সমরেশ-মজুমদারের-গল্প-গুচ্ছ-সমরেশের-সেরা-১০১-গল্প.

শিরোনাম: আদ্যশ্রাদ্ধ

গল্পকার: Author Avatar সমরেশ মজুমদার

প্রথম এসেছিল অমল।

দিল্লি থেকে প্লেনেই উড়ে আসবে ভেবেছিল, কিন্তু রত্না বলেছিল, খামোকা অত টাকা কেন নষ্ট করবে, ট্রেনেই যাও, কোম্পানির পয়সায় তো ট্যুরে যাচ্ছ না!

কথাগুলো মনে ধরেছিল। অবশ্য টেলিগ্রাম পাওয়ার পর থেকেই মন অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। যেন দশমনি একটা পাথর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে মনের আংটায়। নড়তে-চড়তে বুকের মধ্যে। যন্ত্রণা। নিশ্বাস ভারী। সড়সড় করে সমস্ত ছেলেবেলা, কিশোর এমনকী যৌবনের প্রারম্ভকাল শেকড়-উপড়ানোর মতো চলে এল সামনে। তৎক্ষণাৎ অফিসে গিয়ে ছুটির দরখাস্ত করেছিল সে। মা মৃত্যুশয্যায়, ছুটি তো মঞ্জুর হবেই।

অফিসে বসেই প্লেনের জন্যে চেষ্টা করবে ভেবেছিল অমল। তার আগে বাড়িতে রত্নাকে খবরটা দিল। বৃন্দাবনদা টেলিগ্রাম করেছেন। সব শুনে রত্না ওই কথাগুলো বলেছিল। আর তারপরেই মনে হয়েছিল, খুব একটা দেরি হবে না। রাতের প্লেন ধরে কলকাতায় পৌঁছতে সাড়ে দশটা। মাঝে-মাঝে এত লেট হয় দুটো বাজলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। তার চেয়ে বিকেলের। রাজধানী ধরে সকালেই পৌঁছে যাওয়া যায়। চটপট কিছু টাকা ব্যাঙ্ক তুলে ও নতুন দিল্লি স্টেশনের সামনে থেকে টিকিটের ব্যবস্থা করে বাড়িতে এসে শুয়েছিল খানিক। তিন বছরের বাপ্পা কাছে ঘেঁষতেই রত্না নিষেধ করেছিল, বাপ্পা, বাপীর কাছে যেও না, ঠাকুমার শরীর ভালো নেই। সী ইস লিভিং আস।

ইংরেজি চারটে শব্দ কানে খট করে বাজলেও চুপ করে থাকল অমল। তার সত্যিই কান্না পাচ্ছিল। কেউ রইল না তার। বাবার সঙ্গে কোনওদিনই সম্পর্ক ভালো নয়। মা-ই তাকে সবসময় আড়াল দিয়েছে। এমনকী রত্নাকে বিয়ের ব্যাপারটায় বাবার আপত্তি মায়ের জেদে নরম। হয়েছিল। সেই মা চলে যাচ্ছে, হয়তো কলকাতায় গিয়ে দেখবে চলেই গিয়েছেন। বুকের আংটা ওজনের ভারে যেন খসে পড়েছিল।

প্রচণ্ড উদ্বেগ নিয়ে হাওড়া স্টেশনে নেমে সে আর ট্যাক্সির লাইনের জন্যে দাঁড়ায়নি। বাড়তি টাকা দিয়ে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে ছুটে এসেছিল সল্টলেকে। এখানেই সুইমিং পুলের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক শতদল দত্ত বাড়ি করেছেন। আধুনিক সেই বাড়িতে মোট পাঁচটি ঘর। দোতলায় দুটি, একতলায় তিনটি, বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নেমে অমল নিশ্বাস বন্ধ করে ওপরের দিকে তাকিয়েছিল। কোনও সাড়াশব্দ নেই। ভাড়া মিটিয়ে ব্যাগটা বাঁ-হাতে নিয়ে গেটের দিকে পা বাড়াতেই দোতলার বারান্দা থেকে বৃন্দাবনের গলা পাওয়া গেল, ওই যে, ছোট দাদা এসে গিয়েছে। বলার ধরনে এক ধরনের আহ্লাদ ছিল; সিঁড়িতে পা দিতে-দিতে তেমনই মনে হল অমলের। কেউ মরে গেলে এমন গলায় কথা বলা যায় না। অন্তত বৃন্দাবনদার মতো মানুষ তো পারবেই না।

বৃন্দাবনদা দরজা খুলেই বলল, যাক, তুমি এসে গিয়েছ! খুব ভালো হল।

মা কেমন আছে? প্রশ্নটা যেন ছিটকে বের হল।

মাথা নাড়ল বৃন্দাবনদা, না, তারপরেই কেঁদে ফেলল, ডাক্তার জবাব দিয়ে গিয়েছে।

কোথায় আছে? কোন নার্সিংহোমে?

না, না, বাড়িতেই আছে।

বাড়িতে? বাড়িতে ট্রিটমেন্ট হচ্ছে?

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল বৃন্দাবনদা, বয়েস হয়েছে। পনের দিন ধরে ভুগছেন, একটু-একটু করে, শেষে বুকের ব্যথা বাড়ল। বাবু নার্স আনালেন, অক্সিজেন, অক্সিজেন, স্যালাইন–সব বাড়িতেই দেওয়া হচ্ছে, কোনও ত্রুটি হয়নি।

দাদাদের খবর দিয়েছ?

হ্যাঁ। একসঙ্গেই টেলিগ্রাম করেছি। চল।

বাবা কোথায়?

তিনি তো মায়ের সামনে দিনরাত বসে আছেন। ওখানেই খান, ওখানেই ঘুমোন। শুধু বাথরুমের সময় ওঠেন। আরও জড়ভরত হয়ে গেল মানুষটা।

এই সময় বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়াল। বৃন্দবনদা বলল, ডাক্তারবাবু এসেছেন।

অমল দেখল একটি প্রৌঢ় ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসছেন। তাঁর সঙ্গে বৃন্দাবন আলাপ করিয়ে দিতে ভদ্রলোক বললেন, ভালো করেছেন এসে। ইটস এ লস্ট কেস। শরীর আর রেসপন্স করছে না। আমরা ভেবেছিলাম রাত কাটবে না। এখন যতক্ষণ থাকেন ততক্ষণই লাভ।

আপনি ওঁকে নার্সিংহোমে ট্রান্সফার করছেন না কেন?

কোনও লাভ নেই। এটা বয়সের ব্যাধি। নিজের জায়গায় শেষ নিশ্বাস ফেললে উনি বেশি আরাম পবেন। তাছাড়া মিস্টার দত্ত চিকিৎসার ত্রুটি রাখেননি।

ডাক্তারের পেছন অমল ওপরে উঠে এল। ঘরে ঢুকেই অমল শতদল দত্তকে দেখতে পেল। জানলার ধারে একটা ইজিচেয়ারে বসেছিলেন বৃদ্ধ। পায়ের শব্দে মুখে ফেরাতেই অমলের সঙ্গে চোখাচোখি হল। অজান্তেই কেঁপে উঠল অমল। বৃদ্ধের চোখে কোনও অভিব্যক্তি নেই। এগিয়ে এসে প্রণাম করতে যেতেই শতদল বললেন, থাক। অসুস্থ মানুষকে প্রণাম করতে নেই।

অমল হকচকিয়ে গেল। শতদলও কি অসুস্থ? সে মুখ ফিরিয়ে দেখল ডাক্তার মায়ের বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। সে মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল মায়ের কাছে।

চারুশীলা শুয়ে আছেন। প্রায় অস্থির চেহারা। না, স্যালাইন বা অক্সিজেনের কোনও চিহ্ন দেখল না অমল। ডাক্তার ওঁর নাড়ি দেখছেন। স্টেথোস্কোপটা বুকে চাপলেন। তারপর মৃদুস্বরে ডাকলেন, মিসেস দত্ত আপনার ছেলে এসেছেন, মিসেস দত্ত?

মায়ের মুখে কোনও অভিব্যক্তি এল না। তাঁর চৈতন্য এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যেখানে জাগতিক কোনও শব্দও পৌঁছয় না। ডাক্তার বৃন্দাবনদাকে জিজ্ঞাসা করলেন, নার্স কোথায়?

এই মাত্র বাথরুমে গিয়েছে। বৃন্দাবনদা জবাব দিল।

ডাক্তার চলে গেলেন শতদল দত্তের কাছে, আপনি কিন্তু সারাক্ষণ এখানে এভাবে বসে থেকে অন্যায় করছেন। আপনাকে তো ওঁর কথা বলেছি।

ও কখন যাবে ডাক্তার।

সেটা বলা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলতে পারি চিকিৎসাশাস্ত্রে এক্ষেত্রে কোনও কিছু করণীয় নেই।

তাহলে আমার ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিলেই ভালো হয়। শতদল দত্ত মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আর সেই সময় নার্স ঢুকল। মায়ের বিছানার পাশেদাঁড়িয়ে বেশ অবাক হয়ে গেল অমল। ভদ্রমহিলা সাদা শাড়ি, মানে যাকে বলে নার্সের ইউনিফর্ম পরেছেন বটে কিন্তু এমন লাস্যময়ী নার্স সে কখনও দেখেনি। ডাক্তার ভদ্রমহিলার সঙ্গে ওষুধ নিয়ে কথা বললেন। অমল মায়ের দিকে তাকাল। তার বুক কেঁপে উঠল। পাথরের মতো মুখ। মাথায় হাত বোলাল সে। তারপর নিচু গলায় ডাকল, মা!

চারুশীলার মুখে সামান্য কুঞ্চনও এল না। অমল কপাল, গাল, চিবুকে আঙুল বোলাল। তারপর গাঢ় গলায় আবার ডাকল, মা! মাগো!

চারুশীলার কোনও পরিবর্তন হল না। নার্স এগিয়ে এলেন, এক্সকিউস মি, উনি রেসপন্স করতে পারবেন না। ডেকে কোনও লাভ নেই।

মেজাজ খুব বিগড়ে ছিল কমলের। সুজাতা টিভি সিরিয়ালের সুটিং করতে গিয়ে ভোররাতে বাড়ি ফিরেছে। সে পইপই করে বলেছিল, টিভিতে অভিনয় করছ করো কিন্তু বাড়ির শান্তি যেন বজায় থাকে। সুজাতা সুন্দরী। যদিও তেত্রিশ বছর বয়েস কিন্তু রাখতে পেরেছে বলে পচিশের বেশি। মনে হয় না। ফিল্মেও সুযোগ পেয়েছিল সুজাতা কিন্তু রাজি হয়নি কমল। টিভি যেন ঘরোয়া শিল্প, সুজাতারও খুব আগ্রহ ছিল, রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। সুটিং-এর জন্যে বাইরে রাত কাটানো এর আগে কখনও হয়নি। ইতিমধ্যে সুজাতার একটা সিরিয়াল নেটওয়ার্কে দেখিয়েছে। অফিসে এই কারণে কমলেরও গ্ল্যামার বেড়েছে। সুজাতার সঙ্গে বাইরে বেরুলে কেউ না কেউ তাকাবেই। গর্ব যে হয় না তা নয়। তাই বলে রাত কাটিয়ে ফিরবে? মেজাজ তাই ভালো ছিল না। এমন সময় টেলিগ্রামটা এল। মা মৃত্যুশয্যায়, তাড়াতাড়ি চলে এসো। বৃন্দাবনদা।

খপ করে বুকের বাঁ দিকটায় যেন খিচ লাগল কমলের। মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি অন্তত পাঁচ বছর। পাঁচ বছর কলকাতায় যাওয়া হয় না। বাবা সল্টলেকে বাড়ি করেছেন তা পাঁচ বছর আগে দেখে এসেছে সে। জন অ্যান্ড মিল কোম্পানির পাবলিক অফিসার কমল দত্ত এখন এত ব্যস্ত। মানুষ যে ব্যক্তিগত যোগাযোগ আত্মীয়দের সঙ্গে রাখতে পারে না। কিন্তু মা অসুস্থ, মৃত্যুশয্যায়, জানতে পারা মাত্র ওর মনে হল এক্ষুনি কলকাতায় যাওয়া উচিত। ভোররাতে ফেরা সুজাতাকে ঘুম থেকে তুলে ঘটনাটা বলল সে। সুজাতা বলল, অসম্ভব। আমার আগামী চারদিন শুটিং আছে। যাওয়ার ইচ্ছে হলে তুমি যাও।

প্রচণ্ড রেগে গেল কমল, কি আশ্চর্য, আমার মা তোমার শাশুড়ি!

চোখ ছোট করে সুজাতা জিজ্ঞাসা করল, তুমি আজ হঠাৎ খেপে গেলে কেন?

মানে?

এতগুলো বছর একবারও বুঝতে পারিনি মায়ের ওপর তোমার এমন টান আছে। উনি চিঠি দিলেও তো উত্তর লেখার সময় পেতে না। তা ছাড়া ভদ্রমহিলা অসুস্থ, আমার কিছু বলার নেই, কিন্তু তুমি তো জানতে ওঁর বিরুদ্ধে আমার কিছু অভিযোগ আছে।

কমল জানে। জানে বলেই সেইসময় মায়ের ওপর বেশ রেগে গিয়েছিল। কলকাতায় গিয়ে দু দিন থাকতে-না-থাকতেই সুজাতা হয় দার্জিলিং নয় দীঘায় বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করত। মা বলেছিলেন, তাহলে লোক দেখিয়ে এখানে ওঠা কেন বাপু, হোটেলে থেকে ওসব করলেই পারো। কথাগুলো না বললেই পারতেন মহিলা। জ্ঞান হাওয়া ইস্তক দেখে এসেছে কমল, উনি সোজা কথা মুখের ওপর বলে দেন। বাবার সঙ্গে যে কতবার ঝগড়া এবং কথা বন্ধ হল তার ইয়ত্তা নেই।

অতএব আর কথা বাড়াল কমল। যতই হোক মা ইজ মা, সে মনে-মনে বলল। অতএব বোম্বে থেকে সকালেই প্লেনে দমদমে পৌঁছে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের অবস্থা প্রায় ট্রেনের মতন। এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সি ধরতে বেলা বারোটা বাজল। সেখান থেকে সোজা সল্টলেক।

বাড়ির সামনে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে সিগারেট ধরাল কমল। মা যদি চলে গিয়ে থাকে, হঠাৎ বুকের ভেতর মেঘ জমতে শুরু করল, ঠোঁট কামড়াল সে। পা ভারী হয়ে উঠল। সে ধীরে-ধীরে ভেতরে ঢুকে বেল বাজাল। মিনিটখানেকের অপেক্ষা। কমলের মনে হচ্ছিল সে অন্য কারও বাড়িতে এসেছে। বয়স এবং দূরত্ব কিভাবে মানুষকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। দরজা খুলল। কমল অবাক হল, অমল দাঁড়িয়ে, পরনে পাঞ্জাবি এবং পাজামা। অর্থাৎ কমল তার আগেই এসে গিয়েছে। অমল বলল, ওছ দাদা, এসো।

কমল ঘরে ঢুকল। অমলকে সে কত বছর পরে দেখছে তা মুহূর্তে মনে করতে পারল না। ভেতরে ঢুকে চারপাশে তাকিয়ে আরও অস্বস্তি বাড়ল। সে জিজ্ঞাসা করল, মা?

অবস্থা ভালো নয়। ডাক্তার এসেছিলেন একটু আগে। বললেন কোনও চান্স নেই।

ঠিক কী হয়েছে?

বললেন বয়স হলে যা হয়। কথাও বলতে পারছেন না, কোনও হুঁশ নেই।

কমল ঠোঁট কামড়াল। হঠাৎ তার কান্না পেল। মুখ চোখ দুমড়ে গেল। চোখ ঝাঁপসা। ব্যাপারটা অমলকেও আচমকা স্পর্শ করল, দাদা, শক্ত হও। শী ইজ স্টিল উইথ আস।

মেজ আসেনি?

না। আমাদের তিনজনকেই একসঙ্গে টেলিগ্রাম করেছিল বৃন্দাবনদা।

আমরা বোম্বে দিল্লি থেকে আসতে পারলাম, আর ও গৌহাটি থেকে–। যাক, বাবা কেমন আছে? শক্ত আছে তো?

মনে হয় না। মায়ের ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।

সেকি! মা কি বাড়িতে আছে?

হ্যাঁ, ডাক্তারকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উনি বললেন নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে কোনও লাভ হবে না। মায়ের কাছে গিয়ে আমারও তাই মনে হল।

কমল সোফায় বসে পড়ল। দুহাতে মুখ ঢাকার চেষ্টা করে আঙুলের ডগায় চোখ মুছল। অমল উলটো দিকে বসল। মুখ গম্ভীর। সে দাদাকে একবার দেখল। বউদি টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করছে অথচ দাদার চেহারায় বয়স এসে গিয়েছে বেশ। জুলপি পাকা, সামনের দিকের চুল অনেকটা উঠে গিয়েছে। ভারী হয়েছে শরীর। ছেলেবেলায় দাদাকে সবাই বলত গুডি বয়। লালুভুলু। দাদার চেহারায় সেই মোলায়েম ব্যাপারটা আর নেই। ভালো চাকরি করে, পয়সাও বানিয়েছে কিন্তু অমলের মনে হল সুখে নেই দাদা। রত্না তো বউদিকে সহ্য করতে পারে না। নেট ওয়ার্কের সিরিয়ালে অভিনয় দেখে প্রচুর খুঁত বের করেছিল। কিন্তু আজ অমলের মনে হল দাদার মধ্যে আগেকার ভালো মানুষ ব্যাপারটা এখনও রয়ে গেছে।

সে জিজ্ঞাসা করল, ওপরে যাবে না দাদা?

কমল মুখ তুলল, আমি মাকে ওভাবে দেখতে চাইনি অমল!

এইসময় বাইরের দরজায় শব্দ হল। অমল নিঃশব্দে উঠে গিয়ে দরজা খুলল। তারপরেই গলা তুলে বলল, মেজদা এসেছে।

কমল শরীরটাকে তোলার চেষ্টা করেও আবার বসে পড়ল। সে শুনল, শ্যামল বলছে, মা কেমন আছে?

অমল তাকে দরজাতে দাঁড়িয়ে একই ঘটনা বলে গেলে সে ভেতরে ঢুকল। শ্যামল জিজ্ঞাসা করল, ও দাদা, কখন এলে?

কমল কাঁধ নাচাল। শ্যামল সোফায় বসে বলল, বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

আমি ওপরে যাইনি এখনও। যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না। কমল জবাব দিল।

শ্যামল বলল, আমি তো টেলিগ্রাম পেয়ে অবাক। গতবছর একবেলার জন্যে কলকাতায়। এসেছিলাম, মানে রাত্রে এসে পরদিনই চলে গিয়েছিলাম, তবু সময় বের করে এখানে এসে। দেখা করে গিয়েছি। মা তখন অ্যাবসলিউটলি নর্মাল। আমার সঙ্গে একটু কথা-কাটাকাটি হল। তেমন কিছু নয়। কোনও অসুখ তো দেখিনি।

কমল জানতে চাইল, কি নিয়ে কথা-কাটাকাটি হয়েছিল।

সিলি ব্যাপার! আসলে কলকাতায় এলে বড়শালার কাছেনা উঠলে এমন ঝামেলা হয় যে কি বলব। মা তাই নিয়ে ছেড়ে দাও। আমাকে যে বউ-এর সঙ্গে সারাজীবন বাস করতে হবে তা মায়ের মাথায় ঢোকে না। অথচ বাবা তো চিরকাল বউ-এর দাবি মেনে চললেন। সেটা তো আমরা দেখেছি। সত্যি মারা যাবে?

কমল বলল, অমল তো বলল ডাক্তার তাই বলেছে।

উঃ, আমি ভাবতেই পারছি না। চোখ বন্ধ করল শ্যামল।

অমল বলল, তোমরা ওপর থেকে ঘুরে এসো। কখন যে ঘটনাটা ঘটে যাবে কে জানে!

এইসময় বৃন্দাবনদা নেমে এল একটা ট্রে হাতে নিয়ে। এদিকে তাকাতেই লোকটার মুখে হাসি। ফুটল, আমি জানতাম খবর পাওয়া মাত্র তিনজনেই চলে আসবে। হাজার হোক পেটের ছেলে।

কমল তাকে ইশারায় ডাকল, মা কি করছেন?

যাও না, দেখে এসো। এতদূর ছুটে এসে এখানে বসে আছ কেন?

কমলের বারো বছর বয়সে বৃন্দাবন এ বাড়িতে কাজে লেগেছিল। এখন এই কথা বলার ধরনে তার রাগ হলেও সে চুপ করে গেল। বৃন্দাবন বলল, দেখা করে এসে হাতমুখ ধুয়ে নাও সবাই, আমি চা বানাচ্ছি। জলখাবার না একেবারে ভাত দেব?

শ্যামল বলল, হোল নাইট ট্রেনে জেগে এসেছি, আমি শুধু চা খাব।

বাকি দুজন কিছু বলল না। শ্যামল বলল, অমল, তুইও চল সঙ্গে।

শতদল দত্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে চারুশীলার মাথায় হাত রাখলেন। বেশ উত্তাপ আছে। কপালে এসে পড়া চুল সরিয়ে দিলেন। বাঁ হাত বুকের ওপর ভাঁজ করা আছে, সরিয়ে রাখলেন। প্রথম-প্রথম নার্সের সামনে এসব করতে সঙ্কোচ হত, আজকাল হয় না। কিছু করার না থাকলে মেয়েটা পাশের চেয়ারে বসে সিনেমার ম্যাগাজিন পড়ে। চেয়েও দেখে না তিনি কি করছেন। শতদল ঝুঁকে পড়লেন, চারু! শুনতে পাচ্ছ? ও চারু। ইউ কান্ট গো লাইক দিস। আমি তোমার থেকে পাঁচ বছরের বড়, যাওয়ার কথা আগে আমারই। চারু।

এইসময় দরজার কাছে শব্দ হল। চমকে সোজা হতে-হতে পেছন ফিরলেন শতদল। তিন পুত্র একই সঙ্গে দরজায়। হঠাৎ তিনি তিনজনের ভালো নাম মনে করতে পারলেন না। তবে বোম্বে গৌহাটি দিল্লির কথা মনে পড়ল। তাঁর তিন প্রবাসী পুত্র।

তিনি কোনও কথা না বলে চুপচাপ জানালার পাশের ইজিচেয়ারে ফিরে গেলেন। ওরা ধীরে-ধীরে চারুশীলার পাশে এসে দাঁড়াল। কমল ডাকল, মা, মা!

নার্স বলল, উনি শুনতে পাচ্ছেন না।

কমল থমকে যেতেই হঠাৎ একটা শব্দ, যা কান্নারই বহি:প্রকাশ, ছিটকে এল গলা থেকে। শতদল কথা বললেন, এখনও সময় হয়নি। অসময়ে কান্নাকাটি এই ঘরে হোক আমি চাই না!

তিন পুত্র একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল শতদল কথাগুলো বলেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছেন। শ্যামল এগিয়ে গেল তাঁর কাছে।

বাবা!

বলতে পারো।

বাবা, আপনি এখন আর আমাদের ওপর রাগ করবেন না।

আমি রাগ করেছি এই খবর কোত্থেকে পেলে?

না, মানে, আচ্ছা মায়ের চিকিৎসা আর একটু ভালোভাবে করা যায় না?

খারাপভাবে হচ্ছে তা তোমাকে কে বলল?

আমি বলছিলাম যদি ওঁকে নার্সিংহোমে, মানে আমার শালা তো নামকরা ডাক্তার, ওর নার্সিংহোম আছে, আপনি তো জানেন–আর একটু চেষ্টা করা যেত!

তোমার আর কোনও কথা বলার আছে? শতদল সরাসরি তাকালেন।

এবার কমল এগিয়ে গেল, বাবা, আপনার কি মনে হচ্ছে চিকিৎসার কোনও ত্রুটি হচ্ছে না? আপনি যা বলবেন তাই হবে।

আমি ভেবে পাচ্ছিনা, তোমরা কয়েক মিনিট আগে এসে কি করে বুঝে গেলে ট্রিটমেন্ট ঠিক হচ্ছে না। অবশ্য তোমরা ওর ছেলে, তোমরা বলতেই পারো।

আপনি যখন বলছেন তখন আমাদের আর কি বলার থাকতে পারে। কিন্তু আপনার এবার বিশ্রামের প্রয়োজন। এভাবে বসে থাকাটা ঠিক নয়।

শতদল কমলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, তোমরা সবাই একাই এসেছ?

কমল ঠোঁট কামড়াতে গিয়েও সামলে নিল, হ্যাঁ।

বেশ তো। তাহলে নিচে যাও, খাওয়াদাওয়া করে বিশ্রাম নাও। অনেকদিন বাদে তিনভাই পরস্পরের দেখা পেলে। অন্তত খবর পাওয়া মাত্র এসেছ বলে আমি খুশি।

বৃন্দাবনার রান্না খারাপ নয়। যদিও আর একটি কাজের মেয়ে রয়েছে। ওরা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বাইরের ঘরে এসে বসল। আগে অমল দাদাদের সামনে সিগারেট খেত না, আজ ধরাল। কমল জিগ্যেস করল, তোর খবর কী?

চলছে। বউদির সিরিয়াল দেখলাম।

ওই, হবি আর কি! আমি বাধা দিই না, রত্না কেমন?

আছে। আসতে চেয়েছিল, আমি সঙ্গে আনিনি।

ভালোই করেছিস। এখানে এত টেনশন–।

শ্যামল চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎ বলল, বাবাও কেমন বদলে গিয়েছে।

কমল হাসল, বাবার সঙ্গে চিরকালই আমাদের দূরত্ব ছিল।

অমল বলল, বাবা কিন্তু মাকে খুব ভালোবাসেন।

কমল বলল, আগে বুঝিনি। আজ মনে হল। মানুষের বোধহয় বয়স বাড়লে প্রেমও বাড়ে। তোর মনে আছে শ্যামল, একবার স্কুল থেকে কার রবার চুরি করেছিলি বলে বাবার কাছে জোর মার খেয়েছিলি!

এই যাঃ, আমি চুরি করিনি, ভুল করে নিয়ে এসেছিলাম।

সঙ্গে-সঙ্গে কমল এবং অমল হেসে উঠল। হঠাৎ ওরা অতীতে ফিরে গেল। তিনজনেই স্মৃতিতে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট-ছোট্ট ঘটনা তুলে এনে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখা শুরু করল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সবাই ঘটনাটার বিশ্লেষণে একমত হচ্ছিল না। তবু এই জাবর কাটায় খুব মজা পাচ্ছিল। অনেক–অনেক কাল এই ধরনের কথাবার্তা বলা হয় না। এইসব কথা বলার মানুষও চারপাশে থাকে না। কবে কখন কমল অমলকে চাঁটি মেরেছিল চটি পরার জন্যে, কবে শ্যামল কমলের একটা টাকা চুরি করেছিল, তখনকার রাগ আজ নেহাতই সুখকর স্মৃতি। তিন ভাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিল। এইসময় বৃন্দাবন এল, অনেক কষ্টে বাবুকে শুতে পাঠিয়েছি। তোমরা একজন ওপরে যাবে?

অমল তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। বাকি দুজনের মনে ওই মুহূর্তে ইচ্ছে এলেও অমলকে উঠতে দেখে তারা আর উদ্যোগ নিল না। অমল চলে গেলে শ্যামল বলল, অমলটা সেই ছেলেবেলার মতো রয়েছে। সব কিছু আগে না পেলে কীরকম কান্নাকাটি না করত।

কমল বলল, বুঝলি, অনেক ভেবে দেখলাম, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হল ছেলেবেলা। কি ভালোই না ছিলাম তখন। টেনশন ছিল না, নিজের কথা ভাবতে হত না।

সত্যি কথা। এখন টাকা, ভবিষ্যৎ, বর্তমান, স্ত্রী, বাচ্চাকাচ্চা–।

আমাকে তো ভগবান ও ব্যাপারে দয়া করলেন না।

ডাক্তাররা কী বলছে! শ্যামল জানতে চাইল।

মেজভাই-এর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে সঙ্কোচ হচ্ছিল তবু কমল বলল, হবে না।

শ্যামল নিশ্বাস ফেলল, খুব টায়ার্ড লাগছে। রাত্রে ট্রেনে ঘুমাতে পারিনি।

ঘুমিয়ে নে।

নাঃ। একবার শ্যালকের বাড়ি যেতে হবে। কখন মায়ের কি হয়ে যায়, তখন আর সময় পাব না। আমি বরং ঘুরেই আসি। শ্যামল উঠল।

অমল মায়ের পাশে বসে দেখল মাঝে-মাঝে গালের চামড়ায় কুঞ্চন হচ্ছে। সে ঝুঁকে ফিসফিস করল, মা!

উনি শুনতে পাবেন না। নার্সটি বলে উঠল।

আপনি এরকম কেস আগে দেখেছেন? অমল মুখ তুলে মহিলাকে দেখল। চেহারা দেখে নার্স বলে মনে হয় না। বউদির বদলে ইনি টিভি সিরিয়ালে নামলে বেশি নাম করতে পারতেন।

মহিলা ঠোঁট টিপে হেসে নিয়ে বললেন, অ-নে-ক। আপনারা মন তৈরি করে নিয়েছেন, শুধু আপনার বাবা বিশ্বাস করতে চাইছেন না।

অমল মায়ের পাশ থেকে উঠে বাবার খালি চেয়ারটায় গিয়ে বসল।

নার্সটি সিনেমার পত্রিকায় নজর রাখল। অমল জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি সবসময় এইভাবে বসে থাকেন? ডিউটি কতক্ষণ?

চব্বিশ ঘণ্টার। ইচ্ছে করেই নিয়েছি। টাকার খুব দরকার। আবার হাসি।

কত টাকা দেওয়া হচ্ছে?

দেড়শো। পত্রিকাটি পাশে রাখল সে, আপনি দিল্লিতে থাকেন?

হ্যাঁ। কেন?

দিল্লিতে আমার স্বামী থাকেন।

ও। আপনারা আলাদা আছেন?

অনেক দিন। বছরে একবার দেখা হয়। বাপের বাড়ির খরচ চালাই বলে টাকার দরকার। আমার অবশ্য এই চাকরি করার কথা নয়।

আপনাকে দেখে তাই মনে হয়।

দুচোখে অদ্ভুত কাজ দেখাল মহিলা, কী মনে হয়?

আপনি অন্যরকম।

মহিলা মুখ নামালেন। অনেকক্ষণ কোনও কথা হল না। হঠাৎ মহিলা বললেন, আমি তো আছি।

আপনি বিশ্রাম নিন। অতদূর থেকে এসেছেন।

আমি এখানে থাকলে আপনার অসুবিধে হবে?

না, না। প্রতিবাদ করলেন মহিলা।

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। মাঝে-মাঝে চোখাচোখি হচ্ছে। আর হঠাৎই সেইসময় শিহরণ বোধ করল অমল। ভদ্রমহিলার চোখে অদ্ভুত আকর্ষণী ক্ষমতা রয়েছে। এই সময় বৃন্দাবনদা এল, যাও, গিয়ে একটু শোও, আমি বসছি। বসে থাকতে খুব আরাম পাচ্ছিল অমল কিন্তু না উঠে পারল না। ওঠার সময় আর এক দফা চোখাচোখি। অনেক কথা যেন বলা হয়ে গেল।

*

বিকেলে ডাক্তার এলেন। চারুশীলাকে দেখে নেমে এসে বললেন, অবস্থা আরও খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে কয়েক ঘণ্টা। কিছু হলে আমায় খবর দেবেন।

ডাক্তার চলে গেলে কমল বলল, অন্যান্য আত্মীয়দের খবর দেওয়া উচিত।

শ্যামল প্রতিবাদ করল, আত্মীয়? এঁরা এখানে রয়েছেন কেউ তো দেখতে আসেনি। ছেড়ে দাও ওসব। কিন্তু সন্ধের পর কিছু হলে কী করবে?

অমল কেঁদে ফেলল। শ্যামল ধমকাল, বোকার মতো কাঁদিস না। ওইভাবে পড়ে থাকার চেয়ে মায়ের যাওয়াই ভালো।

কমল নিশ্বাস ফেলল, খুব যন্ত্রণা পাচ্ছেন।

অমল ভাঙা গলায় বলল, বাবার কী হবে?

শ্যামল বলল, সেটাই ভাবছিলাম। বাবা তো আমাদের কারও কাছে গিয়ে থাকতে পারবেন না। অবশ্য বৃন্দাবনদা আছে এখানে।

কমল বলল, মিছিমিছি খরচ করলেন বাড়িটার পেছনে।

শ্যামল বলল, কথা শুনবেন না। আমি তো বলেছি এ বাড়ির ওপর আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। আমি তো এসে থাকব না কোনওদিন।

অমল বলল, ইন্টারেস্ট আমারও নেই।

বাবা না থাকলে বিক্রি করে দিতে হবে। কমল বলল।

শ্যামল একটু চুপ করে থেকে বলল, কিভাবে নিয়ে যাবে?

তিনভাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। অমল বলল, এসব কথা এখনই বলা কি ঠিক?অবশ্য ডাক্তার বলে গেলেন–।

কমল বলল, তখন মাথা ঠিক থাকবে না। কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া খুব প্রিমিটিভ আইডিয়া।

শ্যামল বলল, গাড়ি পাওয়া যায়। শালাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ও একটা ফোন নম্বর দিয়েছে। ফোন করলেই চলে আসবে গাড়ি।

অমল বলল, গুড। কাঁচের গাড়ি নিশ্চয়ই।

তাই তো।

আর ইলেকট্রিক চুল্লিতে কাজ করব। চিতা-ফিতা সহ্য করতে পারব না। তবে কাছাকাছি ইলেকট্রিক চুল্লি আছে কিনা জানি না।

শ্যামল বলল, কাগজে পড়েছি নিমতলাতে আছে। ওটাই কাছে।

ফুলটুল–? কমল জিজ্ঞাসা করল।

ওই গাড়ির জন্যে ফোন করেই বৃন্দাবনদাকে পাঠাব।

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। একটা ভারী আবহাওয়া তৈরি হয়ে গেল। হঠাৎ অমল বলল, উঃ, ছেলেবেলায় মা আমাকে ভাত খাইয়ে দিত!

কমল বলল, সবাইকে মা দিয়েছে। যাই বলিস, মায়ের বিকল্প অন্য কোনও মেয়ে হয় না। সুজাতার মধ্যে টের পার্সেন্ট গুণ নেই।

রত্নার মধ্যে আছে ভেবেছ? ওই ম্যাক্সিমাম টেন পার্সেন্ট।

অমল ফোঁস করে উঠল। শ্যামল কোনও মন্তব্য করল না।

কমল বলল, কাল সকালের বোম্বে ফ্লাইট কখন রে?

কালই চলে যাবে? অমল জানতে চাইল।

আর থেকে কি করব! খাঁ-খাঁ করবে বাড়ি।

তা ঠিক। আমিও ভাবছি দিল্লির ফ্লাইট ধরব। এক্সট্রা কিছু খরচ হবে, রত্না চটবে, বাট নাথিং ডুয়িং। অমল বলল।

তোদের টাকা আছে, প্লেনে যা। আমি ভাই ট্রেনে। সকালে শালার বাড়িতে চলে যাব। সন্ধেবেলায় কামরূপ এক্সপ্রেস।শ্যামল বলল।

অমল বলল, ভালোই হল, কাল অফিসে যাওয়া খুব জরুরি ছিল।

কমল হাত নাড়ল, তুই জানিস না, এইভাবে হুট করে চলে এসে কি ক্ষতি করলাম নিজের! ভার্মা এই চান্সকে কাজে লাগাবেই। পেছনে পড়ে আছে আমার! কাল ব্যাটাকে চমকে দেব।

ছোট বলেই অমলের ওপর দায়িত্ব পড়ল মাঝে-মাঝে মায়ের ঘরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসা। এখন শতদল দত্ত চারুশীলার মাথার পাশে বসে আছেন। বারংবার ঢুকতে লজ্জা হল। অমল ইশারায় নার্সকে বাইরে ডাকল, যদি মাঝে মাঝে বাইরে এসে আমাকে বলে যান মা কেমন আছে, বুঝতেই পারছেন বাবা মাকে এখন একা পেতে চাইছেন।

হাসল মেয়েটি, ওঁদের মধ্যে খুব গভীর প্রেম ছিল, না?

বাপ-মায়ের প্রেম নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছে হল না অমলের, সে হাসল।

নার্স বলল, ঠিক আছে। আমি নিচে যাব, না আপনি ওপরে আসবেন?

আমিই আসব। এত পরিশ্রম করেও আপনি হাসেন কি করে বলুন তো?

আমার হাসি আপনার খারাপ লাগে? চোখে জল এল।

না, না। দারুণ!

আহা। শরীর ঘুরিয়ে মেয়েটি চলে গেল।

মিনিট পনের বাদে বন্দাবন ছুটে এল ওপর থেকে। টেলিফোনের ডায়াল ঘোরাতে লাগল। তিন ভাই ব্যস্ত হয়ে উঠল। ডাক্তারকে ফোন করে বৃন্দাবন বলল, মা কেমন করছে।

ডাক্তার এলেন। রাত দশটা পর্যন্ত তিন ভাই প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করল। মাঝে-মাঝে সবাই ওপরে যাচ্ছে। আর তখন চারুশীলার গলা থেকে বের হওয়া যন্ত্রণার শব্দ শুনতে পেল ওরা। চারুশীলা বলছেন, উঃআঃ।

এগারোটার সময় ডাক্তার নিচে নেমে বললেন, স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার। আমার জীবনে এমন কেস কখনও দেখিনি।

কী অবস্থা? শ্যামল জিজ্ঞাসা করল।

ডাক্তার বললেন, নার্সিংহোমে ফোন করতে হবে।

নার্সিংহোমে? কী ব্যাপার? কমল চমকে উঠল।

ডাক্তার বললেন, হঠাৎ জীবনের লক্ষণ ফিরে এসেছে। এখন মনে হচ্ছে ওঁকে নার্সিংহোমে ট্রান্সফার করা দরকার। এখনই।

ডাক্তার ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স আনতে বললেন। অমল জিজ্ঞাসা করল, তাহলে আজ রাত্রে কোনও সম্ভাবনা নেই?

কেউ বলতে পারে না। অনেক সময় প্রদীপ নেবার আগে বেশি আলো দেয়। তবে মনে হচ্ছে। এবার ফাইট করার সুযোগ পাওয়া যাবে। আসলে আপনার বাবার মনের জোরেই উনি বোধহয়–।

অ্যাম্বুলেন্স এল। স্ট্রেচারে শুইয়ে নিয়ে যাওয়া হল চারুশীলাকে। তিন ভাই এবং শতদল দত্ত সঙ্গে গেলেন। শতদল দত্তকে নিষেধ করা হয়েছিল কিন্তু তিনি শোনেননি। ভরতি হওয়ার পর শতদল অসুস্থ বোধ করলেন। নার্সকে বাড়িতেই রেখে আসা হয়েছিল। অত রাত্রে বেচারা কোথায় যাবে। নার্সিংহোমে চারুশীলার পাশে থাকতে দেওয়া হবে না শতদলকে। তাঁর শরীর খারাপ লাগছিল। অতএব অমল তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনল। আসার পথে শতদল বললেন, জীবনে কখনও প্রার্থনা করিনি হে। তোমার মা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে করে যাচ্ছিলাম। আমি এখন নিশ্চিন্ত যে সে ফিরে আসবে!

অমল বলল, এ নিয়ে ভাববেন না।

নার্সকে ঘুম থেকে তোলা হল। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়ে সে শতদলকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। অমল ফিরে এল নিজের ঘরে। দাদারা নার্সিংহোমে। বৃন্দাবন তার বাবুর ঘরে বিছানা করে মাটিতে শুয়েছে।

হঠাৎ দরজায় শব্দ হল। অমল দেখল নার্স দুটো সন্দেশ আর জল নিয়ে তার ঘরে ঢুকছে, এগুলো খেয়ে নিন। আজ তো কিছুই পেটে পড়েনি।

অনেক ধন্যবাদ। হাসল অমল।

আমার চাকরি গেল।

না, বাবাকে দেখাশোনা করবেন আপনি।

সত্যি? আপনি কি ভালো!

অমলের অনেক কিছু ইচ্ছে হচ্ছিল। বিয়ের পর সে রত্না ছাড়া কোনও মেয়েকে কামনা করেনি। আজ সেই ইচ্ছেটা হল। নার্স বলল, আপনার মা ভালো হয়ে যাবেন। আমার মন বলছে ভালো। হবেনই।

তবু আপনি ওঁদের দেখাশোনা করবেন।

কিন্তু আপনি তো এখানে থাকবেন না?

হুঁ, মাঝে-মাঝে আসব।

অদ্ভুত! ভদ্রমহিলা বললেন, মিথ্যে কথা কেন বলেন? আপনাদের স্ত্রীরা এখানে আসতেই দেবে মাঝে-মাঝে!

একথা আপনাকে কে বলল?

আপনার মা। যখন প্রথম এলাম তখন বলেছিলেন। নার্স ফিরে গেল। অমলের মনে হল সে যেন প্রচণ্ড এক চড় খেয়েছে।

ভোরবেলায় দুই ভাই ফিরে এল। চারুশীলার মধ্যে জীবনের লক্ষণ ফুটে উঠেছে। এখন শুধু লড়াই করার সময়। এই লড়াই কদিন ধরে চলবে কেউ বলতে পারে না। ডাক্তার বৃন্দাবনদা এবং নার্স আছে। অতএব ছুটি নিয়ে অনন্তকাল কেউ বসে থাকতে পারবে না।

তিনভাই একসঙ্গে শতদলের ঘরে গেল। তিনি তখন বিছানায় বসে। চুপচাপ চারুশীলার খবর শুনলেন। শুনে বললেন, হ্যাঁ, লড়াই করার সুযোগ পেলে সে কখনও হারবে না। আমার জন্যেই তাকে ঘিরে আসতে হবে। দায়, তার, দায় আমার। তা তোমরা এখানে থেকে কী করবে?

আমরাও তাই ভাবছিলাম। কমল বলল।

ঠিকই ভেবেছ।

যদি মায়ের শরীর, মানে কিছু হয়, সঙ্গে-সঙ্গে খবর দেবেন।

কেন?

আমরা চটপট চলে আসব।

না, না, মাথা নাড়লেন শতদল। হিন্দুদের শাস্ত্র আমি ভালো জানি না। তবে মাতৃদায় তো একবারেই মিটে যায়। তোমাদের মিটে গিয়েছে, এই এলে, এসে চুকিয়ে দিলে, দ্বিতীয়বারের কি প্রয়োজন?

এখন পর্যন্ত গল্পটি পড়া হয়েছে ১২ বার
যদি গল্পটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন