নাটোর শহরের এক ঐতিহ্যবাহী বহুবছর আগের বেড়ে ওঠা একটি পুরনো বটগাছের নিচে বসে আছে শহিদুল চাচা। তার পাশে বসে আছে ছোট্ট মেয়ে আদিবা,বয়স মাত্র আট। প্রতিদিন বিকেলে আদিবা স্কুল থেকে ফিরে শহীদুল চাচার কাছে আসে, গল্প শোনে। কিন্তু কেন যেন, আজ চাচা একটু উদাস, বসে কি যেন ভাবছেন।
— “চাচা,আজ কোনো গল্প বলবেন না?”আদিবা জিজ্ঞাসা করল।
শহিদুল চাচা মৃদু হেসে বললেন,”আজ একটা সত্য গল্প বলব,তুই শোনবি মা?”
— আদিবা বলে উঠলো,”সত্য গল্প”? তাহলে তো মজাই হবে চাচা!”
শহিদুল চাচা একটু সময় নিয়ে বলতে শুরু করলেন, “অনেক বছর আগে, এই শহরে এক ছেলে ছিল আমার মতোই। তার নাম ছিল শিমুল। খুব গরিব ছিল সে, কিন্তু খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন, পড়াশোনা করতে খুবই ভালোবাসত।”
— “তারপর?” আদিবা খুব কৌতূহলী হয়ে বলল।
— “শিমুল অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া চালিয়ে গেল। দিনের বেলা চায়ের দোকানে কাজ করতেন, রাতের বেলা বাড়ির পেছনে রাস্তার পাশে দেওয়া পৌরসভার বাতির আলোয় বই পড়তেন। এলাকার স্কুল, কলেজ গুলো খুব কৃতিত্বের সাথেই শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে ঢাকায় চলে গেলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে, একদিন সে বড় একটি চাকরি পেলেন। ঢাকা শহরে গড়ে তুললেন অঢেল সম্পদ,গাড়ি- বাড়ি ,কোন কিছুতেই তার কোন কমতি ছিল না। এ কথাগুলো বলতে বলতেই হঠাৎ …….”
শহিদুল চাচার গলা একটু কেঁপে উঠল। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে শুরু করলো।
— “তারপর কী হলো?”আদিবা অধীর আগ্রহ নিয়ে বলল।
— “তারপর আর এ শহরে কখনো ফিরে আসেনি । তার মা-বাবা, পুরোনো বন্ধু- বান্ধব, সবাইকে ভুলে গেল। নতুন গাড়ি, বড়-বাড়ি,শহুরে জীবন—সবই পেল, কিন্তু শিকড় ভুলে গেল।
আদিবা চুপ হয়ে গেল। একটু পরে বলল, “চাচা, আপনি শিমুলকে চেনেন?”
শহিদুল চাচা একটু হাসলেন, চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠল। তারপর ধীরে বললেন, “আমি-ই সেই হতভাগা শিমুল রে মা।”
আদিবা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। “তাহলে আপনি ফিরে এলেন কেন, চাচা?”
শাহিদুল চাচা অনেকক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “যখন আমার মা মারা গেল, আমি আসতে পারিনি কি হতভাগা দেখ-নারে মা। যখন বাবাকে দাফন করা হলো, আমি অফিসের কাজে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে তখনো আসি নাই। একসময় বুঝতে পারলাম, আমার এত বড় বাড়ি ,গাড়ি কিন্তু সেখানে আপন বলে কেউ নেই। এত টাকা-পয়সা আছে, কিন্তু শান্তির ছিটেফোঁটাও নেই। তাই ফিরে এলাম… কিন্তু এতদিন পর কেউ কি আর আমাকে আপন করে নেবে বল না মা?”
আদিবা ছোট্ট হাতে শহিদুল চাচার চোখের পানি মুছে দিয়ে, জড়িয়ে ধরল। মিষ্টি হেসে বলল, “আমি তো আছি চাচা!”
বিকেলের রক্তিম আলো শহিদুল চাচার চোখে এসে পড়ল, ঠোঁটের কোণে একটু মৃদু হাসি ভেসে উঠলো। হয়তো দীর্ঘদিন পর শহিদুল চাচা একটু প্রশান্তির ছোঁয়া পেলেন।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন