্য্যবীর্য্য যাহা কিছু ধূলায় মিলায়ে
দিয়ে, লভিতাম দুর্লভ মরণ, সেই
চরণের তলে!-
কি ভাবিতেছিনু, মনে
নাই। দেখিনু চাহিয়া, ধীরে চলি’ গেলা
বীর বন-অন্তরালে। উঠিনু চমকি;
সেইক্ষণে জন্মিল চেতনা; আপনারে
দিলাম ধিক্কার শতবার। ছি ছি মূঢ়ে,
না করিলি সম্ভাষণ, না শুধালি কথা,
না চাহিলি ক্ষমা ভিক্ষা,—বর্ব্বরের মত
রহিলি দাঁড়ায়ে—হেলা করি’ চলি’ গেলা
বীর। বাঁচিতাম, সে মুহূর্তে মরিতাম
যদি।—
পরদিন প্রাতে দূরে ফেলে দিনু
পুরুষের বেশ। পরিলাম রক্তাম্বর,
কঙ্কণ কিঙ্কিণী কাঞ্চি। অনভ্যস্ত সাজ
লজ্জায় জড়ায়ে অঙ্গ রহিল একান্ত
সসঙ্কোচে।
গােপনে গেলাম সেই বনে।
অরণ্যের শিবালয়ে দেখিলাম তাঁরে।—
মদন
বলে’ যাও বালা। মাের কাছে করিয়াে না
লাজ। আমি মনসিজ; মানসের
সকল রহস্য জানি।
চিত্রাঙ্গদা
মনে নাই ভালাে,
তা’র পরে কি কহিনু আমি, কি উত্তর
শুনিলাম। আর শুধায়াে না, ভগবন্!
মাথায় পড়িল ভেঙে লজ্জা বজ্ররূপে
তবু মােরে পারিল না শতধা করিতে-
নারী হ’য়ে এমনি পুরুষপ্রাণ মাের!
নাহি জানি কেমনে এলেম ঘরে ফিরে’
দুঃস্বপ্নবিহ্বলসম। শেষ কথা তাঁর
কর্ণে মাের বাজিতে লাগিল তপ্ত শূল-
“ব্রহ্মচারীব্রতধারী আমি। পতিযােগ্য
নহি বরাঙ্গনে।”
পুরুষের ব্রহ্মচর্য্য!
ধিক্ মােরে, তাও আমি নারিনু টলাতে।
তুমি জান, মীনকেতু, কত ঋষি মুনি
করিয়াছে বিসৰ্জ্জন নারীপদতলে
চিরার্জ্জিত তপস্যার ফল। ক্ষত্রিয়ের
ব্রহ্মচর্য্য!–গৃহে গিয়ে ভাঙিয়ে ফেলিনু
ধনুঃশর যাহা কিছু ছিল; -কিণাঙ্কিত
এ কঠিন করতল—ছিল যা’ গর্ব্বের
ধন এতকাল—লাঞ্ছনা করিনু তা’রে
নিষ্ফল আক্রোশভরে। এতদিন পরে
বুঝিলাম, নারী হ’য়ে পুরুষের মন
যদি জিনিতে পারি বৃথা বিদ্যা যত।
অবলার কোমল মৃণাল বাহুদুটি
এ বাহুর চেয়ে ধরে শতগুণ বল।
ধন্য সেই মুগ্ধ মূর্খ ক্ষীণ-তনুলতা
পরাবলম্বিতা, লজ্জাভয়ে লীনাঙ্গিনী
সামান্য ললনা, যার ত্রস্ত নেত্রপাতে
মানে পরাভব বীর্য্যবল, তপস্যার
তেজ!—হে অনঙ্গদেব, সব দম্ভ মাের
একদণ্ডে লয়েছ ছিনিয়া—সব বিদ্যা
সব বল করেছ তােমার পদানত।
এখন তােমার বিদ্যা শিখাও আমায়,
দাও মােরে অবলার বল, নিরস্ত্রের
অস্ত্র যত।
মদন
আমি হ’ব সহায় তােমার।
অয়ি শুভে, বিশ্বজয়ী অর্জ্জুনে করিয়া
জয়, বন্দী করি’ আনিব সম্মুখে তব।
রাজ্ঞী হ’য়ে দিয়ে তা’রে দণ্ড পুরস্কার
যথা ইচ্ছা! বিদ্রোহীরে করিয়াে শাসন।
চিত্রাঙ্গদা
সময় থাকিত যদি একাকিনী আমি
তিলে তিলে হৃদয় তাঁহার করিতাম
অধিকার, নাহি চাহিতাম দেবতার
সহায়তা। সঙ্গীরূপে থাকিতাম সাথে,
রণক্ষেত্রে হতেম সারথি, মৃগয়াতে
রহিতাম অনুচর, শিবিরের দ্বারে
জাগিতাম রাত্রির প্রহরী, ভৃত্যরূপে
করিতাম সেবা, ক্ষত্রিয়ের আর্ত্তত্রাণ-
মহাব্রতে হইতাম সহায় তাঁহার।
একদিন কৌতূহলে দেখিতেন চাহি,
ভাবিতেন মনে মনে “এ কোন্ বালক,
পূর্ব্বজনমের কোন্ চিরদাস, সঙ্গ
লইয়াছে এ জনমে সুকৃতির মত।”
ক্রমে খুলিতাম তাঁর হৃদয়ের দ্বার,
চিরস্থান লভিতাম সেথা। জানি আমি
এ প্রেম আমার শুধু ক্রন্দনের নহে;
যে নারী নির্ব্বাক্ ধৈর্য্যে চিরমর্ম্মব্যথা
নিশীথনয়নজলে করয়ে পালন,
দিবালােকে ঢেকে রাখে ম্লান হাসিতলে,
আজন্মবিধবা, আমি সে রমণী নহি;
আমার কামনা কভু না নিস্ফল হবে!
আপনারে একবার দেখাইতে পারি
যদি, নিশ্চয় সে দিবে ধরা। হায় বিধি,
সেদিন কি দেখেছিল! সরমে কুঞ্চিত
এক শঙ্কিত কম্পিত নারী, আত্মহারা
প্রলাপবাদিনী। কিন্তু আমি যথার্থ কি
তাই? যেমন সহস্র নারী পথে গৃহে
চারিদিকে, শুধু ক্রন্দনের অধিকারী,
তা’র চেয়ে বেশি নই আমি? কিন্তু হায়
আপনার পরিচয় দেওয়া, বহু ধৈর্য্যে
বহুদিনে ঘটে, চিরজীবনের কাজ,
জন্মজন্মান্তের ব্রত। তাই আসিয়াছি
দ্বারে তােমাদের, করেছি কঠোর তপ।
হে ভুবনজয়ী দেব, হে মহাসুন্দর
ঋতুরাজ, শুধু এক দিবসের তরে
ঘুচাইয়া দাও, জন্মদাতা বিধাতার
বিনাদোষে অভিশাপ, নারীর কুরূপ।
কর মােরে অপূর্ব্ব সুন্দরী। দাও মােরে
সেই এক দিন—তা’র পরে চির দিন
রহিল আমার হাতে।—যখন প্রথম
তা’রে দেখিলাম, যেন মুহূর্তের মাঝে
অনন্ত বসন্ত পশিল হৃদয়ে। বড়
ইচ্ছা হয়েছিল, সে যৌবন-সমীরণে
সমস্ত শরীর যদি দেখিতে দেখিতে
অপূর্ব্ব পুলকভরে উঠে প্রস্ফুটিয়া
লক্ষীর চরণশায়ী পদ্মের মতন।
হে বসন্ত, হে বসন্তসখে! সে বাসনা
পূরাও আমার শুধু দিনেকের তরে!
মদন
তথাস্তু!
বসন্ত
তথাস্তু। শুধু একদিন নহে,
এক বর্ষ ধরি’ বসন্তের পুষ্পশােভা
ঘেরিয়া তােমার তনু রহিবে বিকশি’।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন