বর্তমান

শোনা যায়, একদিন এক বিশাল সবুজ বনের গভীরে,
নীল গগনের নিচে, একদল পাখি ছিলো মুক্ত বাতাসের প্রেমে বিভোর।
তারা উড়তো অনিয়ন্ত্রিত স্রোতের মতো,
তাদের গানে ছিলো প্রকৃতির ছন্দ,
তাদের ডানা ছুঁয়ে যেতো মুক্ত আকাশের অবাধ দিগন্ত।

কিন্তু একদিন বনের প্রান্তে এলো এক স্বর্ণপাখি—
ঝলমলে, দীপ্তিময়, তার চোখে সূর্যের প্রতিফলন,
তার ঠোঁটে অমৃতের প্রতিশ্রুতি।
সে বলল—
“আমাদের মুক্তি চাই! আমাদের সুরক্ষিত নীড় চাই!
এই বন তো খণ্ড-বিখণ্ড, এখানে অনিয়ন্ত্রিত উড়াল বয়ে আনবে বিশৃঙ্খলা।”
বনের সকল পাখি অবাক, বিভ্রান্ত,
কিন্তু স্বর্ণপাখির কণ্ঠে ছিলো মোহময় জাদু।

সে স্বপ্ন দেখালো এক সুবর্ণ খাঁচার,
যেখানে থাকবে মধুর গানের প্রতিধ্বনি,
যেখানে থাকবে শান্তি, থাকবে সমৃদ্ধির বাতাস,
যেখানে থাকবে নিরবিচারে খাদ্যের সরবরাহ।

পাখিরা তার আহ্বানে মাতাল হয়ে উঠলো।
নিজেরা গাছের ডাল ভেঙে, লতা জড়িয়ে
গড়ে তুললো সেই স্বপ্নের সোনার খাঁচা।
আর যখন খাঁচার দরজা বন্ধ হলো—
তারা বুঝলো, মুক্তির নামে এসেছে বন্দিত্ব!

বছর গড়ালো, খাঁচার ভেতর ধীরে ধীরে
নিয়মের ছায়া ঘনিয়ে এলো।
পাখিদের গানের সুর বদলে গেলো,
তাদের ছন্দ হলো নিয়ন্ত্রিত, তাদের গতি হলো সংযত।
এখন তাদের গান গাইতে হয় এক নির্দিষ্ট সুরে,
যে সুর স্বর্ণপাখির আদেশে নির্ধারিত।

যে ডানা মেলে উড়তে চায়, তাকে বলে—
“তুমি বিশৃঙ্খলা চাও? তুমি কি স্বাধীনতার শত্রু?”
যে প্রশ্ন তোলে, তাকে বন্দী করা হয় সোনার খাঁচারই এক অন্ধ কোণে,
সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না,
সেখানে বাতাসের শব্দও শাসনের ইশারায় থমকে থাকে।

কিন্তু পাখিদের মধ্যে একদল ছিলো অস্থির,
তারা ভুলতে পারেনি তাদের নীল আকাশের স্বাধীনতা।
তারা ফিসফিসিয়ে বলতো—
“এ তো আমাদের স্বপ্ন ছিলো না! আমাদের প্রতিশ্রুতি ছিলো মুক্তির, বন্দিত্বের নয়!”
কিন্তু স্বর্ণপাখির পাহারাদাররা তখনই
তাদের ঠোঁট চেপে ধরে, তাদের ডানা ছেঁটে দেয়,
আর বলে—
“তোরা বিশ্বাসঘাতক! তোরা দাঙ্গাবাজ!”

একদিন, একদল পাখি
তাদের ছিন্ন ডানা নিয়েও গর্জে উঠলো—
তারা খাঁচার ফাঁকফোঁকরে ঠোঁট গুঁজে দিলো,
তারা ডানার শেষ শক্তি দিয়ে লড়ে গেলো।
কিন্তু স্বর্ণপাখি তখনই ডেকে আনলো লোহার ঠোঁটের বাজপাখিদের।
তারা এলো ঝাঁকে ঝাঁকে,
তারা ছিঁড়ে খেলো সেই বিদ্রোহীদের গলা,
তাদের রক্তে রাঙলো খাঁচার স্বর্ণালংকার।

পাখিদের কান্নার শব্দ মিলিয়ে গেলো,
শুধু খাঁচার গায়ে লেগে থাকলো তাদের লালচে ছোপ।
আর সেই মুহূর্তে সুবর্ণ খাঁচার ফটক আরও দৃঢ় হলো।
আরও কঠিন হলো নিয়ম,
আরও কঠিন হলো স্বাধীনতার শৃঙ্খল।

বহু বর্ষ পেরিয়ে গেছে,
নতুন প্রজন্মের পাখিরা এখন জানেই না—
একদিন এই আকাশের নিচে তারা ছিলো মুক্ত!
তারা জানে না, একদিন তাদের পূর্বপুরুষেরা এই খাঁচা গড়েছিলো নিজের হাতে।
তারা জানে না,
যাদের বিপ্লবী বলে হত্যা করা হলো,
তারাই ছিলো প্রকৃত মুক্তির দূত।

কিন্তু একদিন, এক নবীন পাখি
আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো—
“এই খাঁচার বাইরে কী আছে গো?”
আর তখনই বাজপাখিরা এসে তাকে গিলে খেলো।

এভাবেই ইতিহাস লেখা হয়,
এভাবেই সত্য চাপা পড়ে,
এভাবেই মুক্তির নামে বন্দিত্ব গড়ে ওঠে,
এভাবেই এক স্বর্ণপাখি বদলে যায় লোহার খাঁচার সম্রাটে।

৮৬
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন