নাটোর জেলার এক অজপাড়া গ্রাম বিলাশপুর। এই গ্রামে বাস করতেন আব্দুল মতিন, এক সাধারণ কৃষক, কিন্তু এক অসাধারণ পিতা। তাঁর পরিবারে স্ত্রী রহিমা বেগম, বড় ছেলে রাসেল এবং ছোট মেয়ে তানিয়া। মতিন ছিলেন সাদামাটা মানুষ, জীবনে কোনো বিলাসিতা ছিল না। কিন্তু তাঁর একটি স্বপ্ন ছিল—সন্তানদের ভালো মানুষ করা, উচ্চশিক্ষিত করা, যাতে তারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
কৃষিকাজ করে সামান্য যা আয় হতো, তা দিয়েই তিনি সংসার চালাতেন। মাঝে মাঝে দিনমজুরের কাজও করতেন, যাতে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারেন। গ্রামের অনেকেই বলত,
“মতিন, বেশি কষ্ট কোরো না। গরিব মানুষের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে আর কতদূর যাবে?”
কিন্তু মতিন কখনো দমে যাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা মানুষকে আলোর পথ দেখায়।
রাসেল যখন ক্লাস নাইনে পড়ে, তখন একদিন স্কুল থেকে নোটিশ এল—পরের মাসের মধ্যে পরীক্ষার ফি জমা দিতে হবে। কিন্তু মতিনের কাছে তখন এক টাকাও নেই। বাজারে ধান বিক্রি করেছিলেন, কিন্তু সেই টাকা দিয়ে ধার শোধ করতে হয়েছে। স্ত্রীকে বললেন,
“রহিমা, রাসেলের পরীক্ষার ফি দিতে হবে। কী যে করব বুঝতে পারছি না।”
রহিমা বললেন,
“আমি বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ নিতে পারি। তুমি যদি কোনোভাবে একটু বাড়তি কাজ করো, তাহলে হয়তো হয়ে যাবে।”
মতিন সিদ্ধান্ত নিলেন রাতে বাজারের এক দোকানে পাহারাদারের কাজ করবেন। দিনে মাঠে কাজ করবেন, রাতে দোকান পাহারা দেবেন। সারাদিনের পরিশ্রমের পরও ক্লান্তি ভুলে রাত জেগে থাকতেন।
একদিন মাঝরাতে রাসেলের ঘুম ভেঙে যায়। উঠে দেখে, বাবা ঘরের কোণায় বসে কাঁদছেন। কাছে গিয়ে বলল,
“বাবা, তুমি কাঁদছো কেন?”
মতিন দ্রুত চোখ মুছে বললেন,
“না বাবা, কিছু হয়নি। তোমাদের জন্য সব করব, যত কষ্টই হোক।”
রাসেল সেদিন বুঝতে পারল, পিতার ভালোবাসা কেমন হয়। সে প্রতিজ্ঞা করল, কঠোর পরিশ্রম করবে, বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে।
এভাবে কষ্ট করতে করতে বছর কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু একদিন ভয়ানক ঘটনা ঘটল। মতিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রচণ্ড জ্বর আর দুর্বলতা নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
রহিমা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
“এভাবে কাজ করলে তো শরীর আর থাকবে না!”
মতিন মৃদু হাসলেন,
“তোমাদের মুখে হাসি দেখার জন্য আমি সব কষ্ট নিতে রাজি।”
কিন্তু শরীর বেশিদিন সইতে পারল না। ডাক্তার বললেন,
“তাঁর শরীরে প্রচণ্ড দুর্বলতা। বিশ্রাম দরকার।”
কিন্তু মতিন বিশ্রাম নেওয়ার মানুষ নন। তিনি জানতেন, তাঁর বিশ্রাম মানে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যাওয়া। তাই তিনি সুস্থ না হয়েও কাজে ফিরে গেলেন।
মতিনের এই ত্যাগ বৃথা যায়নি। রাসেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ এ চান্স পেল। বাবা-মায়ের চোখে আনন্দাশ্রু। মতিন ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন,
“তোমার এই সাফল্যের জন্য আমি গর্বিত, বাবা!”
রাসেল আরও কঠোর পরিশ্রম করল। বিসিএস পরীক্ষা দিল, এবং সফল হলো! সে স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দিল। এই সংবাদ শোনার পর মতিন স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তিনি অনেক বছর ধরে এই মুহূর্তটার অপেক্ষায় ছিলেন।
যেদিন রাসেল প্রথম চাকরিতে যোগ দিতে ঢাকা গেল, বাবা-মা তাঁকে বিদায় জানালেন। মতিন বললেন,
“সৎভাবে কাজ করো, মানুষের উপকার করো। তবেই আমার স্বপ্ন পূরণ হবে।”
রাসেল মাথা নিচু করে বলল,
“তোমার সব কষ্ট আমি বৃথা যেতে দেব না, বাবা।”
বছর কয়েক পর…
রাসেল তখন একজন দায়িত্বশীল ডাক্তার । পরিবারের অবস্থাও অনেক ভালো হয়ে গেছে। একদিন সে গ্রামে ফিরে এল। বাবাকে নতুন একটা পাকা ঘর উপহার দিল।
কিন্তু মতিন তখন খুব দুর্বল হয়ে পড়েছেন। একদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রাসেলের হাত ধরে বললেন,
“বাবা, আমি এখন নির্ভার। তুমি সফল হয়েছো। আমার আর কোনো চাওয়া নেই।”
কিছুদিন পর মতিন মারা গেলেন। কিন্তু তাঁর শিক্ষা, ত্যাগ, আদর্শ রয়ে গেল রাসেলের হৃদয়ে।
আজ রাসেল যখন কোনো দরিদ্র বাবাকে সন্তানদের জন্য সংগ্রাম করতে দেখে, তখন সে নিজের বাবার কথা মনে করে। সে জানে, একজন আদর্শ পিতা সন্তানের জন্য যা করতে পারে, তা পৃথিবীর কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না।
এক আদর্শ পিতা


০
০
সেভ বা রিয়েক্ট করার জন্য লগইন করে নিন!
১৩৪
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন