জলপথে দেখা
জলপথে দেখা

গল্প - জলপথে দেখা

লেখক: অন্তর ঘোষ
প্রকাশ - শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ধরণ: ভালোবাসা

সন্ধ্যার আলো মিশে গেছে গোধূলির রঙে। নদীর বুকে ঢেউ খেলে যায়, আর মাঝি তার সুরেলা গলায় গেয়ে ওঠে—”ও মাঝি, ও মাঝি, পাল তুলে দে।” এমন এক নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল অনিন্দিতা। হাতে ছোট্ট একটি খাতা, তাতে কখনো কিছু লিখছে, কখনো নদীর দিকে তাকিয়ে গভীর কোনো ভাবনায় হারিয়ে যাচ্ছে।

অনিন্দিতা শহরের মেয়ে। লেখালেখি তার নেশা। কয়েকদিনের জন্য সে এসেছিল এই নদীতীরের গ্রামে। প্রকৃতি যেন তাকে টানছিল। আর নদীর সৌন্দর্যে সে যেন মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল।

নদীর অপর পাড় থেকে একটি ছোট নৌকা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল। নৌকায় একজন যুবক দাঁড়িয়ে। নাম অরিত্র। তার জীবন নদীর মতোই সরল, শান্ত। বাবার কাছ থেকে নৌকা চালানোর কাজ শিখেছে, আর এই কাজই তার জীবিকা।

অরিত্র নৌকা নিয়ে ঘাটে ভিড়তেই অনিন্দিতার চোখ তার উপর পড়ে। ছেলেটির চেহারায় এক ধরনের গভীরতা, যেন তার মধ্যে কোনো লুকানো গল্প লুকিয়ে আছে।

“তোমার নৌকায় চড়তে পারি?” অনিন্দিতা জিজ্ঞাসা করল।
অরিত্র একটু অবাক হলেও মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। “নিশ্চয়ই, বসুন।”

নৌকা চলল নদীর মাঝখানে। অনিন্দিতা নদীর জল স্পর্শ করে বলল, “তুমি প্রতিদিন এই নদীর বুকে থাকো। কী মনে হয়? নদী কি কখনো কথা বলে?”
অরিত্র হাসল। “নদী সবসময় কথা বলে। শুধু শুনতে জানতে হয়। আপনি কি শুনতে চান?”

এইভাবে শুরু হল তাদের আলাপ। অরিত্র তার নদী আর গ্রামের কথা বলল, আর অনিন্দিতা শোনাল শহরের কোলাহল আর তার লেখার গল্প।

দিনের পর দিন অনিন্দিতা আসত নৌকায়। অরিত্র তাকে নদীর গল্প শোনাত। কিন্তু এই বন্ধুত্ব যেন ধীরে ধীরে অন্য এক অনুভূতিতে রূপ নিচ্ছিল।

একদিন নৌকায় বসে অনিন্দিতা হঠাৎ বলল, “তোমার কি মনে হয়, নদী কি শুধু প্রবাহিত হওয়ার জন্য, নাকি থেমে যাওয়ারও কোনো ইচ্ছে থাকে?”
অরিত্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “নদী থেমে যেতে পারে না। কিন্তু যদি তার পথের ধারে কেউ অপেক্ষা করে, তাহলে সে সবসময় ফিরে আসার পথ খুঁজে নেয়।”

এরপর দিনগুলো কেটে গেল। অনিন্দিতার গ্রামে থাকার সময় শেষ হয়ে এল। যাওয়ার আগে সে একটি চিঠি রেখে গেল অরিত্রের নৌকায়। তাতে লেখা ছিল—
“নদীর মতো আমি বয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তোমার কাছে ফিরে আসার পথ খুঁজে নেব। অপেক্ষা করো।”

অনিন্দিতা চলে গেল। অরিত্র আবার তার নৌকা নিয়ে নদীর বুকে চলতে শুরু করল। কিন্তু প্রতিদিন নদীর বুকে সে খুঁজে বেড়ায় একটি প্রতিশ্রুতির ছায়া।

সময়ের প্রবাহে কেটে গেল অনেক দিন। কিন্তু একদিন নদীর ঘাটে আবার নৌকা থামল। শহরের এক মেয়ে এসে দাঁড়াল। তার চোখে ছিল সেই চেনা আলোর ঝিলিক।

“আমি ফিরে এসেছি,” অনিন্দিতা মৃদু হেসে বলল।
অরিত্র গভীরভাবে তাকিয়ে বলল, “আমি জানতাম, নদী ফিরে আসবেই।”

নদীর ঢেউ তাদের কথাগুলো নিজের বুকে নিয়ে সুর তুলল। যেন প্রকৃতি নিজেই তাদের মিলনের গান গাইতে শুরু করল।

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ৮১ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন