শিরোনাম: আঁচড়

গল্পকার: Author Avatar সমরেশ মজুমদার

এখন দিনদুপুরেই বাড়িটাকে ভূতুড়ে বলে মনে হয়।

এই বাড়ির শেষ অধিবাসী হরশংকর রায় দুপুরবেলায় চিঠি পড়ছিলেন। বর্ধমানের জীবনবাবু লিখেছেন, আপনার মেয়েকে আমাদের ভালো লেগেছিল। পছন্দ করেছিলাম। কিন্তু সে যদি বিবাহ করবে না বলে স্থির করেই থাকে তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে এমন অপমান নাই বা করতেন!

চিঠিটা পড়ে পাংশু চোখে ভেতরের দিকে তাকালেন হরশংকর। বিশাল লম্বা বারান্দায় ক্যারামের বোর্ড পাতা হয়েছে। খটাখট স্ট্রাইকারের শব্দ উঠেছে। এপাশে একটি বাচ্চা ছেলে, ওপাশে যে। সে খুব সিরিয়াস। অসম সঙ্গীর সঙ্গে খেলাতেও তার মনোযোগ দেখবার মতো। পঁচিশের গায়ে বয়স, এক নজরে চোখ জুড়িয়ে যায়, শুধু বাঁকপালে ইঞ্চিখানেক গভীর দাগ ছাড়া। ওপাশে। রেডিওতে নাটক হচ্ছে, রেডিওটা ক্যারামবোর্ডের পাশে।

দ্বিতীয় চিঠিটা খুললেন হরশংকর। কলকাতার চৌধুরী কোম্পানির চিঠি। এর আগে অনেকগুলো পেয়েছেন। এই বাড়ির অন্যান্য শরিকরা তাদের অংশ ওই কোম্পানিকে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। বিভিন্ন কর এত বাকি ছিল যে বাড়ি নিলামে উঠতে যাচ্ছিল। তাছাড়া এই পাড়াগাঁয়ে কেউ আজকাল পড়ে থাকতে চায় না। শহরে একটা ব্যবস্থা করে যে যার মতো সরে পড়েছে। এই পুরোনো শরিকি বাড়িতে কে থাকবে। কোম্পানি লিখেছে আর একমাস পরেই তাদের কাজ শুরু হবে। অতএব ওই সময়ের আগেই তাঁকে এই বাড়ি ছাড়তে হবে। কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে একজন ইঞ্জিনিয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই এখানে আসবেন।

রেডিওতে যে নাটক তার এখন শেষ পর্ব। প্রচণ্ড বাগবিতণ্ডা চলছে পাত্র-পাত্রীদের মধ্যে। হরশংকর ব্যস্ত হলেন। তাঁর নজর গেল ক্যারামবোর্ডের দিকে। দুটো হাতে কান চাপা দিয়ে মেয়েটা পাথরের মতো বসে আছে। মুখচোখে অদ্ভুত যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। হরশংকর তাঁর অনড় শরীর নিয়ে দৌড়ে যাওয়ার আগেই মেয়েটি চিৎকার করে উঠল। ওর শরীর থরথর করে। কাঁপছে। সঙ্গী বালক বিস্ময়ে তাকে দেখছে। হরশংকর রেডিওটা বন্ধ করে মেয়েকে ধরলেন। মুহূর্তে নেতিয়ে পড়ল সে। হরশংকর উল্কণ্ঠিত গলায় ডাকলেন, সুবর্ণা, মাগো।

একমাস সময় এমন কিছুই নয়। তিন ছেলের সঙ্গে এই নিয়ে মনোমালিন্য। তারা চাইছে হরশংকর স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে তাদের কাছে থাকুক। কিন্তু কলকাতা শহরে এই মেয়ে কিছুতেই যাবে না। কোনওরকম চিৎকার চেঁচামেচি ওর নার্ভ কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনলেই সে হিস্টিরিয়া রোগীর মতো আচরণ করে। এই কারণে মেয়েটা কলেজে পড়তে শহরে যেতে পারেনি, এই জন্যেই গ্রামের নির্জনতা ছেড়ে কোথাও যাওয়ার প্রশ্ন ওঠেনি। ওই রকম ঘটনা ঘটলে সারাটা দিন আচ্ছন্নের মতো শুয়ে থাকে মেয়েটা। অবশ্যই এটা একটা মানসিক ব্যাধি, মনের ডাক্তার দেখানো দরকার। ছেলেরা বলেছেও। কিন্তু কিছুতেই সুবর্ণাকে এই গ্রামের বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আজ রেডিওতে অমন নাটক হবে তা কে জানত। শায়িত কন্যার পাশে বসা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হরশংকর বললেন, আজ আবার চিঠি এসেছে। একজন ইঞ্জিনিয়ার আসছে।

কেন? সুধাময়ী মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে থেমে গেলেন।

বাড়ির দখল নিতে বোধহয়। একমাস সময় দিয়েছে। কি যে করি!

এখানেই থাকতে হবে। দত্তরা শুনছিলাম বাড়ি ভাড়া দেবে।

অসম্ভব। এই গ্রামে আমি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকব?

তাহলে?

তাহলে শহরেই যেতে হবে। বর্ধমানের জীবনবাবু চিঠি দিয়েছেন। বেশ কড়া চিঠি। তোমার মেয়ে বিয়ে করবে না যখন তখন আর পাঁচটা লোককে বিরক্ত করা কেন? হরশংকর উত্তেজিত হতে গিয়ে সামলে নিলেন। সুবর্ণা ঘুমুচ্ছে। সুধাময়ীর চোখে জল, আঙুল সুবর্ণার কাটা দাগের ওপর।

পরনে হলুদ শাড়ি, খোলা চুল সুবর্ণা তাদের বারদালানে এসে দাঁড়াল। তার মুখ শান্ত, চেহারায় স্নিগ্ধতা কিন্তু একটা গাম্ভীর্যের ছায়া চাহনিতে, ঠোঁটের কোণে। বারদালানের সামনে অপেক্ষা। করছিল চার থেকে পাঁচ বছরের শিশুরা। এরা সবাই এই গ্রামের নিম্নশ্রেণীর চাষি পরিবারের। এদের পোশাক দেখলেই সেটা বোঝা যায়। সুবর্ণাকে দেখেই সবাই কলকল করে উঠল। সুবর্ণা বলল, আস্তে-আস্তে চিৎকার করে একসঙ্গে কথা বলতে নেই।

শিশুরা শান্ত হল। এখন ওরা সুবর্ণার সামনে। প্রতিদিন দুপুরে যদি কোনও বিঘ্ন না ঘটে তাহলে এটা সুবর্ণার নেশা। গ্রামের এই সব শিশুদের সে পড়ায়। এদের অক্ষর পরিচয় হয়ে গেছে।

বিভিন্ন রকমের ছড়া শেখার পালা চলছে। এই একটি কাজ করে আনন্দ পায় সুবর্ণা। এইসব অবহেলিত শিশুদের সঙ্গে এইভাবে সময় কাটিয়ে সে তৃপ্ত হয়।

সুবর্ণা ছড়া বলছিল, শিশুরা তাই কচি গলায় আওড়াচ্ছিল। এক সময় সুবর্ণা চুপ করতেই শিশুরা সরল গলায় উচ্চারণ করল, সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।

সুবর্ণা চোখ বন্ধ করে ছিল, হঠাৎ শিশুরা থেমে যেতে সে অবাক হয়ে চোখ খুলতেই দেখল একটি সুঠাম পুরুষ শিশুদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন।

সুবর্ণার কপালে ভাঁজ পড়ল।

যুবক বলল, মাপ করবেন, আমি হয়তো ব্যাঘাত ঘটালাম। এই ছড়াটা শুনে মজা লাগল।

সুবর্ণা বিরক্ত গলায় প্রশ্ন করল, মজা লাগল মানে?কখনও শোনেননি?

এই মানুষকে সে কখনও দ্যাখেনি। তবে সে যে এই গ্রামের মানুষ নয় এটা পরিষ্কার।

শুনেছি, কিন্তু কখনও মানেটা বুঝতে চেষ্টা করিনি।

মানেটা নিশ্চয়ই আপনাকে বোঝাতে হবে না?

হবে। কারণ সাত নয়, এখন বোধহয় সতের কোটি হয়ে গেছে সংখ্যাটা।

আপনি রেগে যাচ্ছেন। যুবক হাসল, মানুষ হয়নি বাঙালি হয়েছে এটা বোঝা সোজা। কিন্তু অত কোটি বাঙালির জননী মুগ্ধ হলেন কোন যুক্তিতে এটা ভেবেছেন!

আপনি কী চান?

কিছু না। এই বাড়িতে হরশংকর রায় থাকেন, কিভাবে তাঁর দর্শন পাব?

ওপাশের দরজা দিয়ে ঢুকে ওপরে উঠে যান।

ধন্যবাদ। যুবক বিনম্র ভঙ্গিতে নির্দিষ্ট পথে এগোল। সুবর্ণার কপালের ভাঁজ কিছুতেই মেলাচ্ছিল না।

হরশংকর বুঝতে পারছিলেন না কিভাবে এই যুবককে আপ্যায়িত করবেন। সুধাময়ী বিস্মিত হয়ে মাথায় আঁচল ঢেকে হরশংকরের পেছনে দাঁড়িয়ে। ওপাশের চেয়ারে যুবক। যুবকের নাম সোমনাথ।

হরশংকর বললেন, আমি আজই জীবনবাবুর চিঠি পেয়েছি। আমার খুব লজ্জা করছে, উনি ঠিকই লিখেছেন।

সোমনাথ বলল, আপনাদের অসুবিধেটা কোথায়?

এবার সুধাময়ী বললেন, কোনও অসুবিধে নেই বাবা। মেয়ে জেদ ধরেছে যে সে বিয়ে করবে না।

সোমনাথ হাসল, সেটা জানি। কিন্তু কেন? কোনও ব্যাক্তিগত অসুবিধে আছে?

হরশংকর তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লেন, নানা, মেয়ে আমার খুব ভালো।

আমার ব্যাপারে কোনও আপত্তি আছে?

না, তোমার মতো ছেলে পাওয়া তো ভাগ্যের কথা।

আপনারা জানেন আমি কোথায় চাকরি করি?

শুনেছি কলকাতায়। খোঁজখবর নেওয়ার আগেই তো…।

কিছু মনে করবেন না, আপনারা বলছেন কোনও অসুবিধে নেই অথচ আপত্তি আছে। এটাই আমার বোধগম্য হচ্ছে না। শুনে আমার কৌতূহল হল। ওঁকে বাইরের দালানে দেখলাম। দেখে অবশ্য কিছু বোঝা গেল না। সোমনাথ উঠল।

সুধাময়ী ব্যস্ত হলেন, না বাবা, আমার মেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ।

সোমনাথ বলল, এটা আপনাদের ব্যাপার। আপনাদের তো এক মাসের মধ্যে এই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে!

হরশংকর চমকে উঠলেন, তুমি কি করে জানলে? এ খবর তো গ্রামের কেউ জানে না।

আমি জানি। কবে ছাড়বেন?

হরশংকর কিঞ্চিৎ হতভম্ব। এই খবর গ্রামের কেউ জানে না। বললেন, দেখি। মেয়েটার জন্যেই–।

সোমনাথ বলল, একটা কথা আপনাদের বলা হয়নি। আমি ইঞ্জিনিয়ার। চৌধুরী কোম্পানিতেই আছি। এই গ্রামের পাশের নদীতে যে কাজ হবে সেটা করার দায়িত্ব আমার ওপর। সেই সঙ্গে এই বাড়িটির দখল নিয়ে অফিস শুরু করতে কোম্পানি আমাকেই পাঠিয়েছে। চাকরি বজায় রাখতে গেলে আমাকে সবসময় ভদ্র কথা না-ও বলতে হতে পারে। আচ্ছা নমস্কার, চলি।

দুটি বিস্মিত মানুষকে সেই অবস্থায় রেখে সোমনাথ নেমে এল। বিশাল বাড়ি। সবকটি মহল এখন তালাবন্ধ। এই এলাকাটা খালি হয়ে গেলে কাজ শুরু হবে। পাশের নদীতে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। বিরাট অর্ডার পেয়েছে কোম্পানি।

সামান্য শব্দ হলেই মনে হয় অনেকগুণ হয়ে ফিরে এল। একটা বুকচাপা শূন্যতা চারধারে। সোমনাথ জুতোয় শব্দ তুলে বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেল সামনে সুবর্ণা। তার আঁচল পিঠে ঘেরা, শিশুরা নেই। সোমনাথ পাশ কাটিয়ে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে যাচ্ছিল, সুবর্ণা ডাকল, শুনুন।

সোমনাথ ফিরে দাঁড়ল জিজ্ঞাসু চোখে।

সুবর্ণা বলল, মুগ্ধ জননী–এই শব্দ দুটোতে আপনার আপত্তি কেন?

আপত্তি আছে। বোধহয় কবিও সেটাই ব্যঙ্গ করতে চেয়েছেন। সতের কোটি মানুষের মা কোন যুক্তিতে মুগ্ধ হন যদি তিনি তাদের মানুষ করতে না পারেন? কোনও অধিকার নেই, তাঁর মা। হওয়ার, মুগ্ধ হওয়া তো অনেক দূরের কথা, তাই না?

সুবর্ণা একদৃষ্টে তাকিয়েছিল সোমনাথের মুখের দিকে। সোমনাথ হাসল, এই ধরুন, সারা দেশে কত নদী। আমরা কবিত্ব করে বলি নদীমাতৃক দেশ। আমরা যদি বাঁধ না গড়তাম, যদি নদীর জল নিয়ন্ত্রিত না করতাম, তাহলে এই নদীমাতৃক দেশটা সারাবছর বন্যায় ডুবে থাকত। শুধু আবেগ নয়, সেইসঙ্গে দায়িত্ববোধ না এলে জননী শব্দটির প্রতি সম্মান জানানো হয় না। আমি বোধহয় আপনাদের পড়শুনায় আজ ক্ষতি করেছি, খুব বিরক্ত করলাম তার জন্য আমি আবার ক্ষমা চাইছি। চলি। সোমনাথ পাশ ফিরে বেরিয়ে গেল। সুবর্ণা কোনও কথা বলল না। ওর দৃষ্টি শূন্য। কোনও বোধ যেন কাজ করছে না।

নদীর ধারে জরিপ চলছিল। বিশাল নদী প্রতি বছর কূল ছাপিয়ে দেশ ভাসায়। এই নদীর গায়ে বাঁধ পড়বে। বিজ্ঞান চেষ্টা করবে সেই প্রতিহত জল সঞ্চিত করে চাষের জন্যে নির্জলা জমিতে পৌঁছে দিতে। নদীর ধারে অস্থায়ী তাঁবু পড়েছে।

তাঁবুর সামনে নিচু টেবিলে প্ল্যান রেখে সোমনাথ দেখছিল। তার কিছু সঙ্গী দুপাশে। এই সময় চোখ তুলতেই সে দেখতে পেল সুবর্ণা এগিয়ে আসছে। সঙ্গীদের কাজটা চালাতে বলে সে মুখোমুখি হল, আরে আপনি?

আপনারা কবে থেকে বাড়ির দখল চান?শক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল সুবর্ণা।

যে-কোনও দিন হলেই হয়। তবে আপনাদের একমাস শেষ হতে তো দেরি আছে। সোমনাথ হাসল, এখানে আপনাকে বসতে বলব তার কোনও উপায় নেই।

আমি বসতে আসিনি, কিন্তু আপনি আমাদের বাড়িতে কেন গিয়েছিলেন? কোম্পানির হুকুমমতো বাড়ির দখল নিতে, না আমি কেন বিয়ে করতে চাইনি তার খোঁজ নিতে? ঠোঁট কামড়াল সুবর্ণা।

যদি বলি দুটোই!

তাহলে সীমা ছাড়িয়েছেন। কোম্পানির হয়ে যেটুকু জানার সেটুকুই জানতে চাওয়া আপনার উচিত ছিল। আপনারা যেদিন চান তার তিনদিন আগেই জানাবেন, আমরা বাড়ি ছেড়ে দেব।

কোথায় যাবেন?

সেটা আপনার জানার অধিকারে নেই।

ঠিক এইসময় নদীর ধারে একটি গোলমাল শুরু হল। জরিপ করতে আসা দলের একজন শ্রমিক চিৎকার করে একজনকে কিছু বলতেই সে উত্তেজিত হয়ে গালাগাল দিতে লাগল। ক্রমশ

উত্তেজনাটা শ্রমিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। সোমনাথ তার এক সহকারীকে ব্যাপারটা জানতে পাঠিয়ে সুবর্ণার দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল। মেয়েটার মুখ অসম্ভব পালটে গেছে। থরথর করে কাঁপছে ঠোঁট, চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। সোমনাথ এগিয়ে এল, আপনার কি হয়েছে?

এই সময় গোলমালটা থেমে গেল। সোমনাথের সহকারী তাদের সঙ্গে কথা বলছে। সোমনাথের সেদিকে লক্ষ নেই, সে এই মেয়েটির পরিবর্তন ঠাওর করতে পেরে বিব্রত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত চেতনার শেষপ্রান্ত থেকে ধীরে-ধীরে নিজেকে ফিরে পেল সুবর্ণা।

এবং তখনই তাকে প্রচণ্ড অবসন্ন দেখাল। নীরক্ত মুখে সে বলল, চলি।

কিন্তু আপনাকে প্রচণ্ড অসুস্থ দেখাচ্ছে, কি হয়েছে আপনার?

কিছু না। আচ্ছা–।

সুবর্ণা ফিরতেই সোমনাথ তাকে বাধা দিল, অসম্ভব। এইভাবে আপনাকে আমি যেতে দিতে পারি না। চলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।

সুবর্ণা শেষবার আপত্তি জানাল, মিছিমিছি ব্যস্ত হচ্ছেন!

সোমনাথ বলল, আমি জানি, আপনি খুব জেদি মেয়ে। কিন্তু এবার আপনাকে আমার কথা শুনতেই হবে।

সার্ভের কাজের জন্যে আনা একমাত্র জিপটাতে সোমনাথ সুবর্ণাকে পৌঁছে দিচ্ছিল। ড্রাইভিং সিটের পাশেদু-হাতে মুখ ঢেকে বসেছিল সুবর্ণা। বিশাল বাড়িটার সামনে এসে জিপটাকে দাঁড় করিয়ে সোমনাথ জিজ্ঞাসা করল, এখন কেমন লাগছে?

সুবর্ণা মুখ তুলল। সামান্য মাথা নেড়ে নামবার জন্যে পা বাড়াতেই সোমনাথ আবার প্রশ্ন করল, আচ্ছা, আপনার কপালে এই আঁচড়টি কিসের?

সঙ্গে-সঙ্গে চমকে উঠল সুবর্ণা। তারপর বলল, আমার দুর্ভাগ্যের।

দুর্ভাগ্য?

সোমনাথবাবু, আপনাদের অপমানিত করা হয়েছে বলে যদি মনে হয় আমি ক্ষমা চাইছি। আমি, আমি–, আমার বিয়ে করার কোনও মানসিকতা নেই।

এর সঙ্গে ওই আঁচড়ের কি সম্পর্ক?

সম্পর্ক আছে। আয়নায় এই আঁচড়টার দিকে তাকালেই মুগ্ধ জননীর অমানুষদের ছবি দেখতে পাই। তাছাড়া দেখলেন যে, আমি কি রকম অসুস্থ হয়ে পড়ি হঠাৎ হঠাৎ! আর কাউকে বিব্রত করতে–। সুবর্ণা কথা শেষ না করে ঠোঁট কামড়াল।

সোমনাথ বন্ধুর গলায় বলল, ছবিগুলো আমাকে দেখাবেন?

খানিক ভাবল সুবর্ণা। তারপর অন্য রকম স্বরে বলল, আমার কাছে একটা অ্যালবাম আছে। সেই অ্যালবামে প্রথম ছবি ওই বাড়িটার। এতটা জীর্ণ তখন ছিল না। এই গ্রামের বর্ধিষ্ণু পরিবার হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলাম। আমার বাবা ছিলেন অষ্টম সন্তান। সমস্ত বাড়ি গমগম করত আট ভাইয়ের ছেলেমেয়ের চিৎকার চেঁচামেচিতে। আমি তখন শিশু। ঠাকুরদা মারা যাওয়ামাত্র চেহারা পালটে গেল বাড়িটার। যে যার সম্পত্তি আলাদা করে নিতে চায়। অধিকার ভাগাভাগি যে কি জিনিস সেটা তখন না বুঝতে পারলেও যে চেহারাগুলো চিনতাম সেগুলো অচেনা হয়ে গেল। দিনরাত ঝগড়াঝাঁটি। কোনও ভাই যেন আর রক্তের বন্ধন সহ্য করতে পারছে না। আমি, সেই পাঁচ। বছরের আমি, ওইরকম শুরু হলেই ভয় পেয়ে ঠাকুরমার কাছে চলে যেতাম। সেই মুগ্ধ জননী তখন ঠাকুরঘরে চোখ বন্ধ করে বসে তাঁর শালগ্রামশিলার সামনে কেঁদে যেতেন। আমি তাঁর। আঁচল ধরে চুপ করে বসে ভাবতাম এই ঘরে যেন ওই স্বার্থের চিৎকারগুলো না ঢোকে। কিন্তু শহরে ঘরে আগুন লাগলে মন্দিরও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বাড়িটার ভাগ-বাঁটোয়ারা শেষ হয়ে। গেলে জেঠারা ছুটে এলেন ঠাকুরঘরে। সেখানে ঠাকুরমার শালগ্রামশিলা রয়েছেন যে সোনার। সিংহাসনে সেটাকে আটভাগ করতে হবে। সিংহাসন টুকরো করার জন্যে স্যাকরাকে সঙ্গে এনে হামলা করলেন তাঁরা। ঠাকুমা অনেক মিনতি করলেন তাঁর ঈশ্বরের সিংহাসনকে রেহাই দিতে। তাঁকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া হল। আমার বিস্ফারিত চোখের সামনে যখন সিংহাসনের ওপর শায়িত শালগ্রামশিলার দিকে ওদের নোংরা হাত এগিয়ে যাচ্ছে সেই সময় ঠাকুমার চিৎকার শুনতে পেলাম, খুকু, আমার ঠাকুরকে বাঁচা!

পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছিলাম সামনে আর তখনই এক জেঠা সেই পাথরটাকে ছুঁড়ে দিলেন। কোনও লক্ষ না করে। আর আমার কপাল যেন সেটাকে টেনে নিল। অজ্ঞান হয়ে গেলাম। শুধু জ্ঞান হারাবার আগে রক্তের লাল পরদা চোখের সামনে চলে আসতে মানুষগুলোকে অন্যরকম মনে হয়েছিল।

নিশ্বাস নিল সুবর্ণা, এইসব ছবি আমার অ্যালবামে নেই। কিন্তু যখনই মানুষের স্বার্থসন্ধানী চিক্কারগুলো কানে আসে তখনই আমি কয়েকটা লাল নেকড়ের মুখ দেখতে পাই।

সোমনাথ মমতায় তাকাল, আপনার ঠাকুমা মুগ্ধ জননী ছিলেন কিন্তু সন্তানদের মানুষ করেনি!

হয়তো।

হয়তো নয়, নিশ্চয়ই। আপনাকে বলেছিলাম না, নদীর জল ভালো, কিন্তু তার শরীরে বাঁধ। প্রয়োজন। মানুষেরও তেমনি, শিক্ষার বাঁধ, রুচির বাঁধ, সংযমের বাঁধ–কিন্তু আপনার কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে।

বলুন!

আপনি নিজেকে নষ্ট করতে চান, কেন?

নষ্ট করতে চাই?

নিশ্চয়ই। অতীতের একটি স্মৃতি কেন আঁকড়ে আছেন?

আমি না, স্মৃতিই আমাকে আঁকড়ে আছে। এই দায় নিয়ে আমি কারও জীবন অসুস্থকরতে চাই না। তাছাড়া আমার যেসব সন্তান আসবে তারাও তো একদিন সিংহাসন টুকরো-টুকরো করে। নিতে পারে, পারে না?

সুবর্ণা নেমে দাঁড়াল। সোমনাথ বলল, দাঁড়ান। তারপর গাড়ি থেকে নেমে বলল, মানুষ যখন প্রথম আগুনের ব্যবহার করেছিল তাতে তার হাত পুড়েছিল, কিন্তু তখনই যদি আগুনকে বাতিল করা হত তাহলে সভ্যতা তো এখনও আদিম গুহায় মুখ গুঁজে থাকত, তাই না?

মানে?

শুধু মুগ্ধতাই নয় তার সতর্ক ব্যবহার চাই, এটুকু নিশ্চয়ই জানেন! আপনার কপালের ওই আঁচড় এখন থেকে অন্য অর্থে ব্যবহার করুন।

কী অর্থ?

অভিজ্ঞতাই মানুষকে অভিজ্ঞ করে। আর অভিজ্ঞ মানুষই ঠিক কাজ করেন। শুনুন, আপনি মোটেই অসুস্থ নন। সতের কোটি মানুষের এই দেশে আপনার চেয়ে সুস্থ কেউ হতে পারে না। সেই সুযোগ কেন হারাচ্ছেন?

আমি ভয় পাই কেন! সুবর্ণার মুখে দ্বিধায় ছায়া।

সোমনাথ বলল, নদীর একদিকে বাঁধ দিলে অন্যদিক ভেসে যেতে পারে। কিন্তু দুটো দিক যদি বেঁধে ফেলা যায় তাহলে জল নিয়ন্ত্রিত হবেই। আপনি যদি আমাকে সেই সুযোগ দেন তাহলে। সোনার সিংহাসন আর টুকরো-টুকরো হবে না।

সুবর্ণা হেসে ফেলল। এই প্রথম তাকে হাসতে দেখল সোমনাথ। তারপর শূন্য বিশাল বাড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, এই এখান থেকে আপনার মাকে ডাকুন তো?

মাকে? এখান থেকে? কেন?

উত্তরটা একটু পরেই দেব।

শুনতে পাবে না বোধহয়।

শুনতে পায় এমন গলায় ডাকুন। একটি মেয়ে তার মাকে ডাকছে!

সুবর্ণা একটু দ্বিধা এবং মজা পেল। তারপর গলার স্বর উদাত্ত করে চিৎকার করে ডাকল, মা-আ–আ!

আর ওই একটি নাভি-নিঃসৃত ধ্বনি যখন সামনের বাড়ির কক্ষে-কক্ষে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছিল তখন তার মনে হল সমস্ত পৃথিবীটা আচমকা পরম রমণীয় হয়ে উঠেছে। তার উজ্জ্বল মুখের সামনে একঝাঁক পায়রা ওই ধ্বনি শুনে পাখা ঝটপটিয়ে উড়ে গেল শরিকদের পরিত্যক্ত কক্ষ থেকে।

এই অমৃত শব্দটি কানে ফিরে আসতেই মুগ্ধ চোখে তাকাল সুবর্ণা সোমনাথের দিকে। সোমনাথ বলল, আপনার বাবা-মা ওপরের বারান্দায়। আমি কি ভেতরে যেতে পারি আপনার সঙ্গে?

নির্মেঘ সুবর্ণা সূর্যের মতো হাসল, হেসে মাথা নাড়ল।

এখন পর্যন্ত গল্পটি পড়া হয়েছে ২২ বার
যদি গল্পটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন