ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। গ্রামের প্রান্তে একটি কাঁচা ঘর। বাঁশের বেড়া, টিনের চালা। উঠোনে পাতা কাঁঠাল পাতার উপর জিইয়ে রাখা চুলার ধোঁয়া কেবল জানান দেয়—এ ঘরে এখনও কেউ বেঁচে আছে।
বৃদ্ধা রিজিয়া বেগম ধীরে ধীরে দরজার পাশে এসে বসেন। তার চোখ দুটি এখন আর স্পষ্ট দেখে না। কিন্তু অপেক্ষা তো চোখে নয়, মনেই সবচেয়ে বেশি করে জমে থাকে।
তার একমাত্র ছেলে—রাব্বি। বছর দশেক হলো শহরে চলে গেছে চাকরির খোঁজে। শুরুতে নিয়ম করে ফোন দিত। মায়ের পছন্দের লাল রেশমি ওড়না, ঈদের শাড়ি, মাঝেমধ্যে কিছু টাকা পাঠাত।
তখন রিজিয়া বুক ফুলিয়ে বলতেন, “আমার ছেলে বড় হয়েছে। অফিস করে শহরে!”
কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ফোন থেমে গেল। রাব্বির জীবন বদলে গেল, ঠিক শহরের মোড় ঘুরে যাওয়া রিকশার মতো। এখন কেবল বছরে একবার হয়তো ফোন করে। তাও হয়তো ভুল করে।
আজ ঈদের আগের দিন। গোটা গ্রাম সাজছে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন জামায় খুশি। আর রিজিয়া?
সে বসে আছে ঘরের কোণে, পুরনো এক কাঠের বাক্স খুলে তার ছেলের ছোটবেলার জামা বের করে। তাতে এখনো লেগে আছে সেই শিশুর গন্ধ, যে তাকে “জান আম্মা” বলে ডাকতো।
দুপুরে পোষ্টম্যান এলো।
একটা পার্সেল। ভেতরে একটা দামি জামদানি শাড়ি, একটা চকচকে মোবাইল আর একটি চিরকুট:
“আম্মা, ঈদ মোবারক। সময় পাই না, তাই আসতে পারলাম না। তোমার জন্য এটা পাঠালাম। ভালো থেকো। দোয়া কইরো।
—তোমার রাব্বি”
রিজিয়া চোখের পানি লুকাতে পারেন না।
মোবাইলটা হাতে নেন।
অদ্ভুত এক যন্ত্র।
তিনি বোঝেন না এই যন্ত্রে স্পর্শের উষ্ণতা নেই, নেই কান্নার গন্ধ।
সে হঠাৎ মুখ তুলে চিৎকার করে উঠেন,
— “রাব্বি, আমার শুধু একটুখানি দেখা লাগত রে… তুই একবার বললি না—’আম্মা, আমি আসতেছি।’ জামদানির চেয়ে তো তোর কোলে মাথা রাখা বেশি দামী ছিল আমার কাছে!”
পাশের বাড়ির বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে। কারও মা খিচুড়ি রান্না করছে, কেউ গায়ে চুন মাখিয়ে ঈদের সকালে স্নানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আর রিজিয়া?
সে বিছানায় বসে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করছে।
কিন্তু চোখের জল থামে না।
কারণ সেই জল মোবাইলের স্ক্রিনে পড়ে না।
সে পড়ে বুকের ভিতর—যেখানে “মা” শব্দটা এখন শুধু স্মৃতি হয়ে আছে।
রাতে গ্রামের মসজিদ থেকে ঈদের তাকবীর ভেসে আসে।
আকাশে চাঁদ উঠেছে।
রিজিয়া জানালার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলেন,
— “ঈদের চাঁদ দেখতে আসবি না রাব্বি? তোর জান আম্মা এখনো চেয়ে থাকে…”
দূরে কোথাও বাজি ফোটে।
আকাশে চাঁদের আলো পড়ে জলের মতো।
আর উঠোনে পড়ে থাকে এক বৃদ্ধা মায়ের কান্না—
যা শুনে না তার প্রিয় সন্তান,
শুনে কেবল রাতের বাতাস।
মায়ের কান্না


০
০
সেভ বা রিয়েক্ট করার জন্য লগইন করে নিন!
৮৮
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন