মায়াপতন
—নেশান্তপ্রতীক আশরাফ
বিকেলটা ছিল অদ্ভুত শান্ত। আকাশে মেঘ নেই, বাতাসেও কোনো হালকা দোলা নেই। আমি ক্রিকেট খেলতে গিয়ে হাতে সামান্য একটা ব্যথা পেয়েছিলাম। বেশি কিছু নয়, তবু ব্যথা যেন না বাড়ে—এই ভেবে ফার্মেসির দিকে হাঁটছিলাম।
রাস্তার মোড়ে গিয়ে হঠাৎ পা থমকে গেল।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে নিলু।
কতদিন পর তার দেখা! বিয়ের পর এ প্রথমবার। এক হাতে ছোট্ট লাগেজ, আরেক হাতে বড় মোবাইল ফোন। পাশে একজন পুরুষ— চাপা গায়ের রং, মুখে হালকা দাড়ি, সাদা পাঞ্জাবি পরা। দেখে বোঝাই যাচ্ছিল, সে-ই নিলুর স্বামী।
নিলুকে দেখে বুকটা কেঁপে উঠল।
সে আজও আগের মতো মায়াবী, তার চোখ এখনো হরিণের মতো স্বচ্ছ। কিন্তু সেই চোখে আমার জন্য আর ভালোবাসা নেই। বরং ক্লান্তির ছাপ, জমে থাকা কান্না আর এক অদ্ভুত আক্ষেপ লুকিয়ে আছে। মনে হলো, আমাকে দেখা তার জন্যও কষ্টের।
নিলু যেন এক মুহূর্ত থামতে চাইছিল। আমি দেখলাম, তার চোখে কথা বলার আকাঙ্ক্ষা জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু ঠিক তখনই তার স্বামী হালকা ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে গেল। আর নিলু? সে থেমে থাকেনি। আমাকে না-চেনা মানুষের মতো পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল।
রাস্তার মাঝখানে গিয়ে একবার ফিরে তাকাল সে।
আমার দিকে। যেন নিশ্চিত হতে চাইছে— আমি কি এখনো তাকিয়ে আছি?
হ্যাঁ, আমি তখনও দাঁড়িয়ে।
আমার চোখের পানি লুকোতে পারিনি।
আমার মনে হলো, বুকের ভেতর কেউ প্রশ্ন ছুড়ে মারছে—
এই কি সেই নিলু?
যে একদিন বলেছিল— “তোমাকে আমি আমার জীবন থেকেও বেশি ভালোবাসি।”
এই কি সেই নিলু?
যার একটি আঘাতে আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম?নিলুকে দেখার পর আর হাঁটা গেল না।
ফার্মেসির পথটা হঠাৎই দীর্ঘ হয়ে গেল আমার কাছে। বুকের ভেতর তীব্র এক যন্ত্রণা নিয়ে রাস্তার একপাশে বসে পড়লাম। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, বুকের ভেতর যেন কেউ পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে একটু নড়াচড়া করতে পারলাম, তবু গন্তব্যের দিকে যাওয়ার শক্তি আর জুটল না।
মন বারবার বলছিল— “তার সাথে অন্তত একবার কথা বলি…”
কিন্তু সেই সঙ্গে ভয়ও হচ্ছিল— “আমার কারণে যদি তার সুখের সংসারে কোনো অশান্তি লাগে!”
নিজেকে যতবার বুঝিয়েছি, ততবারই বুকের ভেতর সেই পুরনো কষ্টগুলো জেগে উঠেছে।
অবশেষে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। ফোন বের করে তার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সীমাকে কল দিলাম।
আমি: আসসালামু আলাইকুম।
সীমা: ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছেন ভাইয়া?
আমি: ভালো। তুমি কেমন আছ?
সীমা: আলহামদুলিল্লাহ ভালো। কিন্তু ভাইয়া আজ হঠাৎ কল দিলেন? কোনো দরকারি ব্যাপার?
আমি: হুম… আজ নিলুকে দেখলাম। বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। সাথে একজন ছিল… স্বামী মনে হলো।
সীমা: ওহ্! ভাইয়া, আপনাকে তো বলা হয়নি নিলু আসবে। দেখা হলো নাকি তার সাথে?
আমি: হুম, রাস্তার মধ্যে দেখা হলো, তবে কথা হয়নি। বোন… প্লিজ… একবার তার সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিও, শুধু একবার।
ফোনের ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর সীমার কণ্ঠ ভেসে এলো—
সীমা: ভাইয়া, কান্না করবেন না প্লিজ। আপনি নিজেকে সামলান। আপনি কি ছিলেন, আর এখন কি হয়েছেন—এটা কি ভেবেছেন? সে তো সুখে আছে… সুখেই আছে এখন।
আমি: বোন, এসব কথা এখন রেখো। আমি শুধু একবার… একবারই কথা বলতে চাই তার সাথে। প্লিজ, ব্যবস্থা করে দাও।
সীমা: আচ্ছা… আমি চেষ্টা করছি।
ফোন কেটে গেল।
রাস্তার ধারে বসে আমি তখনো ভাবছিলাম— “একবার কথা বলতে পারলেই হয়তো বুকের ভেতর জমে থাকা এই আঘাতটা একটু হলেও হালকা হবে।”
কিন্তু মনের গভীরে একটা ভয় তখনো কুরে কুরে খাচ্ছিল— “আমার উপস্থিতি যদি তার হাসিখুশি সংসারে কোনো দুঃখের ছায়া ফেলে?”
সীমাকে কল করার পর থেকে সময়টা কেমন যেন থমকে গেল। রাস্তার ধারে বসে আমি অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। প্রতি মিনিটে মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতর কেউ পাথর চেপে রেখেছে।
প্রায় আধঘণ্টা পরে সীমার কল এল।
সীমা: ভাইয়া, আপনি আছেন?
আমি: হ্যাঁ… বলো।
সীমা: আমি ওর সাথে কথা বলেছি।
আমি: (হঠাৎ শ্বাস ভারী হয়ে গেল) সে কি রাজি হয়েছে আমার সাথে কথা বলতে?
সীমা: ভাইয়া… সে খুব শান্ত স্বরে বলেছে— “আমাকে এভাবে ডাকার দরকার নেই। আমি এখন সুখে আছি। পুরনো কিছু মনে করিয়ে লাভ কি?”
আমি: (চুপ)…
সীমা: ভাইয়া, সে কাঁদছিল। ওর কণ্ঠে কান্না লুকানোর চেষ্টা ছিল, কিন্তু আমি বুঝেছি। সে শুধু বলেছে— “ওকে বলো, আমার জন্য কষ্ট না পেতে। আমি ভালো আছি, ও যেন নিজের ভালোটা খুঁজে নেয়।”
ফোনের ওপাশের শব্দ যেন আর স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম না। চোখের পানি ঝাপসা করে দিচ্ছিল সবকিছু। সীমার কণ্ঠও যেন দূরে কোথাও মিলিয়ে যাচ্ছিল।
আমি ফোনটা কেটে দিলাম।
রাস্তার ধারে বসে বুকের ভেতর ফুঁপিয়ে উঠল এক অদ্ভুত কান্না। আমি নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম— “নিলু ভালো আছে… ও সুখে আছে… সেটাই তো চাইছিলাম, তাই না?
রাস্তার ধারে বসে ছিলাম কতক্ষণ—ঠিক মনে নেই। গাছের পাতাগুলো ঝিরঝির শব্দে যেন আমাকে ব্যঙ্গ করছিল, “কেন এমন করে বসে আছো? কার জন্য এত কষ্ট?”
মোবাইলটা পাশে রেখে নিঃশব্দে বসেছিলাম। আকাশ তখন লালচে হয়ে উঠেছে। সূর্য ডুবছিল ধীরে ধীরে, আর আমার বুকের ভেতর যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা জমে উঠছিল।
নিলুর কথাগুলো মাথায় ঘুরছিল—
“আমি এখন সুখে আছি… পুরনো কিছু মনে করিয়ে লাভ কি?”
হয়তো সত্যিই লাভ নেই। কিন্তু লাভ না থাকলেই কি ভালোবাসা মুছে যায়?
চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল তার পুরনো হাসি। যে হাসিতে আমি একসময় বেঁচে থাকার কারণ খুঁজতাম।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই দিনটার কথা—
একটা বৃষ্টিভেজা দুপুরে আমরা দুজন শহরের পুরনো পার্কে বসেছিলাম। নিলু চুপচাপ আমার কাঁধে মাথা রেখে বলেছিল—
“শোনো, যদি কখনো আমাকে হারিয়ে ফেলো, কাঁদবে তো?”
আমি তখন হেসে বলেছিলাম—
“তুমি ছাড়া আমি বাঁচবই না।”
নিলু আমার হাত শক্ত করে ধরে বলেছিল—
“আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যাব না।”
কিন্তু আজ? সেই নিলু অন্য একজনের হাত ধরে হাসিমুখে সংসার করছে। আর আমি? একা বসে নিজের কান্না লুকাচ্ছি।
ফোনটা আবার হাতে নিলাম। সীমাকে মেসেজ লিখলাম—
“বোন, ধন্যবাদ। আমি আর ওর সাথে কথা বলতে চাই না। বলো ওকে, সুখে থাকুক… আমি আর বিরক্ত করব না।”
মেসেজ পাঠিয়ে ফোনটা বন্ধ করলাম।
কিন্তু বুকের ভেতর প্রশ্নটা তখনো নিঃশব্দে কাঁদছিল—
“নিলু সুখে আছে, তাই তো? ও কি সত্যিই সুখে আছে?”
সেদিন আর ফার্মেসিতে যাওয়া হয়নি। ধীরে ধীরে উঠে রাস্তার বিপরীতে থাকা একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। দোকানদার গরম চা এগিয়ে দিল, আমি চুপচাপ কাপ হাতে নিয়ে বসে রইলাম।
চায়ের ধোঁয়া আমার মুখের সামনে ভেসে উঠছিল, কিন্তু চোখের পানি ঝাপসা করে দিচ্ছিল সবকিছু।
রাতে বাসায় ফিরে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো, নিলুর চোখে জমে থাকা সেই কান্নার আড়ালে হয়তো একটা অদ্ভুত সত্যি লুকিয়ে আছে—
ও কি সত্যিই সুখে আছে?
নাকি আমাকেই বোঝানোর জন্য হাসিমুখে অভিনয় করছে?
সেই রাতে ঘুম আসেনি একফোঁটাও।
রাতটা ছিল অদ্ভুত নিস্তব্ধ।
ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। রাস্তার বাতি নিভে গিয়ে অন্ধকারে ডুবে গেছে সবকিছু। কিন্তু আমার ভেতরের অন্ধকার তার থেকেও গভীর।
হঠাৎ মনে হলো—
যদি এখন নিলু আমার সামনে এসে দাঁড়াত! যদি একবার বলত—
“তুমি কি আমাকে এখনো ভালোবাসো?”
তাহলে কি আমি মিথ্যে বলতে পারতাম?
না, পারতাম না।
বালিশের ওপর মুখ লুকিয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠতে লাগল—
সেই দিনটা মনে পড়ে…
শীতের সকালে আমি কলেজের মাঠে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নিলু হালকা নীল শাল গায়ে জড়িয়ে আমার দিকে দৌড়ে এসেছিল। শ্বাসপ্রশ্বাসে কণ্ঠ কাঁপছিল, তবু হাসি ছিল মুখে।
সে আমার হাত ধরে বলেছিল—
“তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
তারপর ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট নোটবুক বের করে হাতে দিয়েছিল।
নোটবুকের প্রথম পাতায় তার হাতের লেখা—
“তোমাকে ছাড়া আমার একটা দিনও সম্পূর্ণ হয় না। তুমি আমার সকাল, তুমি আমার রাতের একমাত্র শান্তি।”
সেই নোটবুক আমি আজও রেখে দিয়েছি, বুকের গোপন ড্রয়ারে। কখনো খুলে দেখি না, তবু ফেলে দিতেও পারি না।
আরেকটা স্মৃতি…
বর্ষার দুপুরে আমরা দুজন বাসের শেষ সিটে বসে যাচ্ছিলাম কক্সবাজারের দিকে। হালকা বৃষ্টি পড়ছিল, আর নিলু হেসে আমার কাঁধে মাথা রেখেছিল। সে হঠাৎ ফিসফিস করে বলেছিল—
“জানো, আমি যদি মরে যাই, তুমি কি আর বিয়ে করবে?”
আমি চমকে গিয়ে বলেছিলাম—
“পাগল হয়েছ নাকি! তুমি ছাড়া আমি কাউকে কল্পনাও করতে পারি না।”
সে হাসি চেপে রেখেছিল, কিন্তু চোখের কোণে একটা অদ্ভুত ভালোবাসা ছিল। আমি সে দিন বিশ্বাস করেছিলাম— নিলু কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না।
কিন্তু আজ?
সে অন্য কারো হাত ধরে সংসার করছে।
মনে হলো, বুকের ভেতর কেউ পাথর ছুঁড়ে মারছে। আমি হঠাৎ উঠে ড্রয়ার খুলে সেই পুরনো নোটবুক বের করলাম। পাতাগুলো উল্টাতে গিয়ে হাত কাঁপছিল। প্রতিটি পাতায় তার হাতের লেখা, তার হাসি, তার ভালোবাসা— সব যেন আমাকে কাঁদিয়ে তুলছিল।
শেষ পাতায় লেখা ছিল—
“তুমি আমার জীবনের শেষ ঠিকানা। যদি কখনো আমাকে ভুলে যাও, আমি হয়তো বাঁচব, কিন্তু বাঁচা মানে তখন আমার কাছে কেবল নিঃশ্বাস নেওয়া হবে।”
আমি নোটবুকটা বুকের কাছে চেপে ধরলাম। চোখের পানি ভিজিয়ে দিল পাতাগুলো। মনে হচ্ছিল, নিলুর কণ্ঠে সেই কথাগুলো আবার শুনছি।
কিন্তু একই সঙ্গে বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত তিক্ত প্রশ্নও জেগে উঠল—
“যে মেয়েটা একসময় বলেছিল, আমি তার শেষ ঠিকানা… সে কি সত্যিই সুখে আছে আজ? নাকি কোনো কারণ আছে, যার জন্য আমাকে ছেড়ে যেতে হয়েছে?”
এই প্রশ্নটাই আমাকে রাতে ঘুমাতে দিল না।
আমি জানি না, নিলুর জীবনে কী ঘটেছিল। শুধু জানি—আমি তাকে আজও ভুলতে পারিনি।
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা।
ঘর নিস্তব্ধ, শুধু দেয়ালের ঘড়ির টিকটিক শব্দ। আমি বিছানায় আধশোয়া হয়ে নিলুর দেওয়া পুরনো নোটবুকটা বুকে চেপে রেখেছিলাম। চোখের পাতা ভারী হলেও ঘুম আসছিল না।
হঠাৎ মোবাইলটা কেঁপে উঠল।
অপরিচিত একটা নাম্বার।
প্রথমে ধরব কি না ভাবছিলাম। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বুকের ভেতর একটা শিহরণ জেগে উঠল—মনে হচ্ছিল, এই কলেই আমার জীবনটা উল্টে যেতে পারে।
কল ধরলাম। ওপাশ থেকে প্রথমে নিঃশব্দ শ্বাসের শব্দ, তারপর এক পরিচিত কণ্ঠ—
নিলু!
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কয়েক সেকেন্ড কেউ কিছু বলল না।
তারপর নিলুর কণ্ঠ কেঁপে উঠল—
নিলু: “তুমি… তুমি জেগে আছো?”
আমি এক মুহূর্তে উত্তর দিতে পারলাম না। গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। তবু কোনোভাবে বললাম—
আমি: “হ্যাঁ… তুমি?”
নিলু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর নিঃশব্দে বলল—
নিলু: “তোমার সাথে কথা বলা ঠিক হলো কি না জানি না… তবু পারলাম না চুপ থাকতে।”
আমার বুক কেঁপে উঠল। আমি আস্তে জিজ্ঞেস করলাম—
আমি: “তুমি সুখে আছো তো? সীমা বলেছিল…”
ওপাশে হঠাৎ এক তিক্ত হাসি ভেসে এল। তারপর নিলুর কণ্ঠ ভেঙে গেল—
নিলু: “সুখ? হ্যাঁ, সবাই ভাবে আমি সুখেই আছি। তুমি-ও তাই ভাবছো, তাই না? কিন্তু তুমি জানো, হাসতে হাসতে আমি কতবার ভেতরে মরে যাই?”
আমি নিঃশ্বাস আটকে তার কথা শুনছিলাম।
নিলু: “বিয়েটা আমার ইচ্ছায় হয়নি। পরিবারের চাপে… বাবার অসুস্থতার কথা ভেবে… আমি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি জানতাম, তুমি লড়তে, তুমি আমার জন্য কিছু একটা করতে—কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই তোমাকে দূরে ঠেলেছিলাম।”
আমি অবাক হয়ে বললাম—
আমি: “তুমি… তুমি আমাকে ভালোবাসতে না?”
ওপাশে হঠাৎ কান্নার শব্দ।
নিলু: “ভালোবাসি না? আজও যদি পারতাম, সব ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসতাম। কিন্তু তুমি কি জানো, বাবার শপথ ভেঙে গেলে তিনি হয়তো বাঁচতেন না? আমি তাই চুপ করে থেকে নিজের জীবনটা বিকিয়ে দিয়েছি। তুমি যদি ঘৃণা করো, করো। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম, তুমি যেন বেঁচে থাকো… সুখে থাকো…”
তার কণ্ঠ কেঁপে উঠছিল। আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছিল না।
নিলু: “তোমাকে দেখে আজ রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে মন চাইছিল। মনে হচ্ছিল, দৌড়ে গিয়ে বলি—‘আমি এখনো তোমারই…’। কিন্তু পারিনি। আমি এখন কারো স্ত্রী, তোমার জীবনে ঝড় তোলা আমার উচিত নয়।”
নিলুর কান্নার শব্দ আমার বুকের ভেতর পাথরের মতো আঘাত করছিল। আমি ধীরে বললাম—
আমি: “নিলু… তুমি যদি সুখে না থাকো, তাহলে কি আমি কিছু করতে পারি না?”
নিলু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ভাঙা গলায় বলল—
নিলু: “তুমি কিছু করবে না। তুমি শুধু বেঁচে থেকো… আর আমাকে ভুলে যাও। আমাকে ভুলে যাওয়াটাই হবে আমার জন্য সবচেয়ে বড় ভালোবাসা।”
এরপর হঠাৎ লাইন কেটে গেল।
আমি মোবাইলটা কানে চেপে ধরে অনেকক্ষণ বসে রইলাম। শব্দহীন কান্না আমার গাল ভিজিয়ে দিচ্ছিল। নিলুর কথাগুলো কানে বাজছিল বারবার—
“আমাকে ভুলে যাও… ভুলে যাওয়াটাই হবে আমার জন্য সবচেয়ে বড় ভালোবাসা…”
কিন্তু আমি কি পারব তাকে ভুলতে? বুকের ভেতর তো এখনও সেই পুরনো নিলু বেঁচে আছে।
সেই রাতে আর ঘুম এল না। মনে হচ্ছিল, নিলুর কান্না যেন আমার বুকে ঢেউ তুলে যাচ্ছে।
সকালে ঘুম ভাঙতেই মোবাইলটা কেঁপে উঠল। অচেনা নম্বর।
ঘুম জড়ানো চোখে কল ধরতেই এক নারীকণ্ঠ আতঙ্কিত স্বরে বলল—
“আপনি কি ইফাদ ভাই? নিলু আপার খুব বড় দুর্ঘটনা হয়েছে!”
আমার বুক হঠাৎ কেঁপে উঠল। ঘুম এক মুহূর্তে উড়ে গেল।
আমি: “কী? কোথায়? সে কেমন আছে?”
কণ্ঠটা কেঁপে উঠল—
“হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। রিকশা থেকে নামতে গিয়ে একটা মোটরসাইকেল ধাক্কা মেরেছে… রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। আপনি চাইলে আসতে পারেন।”
কল কেটে গেল।
আমি কিছু না ভেবেই তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম।
হাসপাতালের করিডরে পৌঁছাতেই তীব্র স্যালাইন আর ওষুধের গন্ধে বুক কেমন যেন ভেঙে যাচ্ছিল। আমি দূর থেকে নিলুর শোয়া অবস্থা দেখলাম—
সে সাদা বিছানায় শুয়ে আছে, ডান হাত ব্যান্ডেজে মোড়া, মাথার পাশে স্যালাইন ঝুলছে। চুলগুলো এলোমেলো, মুখটা ফ্যাকাসে।
তার স্বামী পাশেই বসে আছে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে চোখে কোনো আতঙ্ক নেই। বরং মুখে বিরক্তির ছাপ।
নিলু ধীরে চোখ খুলে আমাকে দেখতে পেল। তার চোখে এক মুহূর্তের জন্য অদ্ভুত আলো ঝলক দিল। হয়তো অবাক, হয়তো স্বস্তি।
আমি কাছে গিয়ে আস্তে বললাম—
আমি: “কেমন লাগছে তোমার?”
নিলু কষ্টের হাসি দিল—
নিলু: “তুমি… তুমি কেন এলে? তোমার আসা উচিত হয়নি।”
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললাম—
আমি: “তোমার কষ্টের সময় আমি কীভাবে চুপচাপ বসে থাকব?”
নিলু কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু ঠিক তখনই তার স্বামী বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল।
নিলুর স্বামী: “আপনি কে? কেন এসেছেন এখানে?”
তার কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি। আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তখনই সীমা হঠাৎ পাশ থেকে এসে বলল—
সীমা: “সে নিলুর পুরনো বন্ধু। আপা, চিনবেন না। আর হ্যাঁ, আপনিও যদি একটু শান্ত থাকতেন ভালো হতো।”
নিলুর স্বামী কিছু না বলে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি চুপচাপ নিলুর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওর চোখে হঠাৎ পানি চলে এল। সে ফিসফিস করে বলল—
নিলু: “তুমি জানো, আমার জীবনটা কতটা মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে?”
আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম।
আমি: “কী বলতে চাইছো?”
নিলু ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলতে লাগল—
নিলু: “যে গল্পটা তোমাকে বলেছিলাম… বাবার অসুস্থতা… আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে… সবটা ছিল সাজানো। বাবার অসুস্থতা ছিল নাটক। আমি নিজেই… আমি নিজেই এই বিয়েটা চেয়েছিলাম।”
আমার বুক হঠাৎ পাথরের মতো ভারী হয়ে গেল।
আমি: “কেন? তুমি আমাকে এত বড় মিথ্যা বললে?”
নিলু চোখ বন্ধ করল।
নিলু: “কারণ আমি ভেবেছিলাম… আমি সুখ খুঁজব অন্য পথে। তুমি আমাকে খুব ভালোবাসতে, কিন্তু তোমার স্বপ্ন আর সংগ্রামের ভেতর আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম। আমি স্বার্থপর ছিলাম ইফাদ। আমি ভেবেছিলাম, এই মানুষটার সাথে বিয়ে করলে আমি সবকিছু পেয়ে যাব…”
তার কণ্ঠ হঠাৎ থেমে গেল। আমি স্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
ঠিক তখনই সীমা আমাকে ধীরে ফিসফিস করে বলল—
সীমা: “ইফাদ ভাই, আপনি জানেন না, গতকাল রাতেই ঝগড়ার সময় নিলুর স্বামী তাকে ধাক্কা দিয়েছিল। রিকশা থেকে পড়ে সে আহত হয়েছে। লোকটা খুব রাগী। সে এখন নাকি কুমিল্লা চলে যাবে বলছে
আমি রাগ আর যন্ত্রণায় হাত মুঠো করে ফেললাম। নিলু চোখ মেলল, মুখে এক অসহায় হাসি ফুটল—
নিলু: “দেখলে, এটাই আমার সাজানো সুখের আসল রূপ। আমি ভুল করেছি, ইফাদ। তোমাকে হারিয়ে আমি কিছুই পাইনি।”
তার চোখ থেকে ধীরে ধীরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।
আমি চুপ করে তার হাতটা আলতো করে ধরলাম। কিছু বললাম না। শুধু মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতর এক অদ্ভুত ঝড় বইছে—
এই কি সেই নিলু, যে একদিন আমাকে পৃথিবীর শেষ ভালোবাসা বলেছিল?
এই কি সেই নিলু, যে আমাকে মিথ্যে বলে নিজেই কষ্টের জালে জড়িয়ে গেল?
নিলুর চোখ তখন আমার চোখে স্থির হয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল, সে যেন নীরবে বলছে—
“আমাকে বাঁচাও…”
দুপুরের দিকে নিলুর মুখে একটু রঙ ফিরেছে। ব্যান্ডেজ করা হাতটা স্যালাইনের পাশে স্থির পড়ে আছে, তবু তার চোখে যেন হালকা স্বস্তির ছাপ। আমি বিছানার পাশে বসে ছিলাম, নীরবে তার হাতের আঙুলগুলো আলতো ছুঁয়ে।
নিলু: “ইফাদ, তুমি এখন চলে যাও। তোমাকে কেউ ভুল বুঝলে আমি সহ্য করতে পারব না।”
আমি ধীরে বললাম—
আমি: “আমি যাব না। তুমি যতক্ষণ পর্যন্ত ভালো না হও, আমি এখানেই থাকব।”
নিলু চুপ করে আমার দিকে তাকাল। তার চোখে হাজারো না-বলা কথা জমে ছিল।
ঠিক তখনই হাসপাতালের দরজা জোরে খুলে গেল।
নিলুর স্বামী ভিতরে ঢুকল, মুখে স্পষ্ট রাগের ছাপ। তার সাথে আরও দুইজন লোক ছিল, হয়তো শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়।
সে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগিয়ে এল।
নিলুর স্বামী: “আপনি আবার এসেছেন এখানে? আমার স্ত্রীর কাছে আপনার কোনো দরকার নেই। বেরিয়ে যান।”
আমি স্থির কণ্ঠে বললাম—
আমি: “নিলু এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। তাকে অন্তত সুস্থ হতে দিন।”
সে হঠাৎ আমার কলার ধরে টেনে তুলল।
নিলুর স্বামী: “আপনি কে হবেন নিলুর? কী সম্পর্ক আপনার সাথে? আমার বউয়ের পাশে বসে নাটক করবেন না।”
আমি তাকে ঠেলে সরিয়ে দিলাম।
আমি: “নিলু শুধু আপনার স্ত্রী নয়, সে একজন মানুষও। তাকে অসম্মান করার অধিকার আপনার নেই।”
নিলু ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল—
নিলু: “প্লিজ, ইফাদ, কিছু কোরো না। ও রাগ করলে বিপদ হবে…”
কিন্তু নিলুর স্বামী তখন আরও রেগে গিয়ে চিৎকার করে উঠল—
নিলুর স্বামী: “তোমার এত সাহস কোথা থেকে এল? আমার বউয়ের সাথে পুরনো প্রেমের নাটক সাজাতে এসেছ?”
সে আবার আমার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছিল, কিন্তু হাসপাতালের এক নার্স এসে আমাদের আলাদা করল।
দুপুরের দিকে নিলুর শারীরিক অবস্থা একটু ভালো হলো। কিন্তু এর আগেই তার স্বামী দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করল—
নিলুর স্বামী: “ডাক্তার অনুমতি দিয়েছেন। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছি।”
নিলু দুর্বল কণ্ঠে বলল—
নিলু: “আমি যেতে চাই না… আমাকে থাকতে দাও।”
কিন্তু তার স্বামী তার হাত ধরে টেনে তুলল। নিলু কষ্টে কেঁদে ফেলল, তবু তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলো না।
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, বুকের ভেতর তীব্র ক্ষোভ নিয়ে। কিন্তু নিলু আমাকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল—
তার চোখ যেন নীরবে বলল, “তুমি কিছু কোরো না, প্লিজ।”
নিলুর স্বামী তার লোকজনের সাথে মিলে তাকে হুইলচেয়ারে বসাল।
নিলু চোখের পানি মুছতে মুছতে একবার আমার দিকে তাকাল—সে দৃষ্টিতে ছিল অসহায়তা আর এক নিঃশব্দ আর্তি।
আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া দেখছিলাম।
হাসপাতালের করিডরে নিলুর কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু আমার বুকের ভেতর যেন পাথরের মতো জমে যাচ্ছিল এক অদ্ভুত যন্ত্রণা।
আমি নিজেকে বোঝাতে চাইছিলাম—
“নিলুর সুখের জন্যই তো আমি কিছু করছি না… কিন্তু এ কেমন সুখ, যেখানে তাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়?”
সেই মুহূর্তে মনে হলো, আমি আর চুপ করে থাকতে পারব না।
হাসপাতাল থেকে নিলুকে নিয়ে যাওয়ার পর আমি প্রায় সারারাত জেগে ছিলাম। তার কান্নাভেজা মুখটা চোখ থেকে সরাতে পারছিলাম না। বুকের ভেতর কেমন অস্থিরতা জমছিল, মনে হচ্ছিল—নিলুর জীবনে সবকিছুই যেন কোনো অদ্ভুত রহস্যে ঢাকা।
পরের দিন সকালে হঠাৎ সীমা আমার বাসায় এল। তার চোখ লাল, যেন সারারাত কেঁদেছে।
সীমা: “ইফাদ ভাই, আপনি জানেন না নিলু আপার জীবনে কী ভয়ঙ্কর সত্য লুকিয়ে আছে।”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম—
আমি: “কী বলছো তুমি?”
সীমা চেয়ার টেনে বসে ধীরে ধীরে বলতে লাগল—
সীমা: “আপনি জানেন, নিলুর স্বামী তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেনি। ওকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছিল। আসল উদ্দেশ্য ছিল নিলুর বাবার জমি-সম্পত্তি।”
আমার বুক হঠাৎ কেঁপে উঠল—
আমি: “কী! নিলু জানত এসব?”
সীমা দীর্ঘশ্বাস ফেলল—
সীমা: “না। সে সত্যিই ভেবেছিল ছেলেটা তাকে ভালোবাসে। কিন্তু বিয়ের কয়েক মাস পরই সব বুঝতে পেরেছিল। তার স্বামী বিয়ের আগেই অন্য এক মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখত। সেই প্রেমিকা আজও আছে। নিলু যখন এসব জানতে পারে, তখন থেকেই তার ওপর নির্যাতন শুরু হয়।”
আমি হতবাক হয়ে বসে রইলাম। সীমা কথা চালিয়ে গেল—
সীমা: “গত রাতের ঝগড়ার কারণও সেটা। নিলু আপা কিছুদিন আগে জানতে পেরেছে, ছেলেটা তার বাবার জমির কিছু অংশ বিক্রি করে প্রেমিকাকে দামি গিফট দিয়েছে। আপা প্রতিবাদ করায় ওর ওপর হাত তোলে। কাল রাতে রাগের মাথায় ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। এরপরই এই দুর্ঘটনা।”
আমার চোখের সামনে যেন আগুন জ্বলে উঠল। হাত দুটো মুঠো করে ফেললাম।
আমি: “আর নিলু এখনো এসব সহ্য করছে? কেন? কেন সে সব সহ্য করছে?”
সীমা চোখ মুছল—
সীমা: “আপা বলে—‘আমার সংসারটা ভেঙে গেলে বাবা সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না।’ সে আজও সব চেপে যাচ্ছে। কিন্তু ভাইয়া, এইভাবে আর কতদিন?”
আমার বুকের ভেতর তখন ঝড় বইছিল। মনে হচ্ছিল, আমি এখনই গিয়ে সেই মানুষটার মুখোমুখি হই। কিন্তু একই সঙ্গে একটা ভয়ও ছিল—নিলুর সংসারে ঝড় তোলা কি ঠিক হবে?
তবু মনে হচ্ছিল, আমি চুপ করে থাকলে নিলুর জীবনটা হয়তো ধ্বংস হয়ে যাবে।
আমি ধীরে বললাম—
আমি: “সীমা, তুমি আমার জন্য নিলুর সাথে যোগাযোগের একটা উপায় বের করবে। আমি তার সাথে কথা বলব। তাকে এভাবে আর কষ্ট পেতে দেব না।”
সীমা মাথা নাড়ল।
সীমা: “ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করব। কিন্তু সাবধানে। নিলু আপা এখনো কাউকে এসব বলতে চায় না। তবে আমি বুঝি, সে ভেতরে ভেতরে ভেঙে যাচ্ছে।”
সীমা চলে যাওয়ার পর আমি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাইরে রোদ উঠেছে, কিন্তু আমার বুকের ভেতর যেন এক ভয়ঙ্কর অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছিল।
আমি নীরবে প্রতিজ্ঞা করলাম—
“নিলুকে আর একদিনও এই নরকযন্ত্রণা সহ্য করতে দেব না। আমি ওকে বাঁচাব, যেভাবেই হোক।
রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। শহরের রাস্তাগুলো নিঃশব্দ হয়ে গেছে।
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, মনে অদ্ভুত এক অস্থিরতা। সীমার সাথে কথা বলার পর থেকে বারবার মনে হচ্ছিল—নিলুর সাথে কথা বলতে হবে। তাকে সাহস দিতে হবে।
হঠাৎ মোবাইলটা কেঁপে উঠল।
অপরিচিত নম্বর।
কল ধরতেই ওপাশে খুব চেনা, কিন্তু কাঁপা কণ্ঠ ভেসে এল—
নিলু: “ইফাদ… তুমি কথা বলবে আমার সাথে?”
আমার বুক কেঁপে উঠল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললাম—
আমি: “হ্যাঁ, নিলু। তুমি কেমন আছো?”
ওপাশে হঠাৎ কান্নার শব্দ শোনা গেল।
নিলু: “আমি… আমি ভালো নেই। আমি আর অভিনয় করতে পারছি না ইফাদ। আমি তোমাকে অনেক ঠকিয়েছি… আমার নিজের সুখের জন্য।”
আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠল।
নিলু: আমি ভেবেছিলাম, আমি আরেকটু ভালো জীবন পাব… বেশি স্বচ্ছল হব… আরাম পাব। আমি তোমার ভালোবাসা হারিয়ে নিজের সুখ খুঁজতে গিয়েছিলাম।”
ওর কান্না এবার স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।
নিলু: “কিন্তু শেষমেশ আমার কপালে সুখ লেখা ছিল না। আমি যে মানুষটার জন্য তোমাকে ছেড়েছি, সে আমাকে কখনো ভালোবাসেনি। সে কেবল আমার বাবার সম্পত্তি চেয়েছিল। আমি নিজের স্বপ্নে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম ইফাদ। তোমার মতো মানুষকে হারিয়ে আমি আসলে নিজেকেই হারিয়েছি।”
আমি চুপ করে শুনছিলাম। বুকের ভেতর কেমন একটা হাহাকার হচ্ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে নিলুর কান্না আমার সমস্ত রাগ গলিয়ে দিচ্ছিল।
নিলু থেমে থেমে আবার বলল—
নিলু: “তুমি আমাকে ঘৃণা করো ইফাদ। তুমি আমাকে অভিশাপ দাও। আমি তার যোগ্য। আমি তোমাকে ভালোবাসা দিয়ে ঠকিয়েছি, কষ্ট দিয়েছি, কিন্তু আজ বুঝতে পারছি—তোমার দেওয়া ভালোবাসার একটা বিন্দুও আমি ফিরিয়ে দিতে পারিনি।”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। চোখ ভিজে যাচ্ছিল। আস্তে বললাম—
আমি: “নিলু, তুমি ভুল করেছ… কিন্তু আমি তোমাকে ঘৃণা করতে পারি না। আমি যেদিন তোমাকে ভালোবেসেছিলাম, সেদিন থেকেই তোমাকে ক্ষমা করে দেওয়ার শক্তিটা নিজের ভেতর রেখে দিয়েছিলাম।”
ওপাশে হঠাৎ নীরবতা। তারপর নিলুর কান্নাভেজা কণ্ঠ ভেসে এল—
নিলু: “তুমি… তুমি কি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করেছ?”
আমি: “হ্যাঁ, নিলু। তোমাকে ক্ষমা না করলে হয়তো আমিই বাঁচতে পারতাম না। তুমি সুখী হও বা না হও, আমার ভালোবাসা তোমার জন্যই থাকবে। শুধু চাই, তুমি নিজেকে আর কষ্ট দিও না।”
নিলু হঠাৎ হালকা হেসে উঠল, যদিও সেই হাসির ভেতর কান্নার সুর মিশে ছিল—
নিলু: “তুমি এত ভালো কেন ইফাদ? আমি তো তোমার যোগ্যই নই।”
আমি: “ভালোবাসা কখনো যোগ্যতা দেখে হয় না, নিলু। ভালোবাসা শুধু হয়।”
ওপাশে কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। তারপর নিলু খুব আস্তে বলল—
নিলু: “ধন্যবাদ… ইফাদ। তুমি হয়তো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যি… যাকে আমি নিজের ভুলে হারিয়েছি।”
এরপর লাইন কেটে গেল।
আমি অনেকক্ষণ মোবাইলটা কানে ধরে বসে ছিলাম। নিলুর কান্নার শব্দ যেন আমার বুকের ভেতর গুঞ্জরিত হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল—
ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না, শুধু মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে তা মুছে ফেলার চেষ্টা করে।
নিলুর সাথে গোপন কথোপকথনের পর আমি বুঝতে পারলাম—
এবার শুধু কথা বলা বা সহানুভূতি দিয়ে কিছু হবে না। আমাকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে, নিলুর জন্য লড়তে হবে।
পরদিন সকালে আমি আইনজীবীর কাছে গেলাম।
একটা ফাইল হাতে নিয়ে নিলুর স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ, মানসিক নির্যাতন ও সম্পত্তি জোরপূর্বক দখলের মামলা করার ব্যাপারে কথা বললাম।
আইনজীবী একটু নীরব থেকে বলল—
“আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম—
“সীমা ও অন্যান্য ঘনিষ্ঠজনদের সাক্ষ্য আছে। হাসপাতালে নিলুর চিকিৎসার রিপোর্ট আছে। নিলুর স্বামীর দুর্ব্যবহারের অনেক রেকর্ড আছে।”
আইনজীবী একটু আশাবাদী হয়ে বলল—
“এখন প্রয়োজন দ্রুত পদক্ষেপ। নিলুকে নিরাপদ স্থানে রাখা জরুরি, আর মামলা করার জন্য যথাযথ দলিলপত্র তৈরি করতে হবে।”
আমি তড়িঘড়ি নিলু বাসা গেলাম। নিলু তখন বিছানায় অচেতন শুয়ে ছিল। আমি তার হাতে হাত রেখে ফিসফিস করে বললাম—
“আমি তোমার জন্য লড়ব, নিলু। তুমি আর একা নও।”
সীমা ও আমি দ্রুত তার কাছ থেকে নির্যাতনের প্রমাণ ও বিবরণ সংগ্রহ শুরু করলাম।
একদিন পর পুলিশ নিলুর স্বামীকে তলব করল।
স্বামী সাহস দেখিয়ে আসলেও আদালতে তাকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো।
তার স্বভাব, পারিবারিক পরিস্থিতি, এবং নিলুর যন্ত্রণার বর্ণনা আদালতে উঠে এল।
একদিকে নিলু, অন্যদিকে স্বামী।
আমার মনে হচ্ছিল, এই লড়াই দীর্ঘ হবে, কিন্তু নিলুর জন্য ন্যায় বিচার পাওয়াই সবচেয়ে বড় কথা।
একদিন হাসপাতালের বাগানে দাঁড়িয়ে নিলু আমাকে চোখে চোখ রেখে বলল—
“ইফাদ, তুমি আসল জীবনের হিরো। তুমি না থাকলে আমি বাঁচতাম না।”
আমি হাঁসতে হাসতে বললাম—
“নিলু, তোমার জীবনই এখন আমার লড়াই। আমি কখনো হারব না।”
সেই দিন থেকে শুরু হলো এক নতুন যুদ্ধ—
ন্যায়বিচারের জন্য, নিলুর জন্য, আর মানুষের জন্য যারা নির্যাতনের অন্ধকারে ঘুরছে।
মামলার লড়াই শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠল।
নিলুর স্বামী আর তার পরিবার কোনো রকম ছাড় দিতে চাইছিল না।
একদিন আমি সীমার কাছে খবর পাইলাম—
সীমা: “ইফাদ ভাই, বড় বিপদ এসেছে। নিলুর বাবাকে তারা ব্ল্যাকমেইল করছে।”
আমি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম—
আমি: “কীভাবে? তারা কী বলছে?”
সীমা গম্ভীর হয়ে বলল—
সীমা: “তারা বলছে, যদি বাবাজান নিলুর স্বামীকে আইনগত সমস্যায় ফেলেন, তবে তাদের হাতে আছে বাবার পুরনো কিছু গোপন ছবি এবং খবর, যা প্রকাশ পেলে বাবার সম্মান নষ্ট হবে। বাবাজান ভয় পেয়েছেন, এখন চাপা পড়ে গেছেন।”
আমি হতবাক হয়ে বললাম—
আমি: “কিন্তু নিলু জানে না এটা?”
সীমা মাথা নেড়েছিল—
সীমা: “না, আপা কিছুই জানে না। বাবাজান তাকে বুঝিয়ে বলছেন, এ নিয়ে আর বেশি কথা বলবে না। তোমার সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ রাখছে।”
পরদিন নিলু হঠাৎ আমার কাছে ফোন করল। কণ্ঠে ছিল অবিশ্বাস আর ব্যথা—
নিলু: “ইফাদ, আমি… আমি তোমার সঙ্গে আর কথা বলতে পারব না। বাবা আমাকে বলেছে, তোমার থেকে দূরে থাকো। সে চাইছে আমি স্বামীর পাশে থাকি।”
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম—
আমি: “নিলু, তুমি কি বুঝছো? ওরা তোমার বাবাকে ভয় দেখাচ্ছে, তোমার জন্য নয়। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।”
নিলু সেধে বলল—
নিলু: “আমি নিজের জন্যই করলাম, ইফাদ। বাবা বলছে, সংসার ভেঙে গেলে আমাদের সবাইয়ের সম্মান নষ্ট হবে। আমি আর কোনো ঝামেলায় যেতে চাই না।”
আমি নিঃশ্বাস আটকে বললাম—
আমি: “তুমি ভুল করছো, নিলু। কিন্তু আমি তোমাকে বাধ্য করতে পারব না।”
তখন ফোনের ওপাশ থেকে এক দীর্ঘশ্বাস এল।
নিলু: “ক্ষমা করো, ইফাদ। আমি তোমার পাশে থাকতে পারব না।”
কল কেটে গেল।
আমি মোবাইলটা ধরে ধরে ফেলে দিলাম।
আমার বুকের ভেতর একটা ভয়ানক শূন্যতা এসে বাস করল।
যে মানুষটাকে বাঁচানোর জন্য আমি লড়াই করছিলাম, সে আজ আমারই বিপরীতে দাঁড়িয়ে গেল।
তবুও, আমার মনে একটুও সন্দেহ ছিল না—
নিলু ভুলে গেছে, কিন্তু আমি ভুলব না।
আমি ফিরে আসব, তার জন্য যেখানেই থাকুক।
কোর্টরুমটা ছিল চাপা, অবরুদ্ধ এক পরিবেশ।
প্রত্যেক চোখ কেমন যেন কড়া নজরে তাকিয়ে। আমার হৃদস্পন্দন শোনাচ্ছিল কানে, হাত ঘামে ভিজে গেছে।
বিচারক মহোদয় তার চশমা নামিয়ে দেখে বললেন—
“এই মামলায় বিবেচনা করা হলো সমস্ত প্রমাণ, সাক্ষ্য এবং পক্ষ-পক্ষের যুক্তি।”
নিলু, আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, মুখে এক চরম দৃঢ়তা। তার চোখে কোনো নরমতা নেই, বরং তীব্র অভিমান আর রাগ লুকিয়ে আছে। সে বিচারকের দিকে তাকিয়ে বলল—
নিলু: “আমি স্পষ্ট বলে দিতে চাই, আমার স্বামী আমাকে কখনো নির্যাতন করেনি। ইফাদ আমার সুখ-শান্তিতে অশান্তি ঘটাতে চেয়েছিল। সে আমাদের সংসারে আগুন ধরাতে চেয়েছিল।”
কোর্টরুমে নীরবতা নেমে এল।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম, চোখ মেঘলা হয়ে আসছিল।
আমার পক্ষে কথা বলার সময় এল, কিন্তু আমার কণ্ঠ কম্পমান।
আমি বললাম—
ইফাদ: “স্যার, আমি মিথ্যা বলছি না। নিলু আমার কাছে সব বলেছে। আমার উদ্দেশ্য কখনো তাকে ক্ষতি করা নয়, বরং তাকে রক্ষা করা।”
কিন্তু তার বক্তব্য বিচারকের সামনে ঠিক সেই মানে দিচ্ছিল না।
শেষ পর্যন্ত, বিচারক কঠোর কণ্ঠে রায় ঘোষণা করলেন—
“এই মামলায় পক্ষে অপর্যাপ্ত প্রমাণ থাকার কারণে, অভিযোগ অস্বীকার করা হলো না। বিবেচনা করেই এক বছর কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করা হলো।”
সেই মুহূর্তে আমার হৃদয় ভেঙে পড়ে।
নিলুর চোখে একটা অদ্ভুত দুঃখের ঝলক দেখলাম, যা আমার প্রতি কষ্টের এক অসীম ভাষা বলছিল।
সেই দুঃখেই নিলু নিজেই যেন ভেতরে ভেঙে পড়ছিল—তার মুখ থেকে ঝরছিল কষ্টের অশ্রু, যা সে কখনো প্রকাশ করতে পারে নি।
কোর্টরুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমি ধীরে ধীরে মনেই বললাম—
“এই যন্ত্রণার আড়ালে নিলুর এক গভীর ঘর আছে, যেখানে সে নিজেকে বন্দি করে রেখেছে।”
ইফাদ যখন কারাগারে দিন গুনছিল, তখন নিলুর জীবনও ছিল এক অদৃশ্য কারাগারের ভেতর।
বাহ্যিকভাবে সে তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সামনে শান্ত, অনুগত এক স্ত্রী। কিন্তু ভেতরে সে প্রতিটি মুহূর্তে ভেঙে যাচ্ছিল।
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে সে চুপচাপ শুয়ে থাকত। অন্ধকারে তার চোখের পানি বালিশ ভিজিয়ে দিত।
মনে হতো, নিজের হাত দিয়ে নিজের হৃদয়ে বারবার ছুরি বসাচ্ছে।
নিলুর অন্তরের কণ্ঠ যেন প্রতিটি রাতে ফিসফিস করত—
“ইফাদ, আমি তোমাকে ঠকিয়েছি। আমি তোমার জীবন ধ্বংস করেছি। অথচ তুমি একদিনও আমার জন্য মন্দ কিছু ভাবনি… তুমি আমায় ক্ষমা করেছিলে।”
কিন্তু কেন সে ইফাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল?
সেই উত্তর তার মনেই কাঁদছিল—
“আমি বাবাকে বাঁচাতে চেয়েছি… সমাজের সম্মান বাঁচাতে চেয়েছি… কিন্তু আমার নিজের জীবনটাই তো শেষ হয়ে গেল!”
নিলুর স্বামী, যে প্রতিদিন নতুনভাবে তার উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করত, তার ভেতর আরও এক অদ্ভুত ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল—
“যদি তুমি ইফাদের পক্ষে কিছু বলো, তবে তোমার বাবাকে আমি শেষ করে দেব। তোমার পরিবারের নাম মাটিতে মিশিয়ে দেব।”
এই ব্ল্যাকমেইল আর পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতার যন্ত্রণায় সে ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছিল।
প্রতিটি রাতে সে মনে মনে ইফাদের কাছে ক্ষমা চাইত—
“তুমি আমাকে ঘৃণা করো ইফাদ, আমি তা প্রাপ্য। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করে তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আমি শুধু ভয়ে, সমাজের ভয়ে, বাবার ভয়ে পা বাড়িয়েছিলাম।”
কিন্তু দিনের বেলায় সে ছিল নিঃশব্দ, ঠাণ্ডা। কারও চোখে সে ছিল এক অনুগত, সুখী স্ত্রী।
কিন্তু অন্তরে সে প্রতিটি মুহূর্তে ধীরে ধীরে মরছিল।
এক বছর পর অবশেষে কারাগারের লোহার দরজা পেরিয়ে আমি মুক্তির স্বাদ পেলাম।
কিন্তু সেই মুক্তি ছিল এক অদ্ভুত নিঃশব্দ। আমার হৃদয় জানত—এই স্বাধীনতা আসলে এক বিশাল শূন্যতা।
বাইরের রোদ আমার গায়ে পড়ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল আমার জীবনের সূর্য অনেক আগেই অস্ত গেছে।
কারাগার থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম যে চিন্তাটা মাথায় এলো—
“নিলুর সাথে কথা বলতে হবে… তাকে বলতে হবে, আমি কোনোদিন রাগ পুষে রাখিনি।”
কিন্তু ভাগ্য যেন আমাকে আরেকবার আঘাত করার জন্য অপেক্ষা করছিল।
বিকেলে সীমা তাড়াহুড়ো করে আমার কাছে এলো। তার চোখ লাল, মুখ ফ্যাকাশে।
আমি: “সীমা? কী হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেন?”
সীমা থরথর করে কাঁপছিল, তারপর কাঁপা কণ্ঠে বলল—
সীমা: “ভাইয়া… নিলু আর নেই।”
আমার বুকের ভেতর যেন এক বজ্রপাত হলো। আমি কাঁপা গলায় বললাম—
আমি: “না… না, তুমি মিথ্যে বলছো! নিলু… নিলু মারা যেতে পারে না!”
সীমা চোখ মুছল, তারপর হেঁচকি তুলে বলল—
সীমা: “আজ সকালে… তার স্বামী আবার ঝগড়া করেছিল। নিলু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, হাসপাতালেও নেওয়া হয়নি সময়মতো। ডাক্তার বলেছে, সে অনেক আগে থেকেই মানসিক চাপে ভেঙে পড়েছিল… তার শরীর আর সহ্য করতে পারেনি।”
আমি নিঃশব্দে মাটিতে বসে পড়লাম। পৃথিবী যেন ঘুরে যাওয়া বন্ধ করে দিল।
নিলুর হাসি, তার কান্না, তার মায়াবী চোখ সব এক ঝলকে মনে ভেসে উঠল।
আমার চোখ ভিজে যাচ্ছিল, আর কানে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল নিলুর সেই কথাগুলো—
“ইফাদ, তুমি কি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করেছ?”
আমি মাটির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম—
“হ্যাঁ নিলু, আমি তোমাকে ক্ষমা করেছিলাম। আর আজও করছি। কিন্তু তুমি কেন আমাকে একবার শেষ দেখা দেওয়ার সুযোগও দিলে না?”
সীমা কাঁদতে কাঁদতে বলল—
সীমা: “নিলু শেষ সময়ে শুধু একটাই কথা বলেছিল… ‘ইফাদকে বলো, আমি তাকে ঠকাতে চাইনি… আমি শুধু ভয়ে বেঁচে ছিলাম।’”
এই কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল।
আমি ধীরে ধীরে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম—
“তুমি ভয় পেয়েছিলে নিলু… আর আমি তোমার জন্য লড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি যাওয়ার আগেই হেরে গেলে। আজ থেকে আমি বাঁচব, শুধু তোমার জন্য, শুধু তোমার অসমাপ্ত স্বপ্নের জন্য।”
নিলুর মৃত্যু আমাকে ভেতর থেকে চুরমার করে দিয়েছিল।
কিন্তু কান্না আর শোকের মাঝেও আমার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—
“নিলু সত্যিই কি স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে? নাকি এর পেছনে আরও বড় কোনো নিষ্ঠুর সত্য লুকিয়ে আছে?”
আমি সীমার সাহায্যে নিলুর পুরনো চিকিৎসা রিপোর্ট, হাসপাতালের কাগজপত্র আর আশেপাশের লোকজনের সাক্ষ্য সংগ্রহ করতে শুরু করলাম।
একদিন নিলুর এক প্রতিবেশী মহিলা গোপনে আমাকে বলল—
প্রতিবেশী:
“আপনি কি জানেন, নিলু মারা যাওয়ার আগের রাতে তার স্বামী তাকে ভীষণ মারধর করেছিল? আমরা চিৎকার শুনেছিলাম, কিন্তু ভয় পেয়ে কেউ এগোয়নি। সকালে ওকে আধমরা অবস্থায় দেখেছি।”
আমার বুকের ভেতর রক্ত যেন ফুটতে লাগল।
নিলু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল, অথচ তাকে সময়মতো হাসপাতালে নেওয়া হয়নি।
আমি সেই প্রতিবেশীর সাক্ষ্য রেকর্ড করলাম, হাসপাতালের এক কর্মচারীকেও বোঝালাম। সে আমাকে ফিসফিস করে বলল—
হাসপাতাল কর্মচারী:
“ওকে আনা হয়েছিল অনেক দেরিতে… ডাক্তার বলেছিল, সময়মতো আনলে হয়তো বাঁচানো যেত। কিন্তু স্বামী ইচ্ছে করেই দেরি করেছে।”
এই প্রমাণগুলো হাতে নিয়ে আমি আবার আইনজীবীর কাছে গেলাম। এবার আমার চোখে ছিল অন্যরকম দৃঢ়তা।
আমি:
“স্যার, আমি আর নীরব থাকব না। এবার আমাকে লড়তে হবে। নিলুর জন্য, তার মৃত্যুর ন্যায়বিচারের জন্য।”
আইনজীবী গভীরভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলল—
“আপনার হাতে যদি শক্ত প্রমাণ থাকে, তবে এবার ওদের রক্ষা করা যাবে না। আমরা হত্যা ও মানসিক নির্যাতনের মামলা করব।”
সেদিনই মামলা রেজিস্ট্রি হলো।
কোর্টরুমে নতুন লড়াই শুরু হলো।
ইফাদ আর আগের মতো ভেঙে পড়া মানুষ ছিল না; সে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল আগুনের মতো দৃঢ় কণ্ঠে।
নিলুর প্রতিবেশী, হাসপাতালের কর্মচারী—একজন একজন করে আদালতে সাক্ষ্য দিল।
প্রমাণের পাহাড় জমতে লাগল।
অবশেষে বিচারকের কণ্ঠে কঠোর রায় এল—
“নিলুর স্বামীকে হত্যার উদ্দেশ্যে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো।”
রায় শোনার পর আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম।
মনে হচ্ছিল—আমি নিলুর জন্য ন্যায়বিচার আদায় করেছি, কিন্তু তবুও আমার বুকের ভেতর শূন্যতা থেকে গেছে।
কোর্টরুম থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম—
“নিলু, তুমি শুনতে পাচ্ছো তো? আমি প্রতিশ্রুতি রেখেছি। তুমি শান্তিতে থেকো… এবার তুমি মুক্ত।”
রায়ের পর দিনগুলো যেন নিঃশব্দে কেটে যাচ্ছিল।
নিলুর জন্য ন্যায়বিচার আদায় করেছি, কিন্তু তবুও মনে হচ্ছিল—এই বিজয় অসম্পূর্ণ। কারণ, আমি তাকে ফেরাতে পারিনি।
একদিন সীমা আমার হাতে একটি ছোট্ট পুরনো ডায়েরি দিয়ে বলল—
সীমা:
“নিলুর জিনিসপত্র গোছাতে গিয়ে এটা পেয়েছি। হয়তো এটা তোমারই হাতে থাকা উচিত।”
ডায়েরির প্রথম পাতায় নিলুর হাতের লেখা—
“ইফাদ, যদি কখনো তুমি এটা পড়, জানবে— আমি হয়তো আমার সুখে জন্য তুমি মানুষ টা কে বার বার আঘাত করছে ঠকাইছি। কিন্তু ইফাদ এবার আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনি।”
আমার হাত কেঁপে উঠল। আমি গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে পাতা উল্টালাম।
“আমি জানি ইফাদ আমাকে ভালোবাসে, আর আমি তাকে ভালোবাসি। কিন্তু বাবাকে বাঁচাতে, সমাজের চোখ রাঙানি থেকে বাঁচাতে আমাকে স্বামীর পাশে দাঁড়াতে হয়েছে।
বাবা জানত না যে আমি তার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করছি। আমি ইফাদকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম, কারণ স্বামী হুমকি দিয়েছিল—ইফাদকে ও বাবা কে সে মেরে ফেলবে। আমি ভয়ে মিথ্যা রায় দিয়েছিলাম। তোমাদের কে রক্ষা করতে কিন্তু কে জানতো তোমাকে রক্ষা করতে গিয়ে আমি আবার ধ্বংস করে পেলছি মাফ করে দিও—
পরের পৃষ্ঠায় তার যন্ত্রণার আর্তি—
“ইফাদ, তুমি যদি জানতা, আমি প্রতিরাতে কেমন করে কান্না লুকিয়ে ঘুমাই… কেমন করে তোমার স্মৃতির সাথে কথা বলি… আমি তোমাকে দোষী করতে চাইনি। আমি তোমার কাছে শেষ জীবনের জন্য ক্ষমা চাই।”
সবশেষ পাতায় কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা—
“যদি কখনো আমি না থাকি, তুমি আমাকে ঘৃণা কোরো না। তুমি বেঁচে থেকো, তুমি লড়াই কোরো, তুমি সুখে থেকো—এই আমার শেষ ইচ্ছে।”
ডায়েরির শেষ পাতা ভিজে যাচ্ছিল আমার চোখের পানিতে।
আমি বুকের ভেতর হাত রেখে ফিসফিস করে বললাম—
“নিলু, তুমি আমাকে ক্ষমা চাইতে বলেছো, অথচ আমি তো কখনো তোমার উপর রাগই করিনি। তুমি শান্তিতে থেকো, আমি তোমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করব। আমি বাঁচব, তোমার স্বপ্নগুলো বাঁচিয়ে রাখব।”
সেদিন থেকে ইফাদের জীবনে শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়—
সে নিলুর স্মৃতিকে বুকে নিয়ে, তার ডায়েরির পাতার প্রতিটি শব্দকে শক্তি করে, নতুনভাবে বাঁচতে শিখল।
কারণ এখন সে জানে—তার প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি লড়াই নিলুর অসমাপ্ত স্বপ্নের জন্যই।
উৎসর্গ
যে ভালোবাসতে গিয়ে ভুল পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছিল, তবু যার প্রতিটি অশ্রু ভালোবাসারই সাক্ষ্য বহন করে।
আর সেইসব মানুষের জন্য, যারা সমাজের ভয় আর পারিবারিক শৃঙ্খলের কাছে হার মেনে নিজের স্বপ্নগুলোকে মেরে ফেলে
সতর্কবার্তা
এই কাহিনী বাস্তব জীবনের আবেগঘন সম্পর্ক, সামাজিক ভণ্ডামি ও নির্যাতনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে লেখা।
এখানে বর্ণিত চরিত্রগুলো কারও ব্যক্তিগত জীবনের সাথে মিলে গেলে তা সম্পূর্ণ কাকতালীয়।
গল্পটি একদিকে যেমন ভালোবাসার স্নিগ্ধ স্মৃতি বয়ে আনে, তেমনি অন্যদিকে এটি একটি বার্তা—
\”ভয় পেলে নয়, সত্যের পক্ষে দাঁড়ালেই মুক্তি মেলে।\”
লেখক পরিচিতি
নেশান্তপ্রতীক আশরাফ—
আশরাফুল ইসলাম নামেই তিনি পরিচিত, তবে সাহিত্যজগতে তিনি \”নেশান্তপ্রতীক আশরাফ\” নামে লিখে থাকেন।
টেকনাফ, কক্সবাজারের এই তরুণ লেখক জীবনের সত্য ঘটনা ও আবেগঘন সম্পর্ককে নতুনভাবে সাহিত্যিক রূপ দিতে ভালোবাসেন।
তিনি বিশ্বাস করেন—
\”ভালোবাসা কখনো মরে না; তা মানুষের প্রতিটি ভালো কাজের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে।”
যদি ভালো লাগে সাপোর্ট করবেন পরের পর্ব লিখবো