তরুতলে চিত্রাঙ্গদা
চিত্রাঙ্গদা
হায়, হায়, সে কি ফিরাইতে পারি! সেই
থরথর ব্যাকুলতা বীর হৃদয়ের,
তৃষ্ণার্ত্ত কম্পিত এক স্ফুলিঙ্গনিশ্বাসী
হােমাগ্নিশিখার মত; সেই, নয়নের
দৃষ্টি যেন অন্তরের বাহু হ’য়ে, কেড়ে
নিতে আসিছে আমায়; উত্তপ্ত হৃদয়
ছুটিয়া আসিতে চাহে সর্ব্বাঙ্গ টুটিয়া,
তাহার ক্রন্দনধ্বনি প্রতিঅঙ্গে শুনা
যায় যেন! এ তৃষ্ণা কি ফিরাইতে পারি?
(বসন্ত ও মদনের প্রবেশ)
হে অনঙ্গদেব, এ কি রূপ-হুতাশনে
ঘিরেছ আমারে, দগ্ধ হই, দগ্ধ করে’
মারি।
মদন
বল, তম্বি, কালিকার বিবরণ।
মুক্ত পুষ্পশর মাের কোথা কি সাধিল
কাজ শুনিতে বাসনা।
চিত্রাঙ্গদা
কাল সন্ধ্যাবেলা,
সরসীর তৃণপুঞ্জ তীরে, পেতেছিনু
পুষ্পশয্যা, বসন্তের ঝরা ফুল দিয়ে।
শ্রান্ত কলেবরে, শুয়েছিনু আপনার
মনে, বাম বাহুপরে রাখিয়া অলস
শির; ভাবিতেছিলাম দিবসের কথা,
শুনেছিনু যেই স্তুতি অর্জ্জুনের মুখে
স্মরিতেছিলাম তা’র প্রতি ক্ষুদ্র কথা
একাকিনী শুয়ে শুয়ে; পূর্ণ দিবসের
সঞ্চিত অমৃত হ’তে বিন্দু বিন্দু ল’য়ে
করিতেছিলাম পান; ভুলিতেছিলাম
পূর্ব ইতিহাস, গতজন্মকথাসম;
যেন আমি রাজকন্যা নহি; যেন মাের
নাই পূর্ব্বপর; যেন আমি ধরাতলে
একদিনে উঠেছি ফুটিয়া, অরণ্যের
পিতৃমাতৃহীন ফুল; একটি প্রভাত
শুধু পরমায়ু, তারি মাঝে শুনে নিতে
হবে—ভ্রমর গুঞ্জনগীতি, বনান্তের
আনন্দমর্ম্মর; তার পরে নীলাম্বর
হ’তে নামাইয়া আঁখি, নুমাইয়া গ্রীবা,
বায়ুস্পর্শভরে টুটিয়া লুটিয়া যাব
ক্রন্দনবিহীন, মাঝখানে ফুরাইবে
কুসুমকাহিনীটুকু আদি অন্তহারা।
বসন্ত
একটি প্রভাতে ফুটে অনন্ত জীবন,
হে সুন্দরি!
মদন
সঙ্গীতে যেমন, ক্ষণিকের
তানে, গুঞ্জরি কাঁদিয়া উঠে অন্তহীন
কথা। তা’র পরে বল।
চিত্রাঙ্গদা
ভাবিতে ভাবিতে
সর্ব্বাঙ্গে হানিতেছিল ঘুমের হিল্লোল
দক্ষিণের বায়ু। সপ্তপর্ণশাখা হ’তে
ফুল্ল মালতীর লতা টুপটাপ করি’
মাের গৌরতনুপরে পাঠাইতেছিল
শত নিঃশব্দ চুম্বন; ফুলগুলি কেহ
চুলে, কেহ পদমূলে, কেহ স্তনতটে
বিছাইল আপনার মরণশয়ন।
অচেতনে গেল কতক্ষণ। হেনকালে
জানি না কখন্ ঘুমঘােরে, অনুভব
হ’ল, যেন কার মুগ্ধ নয়নের দৃষ্টি
দশ অঙ্গুলির মত পরশ করিছে
রভস-লালসে মাের নিদ্রালস তনু।
চমকি’ উঠিমু জাগি’।
দেখিনু, সন্ন্যাসী
পদপ্রান্তে নির্ণিমেষ দাঁড়ায়ে রয়েছে
স্থির প্রতিমূর্ত্তি সম। পূর্ব্বাচল হ’তে
ধীরে ধীরে সরে’ এসে পশ্চিমে হেলিয়ে
দ্বাদশীর শশী সমস্ত হিমাংশুরাশি
দিয়াছে ঢালিয়া, ঙ্খলিতবসন মাের
অম্লাননূতন শুভ্র সৌন্দর্য্যের পরে।
পুষ্পগন্ধে পূর্ণ তরুতল; ঝিল্লিরবে
তন্দ্রামগ্ন-নিশীথিনী; স্বচ্ছ সরােবরে
অকম্পিত চন্দ্রকরচ্ছায়া; সুপ্ত বায়ু;
শিরে ল’য়ে জ্যোৎস্নলােকে মসৃণ চিক্কণ
রাশি রাশি অন্ধকার পল্লবের ভার
স্তম্ভিত অটবী। সেই মত চিত্রার্পিত
দাঁড়াইয়া দীর্ঘকায় বনস্পতিসম,
দণ্ডধারী ব্রহ্মচারী ছায়াসহচর।
প্রথম সে নিদ্রাভঙ্গে চারিদিক চেয়ে
মনে হ’ল, কবে কোন্ বিস্মৃত প্রদোষে
জীবন ত্যজিয়া, স্বপ্নজন্ম করিয়াছি
লাভ, কোন্ এক অপরূপ নিদ্রালােকে,
জনশূন্য ম্লানজ্যোৎস্না বৈতরণীতীরে।
দাঁড়ানু উঠিয়া। মিথ্যা সরম সঙ্কোচ
খসিয়া পড়িল শ্লথ বসনের মত
পদতলে। শুনিলাম, “প্রিয়ে, প্রিয়তমে!”
গম্ভীর আহ্বানে, জন্ম জন্ম শত জন্ম
মোর, উঠিল জাগিয়া এক দেহ মাঝে।
কহিলাম, “লহ, লহ, যাহা আছে, সব
লহ জীবনবল্লভ।” দিলাম বাড়ায়ে,
দুই বাহু।—চন্দ্র অস্ত গেল বনান্তরে,
অন্ধকারে ঝাঁপিল মেদিনী। স্বর্গ মর্ত্ত্য
দেশকাল দুঃখসুখ জীবন মরণ
অচেতন হ’য়ে গেল অসহ্য পুলকে।
প্রভাতের প্রথম কিরণে, বিহঙ্গের
প্রথম সঙ্গীতে, বাম করে দিয়া ভর
ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিনু শয্যাতলে।
দেখিনু চাহিয়া, সুখসুপ্ত বীরবর।
শ্রান্ত হাস্য লেগে আছে ওষ্ঠপ্রান্তে তাঁর
প্রভাতের চন্দ্রকলাসম, রজনীর
আনন্দের শীর্ণ অবশেষ। নিপতিত
উন্নত ললাট-পটে অরুণের আভা;
মর্ত্ত্যলােকে যেন নব উদয়পর্ব্বতে
নবকীর্ত্তি-সূর্যোদয় পাইবে প্রকাশ।
নিশ্বাস ফেলিয়া, উঠিনু শয়ন ছাড়ি’;
মালতীর লতাজাল দিলাম নামায়ে
সাবধানে, রবিকর করি’ অন্তরাল
সুপ্তমুখ হ’তে। দেখিলাম চতুর্দ্দিকে
সেই পূর্ব্বপরিচিত প্রাচীন পৃথিবী।
আপনারে আরবার মনে পড়ে’ গেল,
ছুটিয়া পলায়ে এনু, নব প্রভাতের
শেফালি-বিকীর্ণ-তৃণ বনস্থলী দিয়ে,
আপনার ছায়াত্রস্তা হরিণীর মত।
বিজন বিতানতলে বসি’, করপুটে
মুখ আবরিয়া, কাঁদিবারে চাহিলাম,
এল না ক্রন্দন।
মদন
হায়, মানবনন্দিনি,
স্বর্গের সুখের দিন স্বহস্তে ভাঙিয়া
ধরণীর একরাত্রি পূর্ণ করি’ তাহে
যত্নে ধরিলাম তব অধরসম্মুখে;
শচীর প্রসাদসুধা, রতির চুম্বিত,
নন্দনবনের গন্ধে মােদিত-মধুর,
তােমারে করানু পান, তবু এ ক্রন্দন!
চিত্রাঙ্গদা
কারে, দেব, করাইলে পান? কার তৃষা
মিটাইলে? সে চুম্বন, সে প্রেমসঙ্গম
এখনাে উঠিছে কাঁপি যে অঙ্গ ব্যাপিয়া
বীণার ঝঙ্কার সম, সে ত মাের নহে!
বহুকাল সাধনায় এক দণ্ড শুধু
পাওয়া যায় প্রথম মিলন, সে মিলন
কে লইল লুটি’, আমারে বঞ্চিত করি।
সে চিরদুর্লভ মিলনের সুখস্মৃতি
সঙ্গে করে’ ঝরে’ পড়ে যাবে, অতিস্ফুট
পুস্পদলসম, এ মায়া-লাবণ্য মাের;
অন্তরের দরিদ্র রমণী, রিক্তদেহে
বসে’ র’বে চিরদিনরাত। মীনকেতু,
কোন্ মহারাক্ষসীরে দিয়াছ বাঁধিয়া
অঙ্গসহচরী করি’ ছায়ার মতন-
কি অভিসম্পাত? চিরন্তন তৃষ্ণাতুর
লােলুপ ওষ্ঠের কাছে আসিল চুম্বন,
সে করিল পান। সেই প্রেমদৃষ্টিপাত
এমনি আগ্রহপূর্ণ, যে অঙ্গেতে পড়ে
সেথা যেন অঙ্কিত করিয়া রেখে যায়
বাসনার রাঙা চিহ্নরেখা, সেই দৃষ্টি
রবিরশ্মিসম, চিররাত্রিতাপসিনী
কুমারীহৃদয়পদ্মপানে ছুটে এল,
সে তাহারে লইল ভুলায়ে।
মদন
কল্য নিশি
ব্যর্থ গেছে তবে! শুধু, কূলের সম্মুখে
এসে আশার তরণী গেছে ফিরে’ ফিরে’
তরঙ্গ-আঘাতে?
চিত্রাঙ্গদা
কাল রাত্রে কিছু নাহি
মনে ছিল দেব! সুখস্বর্গ এত কাছে
দিয়েছিল ধরা, পেয়েছি কি না পেয়েছি
করিনি গণনা আত্মবিস্মরণসুখে।
আজ প্রাতে উঠে,’ নৈরাশ্যধিক্কারবেগে
অন্তরে অন্তরে টুটিছে হৃদয়। মনে
পড়িতেছে একে একে রজনীর কথা,
বিদ্যুৎবেদনাসহ হতেছে চেতনা
অন্তরে বাহিরে মাের হয়েছে সতীন,
আর তাহা নারিব ভুলিতে। সপত্নীরে
স্বহস্তে সাজায়ে সযতনে প্রতিদিন
পাঠাইতে হবে, আমার আকাঙ্ক্ষা-তীর্থ
বাসরশয্যায়; অবিশ্রাম সঙ্গে রহি’
প্রতিক্ষণ দেখিতে হইবে চক্ষু মেলি’
৩৩
5-3
তাহার আদর। ওগো, দেহের সােহগে
অন্তর জ্বলিবে হিংসানলে, হেন শাপ
নরলােকে কে পেয়েছে আর? হে অতনু
বর তব ফিরে’ লও।
মদন
যদি ফিরে’ লই,—
ছলনার আবরণ খুলে’ ফেলে’ দিয়ে
কাল প্রাতে কোন্ লাজে দাঁড়াইবে আসি’
পার্থের সম্মুখে, কুসুমপল্লবহীন
হেমন্তের হিমশীর্ণ লতা? প্রমােদের
প্রথম আস্বাদটুকু দিয়ে, মুখ হ’তে
সুধাপাত্র কেড়ে নিয়ে চূর্ণ করে’ ফেল
যদি ভূমিতলে, কি আঘাতে উঠিবে সে
চমকিয়া, কি আক্রোশে হেরিবে তােমায়!
চিত্রাঙ্গদা
সেও ভালো দেব! এই ছদ্মরূপিণীর
চেয়ে শ্রেষ্ঠ আমি শতগুণে। আপনারে
করিব প্রকাশ; ভালো যদি নাই লাগে,
ঘৃণাভরে চলে’ যান যদি, বুক ফেটে
মরি যদি আমি, তবু আমি, আমি র’ব
সেও ভালো ইন্দ্রসখা!
বসন্ত
শােন মাের কথা।
ফুলের ফুরায় যবে ফুটিবার কাজ
তখন প্রকাশ পায় ফল। যথাকালে
আপনি ঝরিয়া পড়ে’ যাবে, তাপক্লিষ্ট
লঘু লাবণ্যের দল; আপন গৌরবে
তখন বাহির হবে; হেরিয়া তােমারে
নূতন সৌভাগ্য বলি’ মানিবে ফাল্গুনী।
যাও, ফিরে’ যাও, বৎসে, যৌবন-উৎসবে!
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন