সমরেশ-মজুমদারের-গল্প-গুচ্ছ-সমরেশের-সেরা-১০১-গল্প.

শিরোনাম: হয়তো পরের পূর্ণিমায়

গল্পকার: Author Avatar সমরেশ মজুমদার

আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখছিল সে। রাগি মোষের মতো তেড়ে আসছে মেঘগুলো। অতবড় আকাশটার দখল নিতে তীব্রগতিতে ছুটে যাচ্ছে চারপাশে। বড় মেঘের সঙ্গে ছোট মেঘগুলো জুড়ে যাচ্ছে চটপট। মোষের কথা মনে হলেও মেঘগুলো যেন মোষের চেয়েও কালো এবং ভয়ঙ্কর। অথচ দেখতে-দেখতে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল সে। তার কেবলই মনে হচ্ছিল সে যদি ওই মেঘেদের শক্তি পেত! পৃথিবীর কোনও মানুষের ওই শক্তি নেই।

মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঈর্ষা করতে-করতে সে এমনই বিহুল যে, কেউ যে তাকে ডাকছে তা টের পায়নি। মেঘেদের শরীরে শক্তি আছে, মেঘ দেখলে কে না ভয় পায়! উন্মুখ হয়ে সে ভাবছিল, আহা মেঘেদের শক্তি যদি তার মধ্যে চলে আসত! এই সময় পৃথিবী প্রায় অন্ধকার। সংঘর্ষে মেঘেদের বুক থেকে বিদ্যুৎ ছিটকে নেমে আসছে পৃথিবীতে। এইসব মিলেমিশে যে ভুবনমোহিনী রূপে আকাশ সেজেছে, তা তার চোখে পড়ছিল না। সে শুধু ঈর্ষাকাতর হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

অ্যাই সুন্দর, এত ডাকছি, কথা কানে যায় না?

সে মুখ নামাল। জগদীশদাদাঁড়িয়ে আছে।

তোকে ডাক্তারবাবু তখন থেকে ডাকছে চল। জগদীশদা হাঁটতে লাগল। ওর একটি পা বেঁকে ছোট হয়ে যাওয়ায় হাঁটতে অসুবিধে হয়। হাঁটার সময় মনে হয় এই বুঝি পড়ে গেল। সুন্দর জগদীশের পাশে চলে এল, আচ্ছা জগদীশদা, তোমার পা ঠিক হয়ে গেলে কীরকম হয়?

হবে না। ডাক্তারবাবু বলেছেন, কখনও হবে না। দুটো পা সমান-সমান করতে যে টাকা লাগবে তা এ-জীবনে পাব না আমি। জগদীশদাঁড়িয়ে গেল।

যদি হয়?

বামন হয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন! চল।

যদি আমি তোমার পা ঠিক করে দিই? সুন্দরের বলার ভঙ্গি জগদীশকে অবাক করল। তারপরই সে হো-হো করে হেসে উঠল। তার শরীর কাঁপতে লাগল। পেটে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। হাসতে-হাসতে। সুন্দর হতভম্ব হয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। হঠাৎ মনে হল, সে কিছু না, কোনও অসম্ভব কাজকে সম্ভব করার শক্তি ভগবান তাকে দেননি। সে দৌড়াতে লাগল। এই সময় ঝোড়ো বাতাস শুরু হল, শীতল ঝোড়ো বাতাস।

কোথায় গিয়েছিলি? বিশাল চেহারা থেকে বাজখাঁই গলা ভেসে এল।

মাঠে। সুন্দর মাথা নামাল।

মাঠে? এই বাদলবেলায় মাঠে কার গরু খুঁজতে গিয়েছিলি?

আজ্ঞে–।

এসব বাঁদরামো আমার এখানে চলবে না। তোকে আমি কী বলেছিলাম?

এতক্ষণে মনে পড়ল। ডাক্তারবাবু তাকে ইসমাইলের মাংসের দোকানে যেতে বলেছিলেন। আজ রাত্রে মাংস হবে। বেমালুম ভুলে গিয়েছিল সে।

কোনও কথা না বলে দ্রুত ছুটতে লাগল সে। আর সঙ্গে-সঙ্গে বৃষ্টির ফোঁটা শরীরে তিরের মতো বিধতে লাগল। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে সে দৌড়োতে লাগল। যেন বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিজে যাওয়ার আগে হাটের মুখে ইসমাইলের দোকানে পৌঁছে যাবে।

এই মফস্বল শহরে মানুষ একেই কম, তারপর বৃষ্টি-টিষ্টি হলে রাস্তা একদম ফাঁকা। অসময়ে একটা পাতলা অন্ধকার পৃথিবীর ওপর ঝুলছিল। একেবারে ভিজে চুপসে সুন্দর ইসমাইলের দোকানে পৌঁছে দেখল কোনও পাঁঠার ঠ্যাং শিকে ঝুলছে না। লম্বা বিড়ি টানতে-টানতে ইসমাইল বৃষ্টি দেখছিল, বলল, কী চাই?

মাংস।

দোকান পরিষ্কার। কাল সকালে এসো।

বলেই চোখ ছোট করল, তুমি ডাক্তারবাবুর কাছে আছ না? হ্যাঁ মনে পড়েছে। মুশকিল হয়ে গেল।

কেন?

ডাক্তারবাবুর পাঁঠা আজ আমার কাছে নেই। বলবে ইসমাইল ক্ষমা চেয়েছে। থাকলে এই বিকেলবেলাতেও নতুন মাল কাটতাম। ডাক্তারবাবু আমাদের ভগবান।

তার মনে পড়ল। ডাক্তারবাবু যে-সে পাঁঠার মাংস খান না। শুধু ছোলা খেয়ে বড় হতে হবে। ওটাকে। গায়ের রং হবে মিশমিশে কালো। ধরতে গেলেই ঘাড় বেঁকিয়ে উঁস দিতে আসবে, এমন রাগি। সেই পাঁঠার মাংস নাকি যেমন নরম তেমন সুস্বাদু। মাংস কেনার কথা হলেই ডাক্তারবাবু এইরকম বর্ণনা দেন।

বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফিরছিল সুন্দর। কোথায় বর্ধমানে মামাদের বাড়ি আর কোথায় বিহারের এই আধাপাহাড়ি মফস্বল শহর। আঠারো বছর বয়সেও পড়াশুনা না হওয়ার জন্যেই কাজকর্ম তেমন জুটল না তখন ঘর ছেড়েছে সে। ঘর বলতে মামার বাড়ি। বাপ জন্ম দিয়েই মরে গিয়েছিল। বিধবা মায়ের সঙ্গে আশ্রয় পেতেছিল মামার বাড়িতে। তারা যে আশ্রিত, মামার দাক্ষিণ্যে বেঁচে আছে একথা প্রতি পদে মনে রাখতে হত। ভুলে গেলেই প্রহার। মামার শরীরের শক্তি ফুরিয়ে এলেও আঠারো বছরের শক্তিশালী ভাগ্নের গায়ে জুতো ছুঁড়ে মারতে দ্বিধা করতেন না। কারণ তিনি জানতেন জাদুকাঠি তাঁর হাতে। তখন মামাকে কংসের মতো মনে হত। আর মনে হতেই শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় নিজেকে দেখতে চাইত সে। শ্রীকৃষ্ণ যখন সমস্ত অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন অবহেলায় তখন সে পারবে না কেন? নিশ্চয়ই পৃথিবীর কোথাও এমন কোনও মন্ত্র অথবা অমৃত লুকোনো আছে যা পান করলেই অমিতশক্তির অধিকারী হওয়া যায়। মা বলেছিলেন তাকে। পালিয়ে যেতে, এখানে পড়ে-পড়ে অন্ন ধ্বংস করছিস আর মার খাচ্ছিস। তোর লজ্জাও হয় না! এত বড় শরীরটা দিয়ে কিছু কর। নিজের ভাত নিজে জুটিয়ে নে। পালা এখান থেকে। আমার জন্যে তোকে চিন্তা করতে হবে না।

দু-চারটে জামাপ্যান্ট ঝোলায় ভরে বেরিয়ে পড়েছিল সে। বর্ধমান স্টেশন থেকে ট্রেনটা ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে না জেনেই উঠে বসেছিল। ট্রেনটা ছিল রাতের। দেহাতি কিছু মানুষ আর কয়েকজন শহরের লোক বসেছিলেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। একপাশে চুপচাপ বসেছিল সে। আর তখনই মনে হয়েছিল সে যদি ট্রেনের ড্রাইভার হত! তাহলে এই ট্রেনটা নিয়ে সে পৃথিবীর কোনও অজানা প্রান্তে চলে যেত। হু-হুঁ করে ছুটে চলা ট্রেন, চাকার শব্দ, হুইসেলের আওয়াজ একসঙ্গে মিলেমিশে তাকে উত্তেজিত করে তুলছিল বেশ। আলোগুলো যেন অসহায় হয়ে পেছনে ছিটকে চলে যাচ্ছে। গোটা পৃথিবীটা হেরে যাচ্ছে এই ট্রেনের বিক্রমের কাছে। আহা, সে যদি ট্রেনটাকে নিয়ন্ত্রন করার কায়দা জানতে পারত।

টিমটিমে আলোর একটা স্টেশনে ট্রেনটার থামার কোনও দরকার ছিল না। তবু থামল। এবং তখনই একজন চেকার উঠে এল। লোকটা চারপাশে তাকিয়ে তার মুখে কি দেখতে পেল কে জানে, সোজা সামনে এসে হাত পাতল, টিকিট।

কামরার অল্প আলোতেও সে দেখতে পেল লোকটার হাতে কোনও রেখা নেই। এটা কী করে সম্ভব? হাতের রেখা তো ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। দু-বছর আগে একজন জ্যোতিষী তাকে বুঝিয়েছিল সুদিন আসতে তার দেরি নেই।

টিকিট?

আমি টিকিট কাটিনি।

টিকিট কাটোনি অথচ ট্রেনে চড়েছ?কী আস্পর্ধা। টিকিট কাটোনি কেন?

টাকাপয়সা নেই।

ক্রিমিন্যাল। ঠান্ডা মাথার ক্রিমিন্যাল। সামনের স্টেশনে তোমাকে নামতে হবে।

এই সময় মোটাসোটা এক ভদ্রলোক ওপাশ থেকে বলে উঠলেন, এই যে, শ্রীমান, এদিকে এসো। হ্যাঁ, তোমাকে বলছি। এসো।

বাধ্য হয়ে সুন্দর তার ঝোলা নিয়ে এগিয়ে গেল।

কোথায় যাওয়া হবে?

মাথা নিচু করল সে, জানি না।

জানো না! বাড়ি থেকে পালিয়েছ নাকি?

না থাকতে পেরে চলে এসেছি। মামা–।

মা আছেন?

হ্যাঁ। মা-ই বলল আসতে।

হুঁ। পড়াশুনা কদুর?

এইট পর্যন্ত পড়েছিলাম।

বাঃ। একেবারে বিদ্যের হিমালয়। চাকরি করবে?

সুন্দর ফ্যালফ্যাল চোখে তাকাল। লোকটাকে যেন সে দেখতে পাচ্ছে না।

আমার কাছে যে ছিল তার ওপর ভরসা করতে পারতাম। একদিনে হবে না, তবে আগ্রহ যদি থাকে তাহলে আমি শিখিয়ে নেব। এই ধরো ব্যান্ডেজ বাঁধা, ওষুধগুলো এগিয়ে দেওয়া, ডিসপেনসারির দরজা খোলা-বন্ধ, ঝাঁট দেওয়া। এগুলো প্রথমদিকে। এর সঙ্গে আমি ইনজেকশন দেওয়াও শিখিয়ে দেব পরে। রাজি?

সে মোলায়েম ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল।

নিন চেকারমশাই, ওর টিকিটের দাম আমিই দিয়ে দিচ্ছি।

চেকার এবং আরও কয়েকজন এইসব সংলাপ অবাক হয়ে শুনছিল। চেকার বলল, কিন্তু এটা কি ঠিক করছেন? চেনাজানা নেই একটা উটকো লোককে হুট করে চাকরি দিয়ে দিলেন। ও তো চোর ছ্যাঁচোড় হতে পারে!

মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, হতে পারে। তবে উটকো লোকের সুবিধে হল দুবার ভাবতে হয় না। একবারই দূর করে দেওয়া যায়।

বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে শীত করছিল, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সুন্দর বলল, নেই।

ডাক্তারবাবু অবাক হয়ে তাকে দেখলেন, বৃষ্টিতে ভিজতে কে বলেছে?

খেয়াল ছিল না।

এবার সর্দি হবে, জ্বর আসবে। আমাকে জ্বালানোর মতলব? এসব ছ্যাঁচড়ামি আমার এখানে চলবে না। মাংস নেই মানে?

আপনার মাংস নেই।

হঠাৎ হো-হো করে হাসতে লাগলেন ডাক্তার, সত্যি কথা, চর্বিগুলো বেড়ে গিয়ে মাংস বোধহয় কমে যাচ্ছে। ঝটপট শুকনো জামাপ্যান্ট পরে আয়।

তা এখানে মাস তিনেক হয়ে গেল। এখন সে ওষুধগুলো চিনে গিয়েছে বললে একটু মিথ্যে বলা হবে। তবে বেশিরভাগ ওষুধ সে চেনে। ব্যান্ডেজ বাঁধতে পারে। ডাক্তারবাবু সেটা নিজের হাতে শিখিয়েছেন। এক-এক প্রয়োজনে আলাদা-আলাদা ব্যান্ডেজ। ব্যান্ডেজ বাঁধতে সুন্দরের খুব ভালো লাগে। পরতে-পরতে জড়িয়ে যায়। কোথাও বেঢপ উঁচু হয়ে থাকে না। ডিসপেনসারির দায়িত্ব তার। রাত্রে এখানেই শোওয়া। সেটা অবশ্য আর-এক জ্বালা। মাঝরাত্রে কেউ দরজায় এল, খুলুন, খুলুন, ছেলের এই হয়েছে, মেয়ের তাই হয়েছে। খুলতে হয়। তারপর ভেতরের। দরজায় আওয়াজ করে ডাক্তারবাবুর ঘুম ভাঙিয়ে সমস্যার সমাধান। কয়েকদিন আগে রাত গভীরে ঠিক ওইরকম ধাক্কা। যেন পেটের ছেলে পড়ে যাচ্ছে। কী ব্যাপার?না, পরিবারের সকাল থেকে পাতলা পায়খানা হচ্ছিল, এখন একেবারে জল ছিটকাচ্ছে। শোনার পর ডাক্তারবাবুকে ডাকতে গিয়ে সে থমকে দাঁড়াল। রাতের খাওয়াদাওয়ার পর লোকটা অনেকক্ষণ ধরে বই। পড়েন। একবারে ঘুম আসতে চায় না। লোকটাকে ডাকতে মায়া হল। তার মনে পড়ল শরীরের ওই অবস্থায় ডাক্তারবাবু যে ওষুধ দিয়ে থাকে তা সে জানে। বাঁদিকের তাক থেকে দুটো বড়ি বের করে নিয়ে এসে দরজা খুলে সে আগন্তুককে দিল, এখনই একটা খাইয়ে দাও, পরেরটা চারঘণ্টা পর। নুন-চিনির জল ছাড়া কিছু খাবে না। বুঝেছ?

পরের দিন দুপুরে সেই লোকটি হাজির। ডাক্তারবাবু তখন রুগি দেখছিলেন। লোকটি বলল, আপনি ভগবান। দুটো বড়ি দিলেন তাতেই আমার পরিবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। জলের মতো পায়খানা হচ্ছিল, কী বিশ্রী গন্ধ! আর হচ্ছে না। তা জিজ্ঞাসা করছি, শেষ বড়ি তো। ভোরবেলায় পড়েছিল, আর কী দিতে হবে?

যেখান থেকে নিয়েছ সেখানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো।

ওষুধ তো আপনিই দিয়েছেন। কাল অনেক রাত্রে এসে ডাকলাম, আপনার নতুন লোক ভেতর থেকে ওষুধ এনেছিল, এঃ, সব ভুলে গেছেন।

ডাক্তারবাবু ডাকলেন, সুন্দর।

কাজটা ঠিক হয়নি কিনা বুঝতে পারছিল না সুন্দর। একটু অস্বস্তি নিয়ে সে সামনে গেল। ডাক্তারবাবুর গলা শান্ত কিন্তু কীরকম অচেনা, কী ওষুধ দিয়েছিস?

সুন্দর বাঁদিকের তাক থেকে ওই ধরনের বড়ি এনে দেখাল। মাথা নাড়লেন ডাক্তারবাবু, ঠিক আছে। আর যখন হয়নি তখন খাওয়ানোর দরকার নেই। তবে একটা কাছে রাখ। যদি দ্যাখো আবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তখন খাইয়ে দিয়ো। আর হ্যাঁ, আজ কোনও সলিড খাবার নয়।

সে তো ঠিকই। কাল আপনি যেমন বলেছিলেন তাই দিচ্ছি।

কী বলেছিলাম?

নুন-চিনি জল।

ও। না, আজ একটু চিঁড়ে ভিজিয়ে একেবারে কাদা করে দিয়ে।

শেষ রুগিকে দেখে ডাক্তারবাবু আবার ডাকলেন। কাছে যেতেই প্রচণ্ড একটা চড় এসে পড়ল। গালে। সুন্দরের স্বাস্থ্য ভালো। গত তিনমাসে সেটির প্রভূত উন্নতি হয়েছে। তবু ওই চড়ের আঘাত সামলাতে না পেরে অনেকটা টলে গেল। ডাক্তারবাবু চিৎকার করে উঠলেন, হতচ্ছাড়া বদমাশ, ডাক্তার হয়েছ? ডাক্তার হওয়ার শখ? আমাকে না জানিয়ে ওষুধ দেওয়া? ওষুধের একটু হেরফেরে মানুষের প্রাণ চলে যায় তা জানিস! অনেক কষ্ট, ধারধোর করে ডাক্তারি পড়েছি আমি। আর তুই দু-দিনের জন্যে এখানে এসে আমার ওপর দিয়ে যাচ্ছিস!

আপনি ঘুমোচ্ছিলেন।

তাতে তোর কী! নরনারায়ণের সেবা করতে এটা খুলেছি? ঘুমাচ্ছি বলে সেটা বন্ধ থাকবে নাকি? আর কক্ষনও যদি কোনও ওষুধ আমার অজান্তে কাউকে দাও তাহলে আমি জেলে ঢুকিয়ে দেব। দূর হ।

মানুষের উপকার করলে ওইরকম ব্যবহার পাবে? সুন্দরের খুব রাগ হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারখানা বন্ধ হওয়ার পর সে স্নান-খাওয়া করতে গেল না। এখন প্রায় পড়ন্ত দুপুর। চারধার খাঁ-খাঁ করছে। ডাক্তারখানার সামনে একটা বড় বটগাছের নিচে বসেছিল সে। ডাক্তারবাবু যখন তাকে মারল তখন সে পালটা আঘাত করতে পারত। তার শরীরেও যে শক্তি আছে তা বুঝিয়ে দিতে পারত। কিন্তু কথাটা সে সময় মাথায় আসেনি। এখন আসতে লাগল। ডাক্তারবাবু আর যাই হোক মামার মতো নয়। লোকটার মধ্যে ভালোবাসা আছে এটা সে টের পায়। ডাক্তারবাবুকে পালটা মারার কথা মনে এসেছে বলে এখন খারাপ লাগল। কিন্তু কথাটা ঠিক, ডাক্তারবাবু অন্যায় করেছে। ওইভাবে মারা ঠিক হয়নি। সে তো ভালো কাজই করতে চেয়েছিল। কিন্তু তা তো হল, সে যদি খুব কষ্ট করে ডাক্তার হতে পারত! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডাক্তার। যার ওষুধে যে-কোনও অসুখ সেরে যাবে। ডাক্তারবাবু ভালো কিন্তু অনেকের অসুখ সারাতে পারেনি। চারজন মানুষকে সে জানে। যারা এই তিনমাসে শুধু ওষুধ খেয়ে যাচ্ছে, কোনও উপকার হয়নি। ডাক্তারবাবুকে লোকে। ভগবান বলে কিন্তু ওঁর ওষুধ খেয়েও তো বাজারের এক দোকানদার মরে গেল। তবে? সে যদি ডাক্তার হত তাহলে পৃথিবীর কেউ মারা যেত না, এমনকী মামার যে অসুখটা এখন বাড়ছে সেটাও সারিয়ে দিত। কিন্তু কী করলে সেরকম ডাক্তার হওয়া যায়?

গত দু-তিন বছরে সে কম চেষ্টা করেনি। পঞ্জিকার বিজ্ঞাপন দেখে কোনওমতে দশ টাকা জোগাড় করে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এক্সট্রা স্ট্রং মাদুলি এসেছিল। সেটা পরে মনে হয়েছিল পৃথিবীতে তার চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ নেই। মামাতো ভাই খবরটা ফাঁস করে দিতে মামা তাকে বেধড়ক পিটিয়ে ছিল টাকা নষ্ট করার জন্যে। মাদুলিটা কোনও কাজেই লাগেনি। বর্ধমান শ্মশানের কাছে একজন সাধুগোছের লোক এসেছিল। এক বন্ধুর সঙ্গে সে গিয়েছিল লোকটার। কাছে। তার প্রার্থনা শুনে লোকটা দু-লাইন মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছিল। দিনে এক হাজার বার ওই মন্ত্র জপ করলে কাজ হবে। তারপর যার দিকে তাকাবে সে-ই বশীভূত হবে। ঠিক এক হাজার বার। জপ করার পর সে একটা ষাঁড়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। ষাঁড়টা হঠাৎ তেড়ে এল তার দিকে। সে বড় চোখে তাকিয়েও যখন ওটাকে বশীভূত করতে পারল না তখন প্রাণ বাঁচাতে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। আগেকার কাল হলে সে সাধনায় বসত। গায়ে উইপোকার ঢিবি গজিয়ে গেলেও আসন ছেড়ে নড়ত না। যখন তার সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব বর দিতে আসতেন তখন টুক করে সেটা চেয়ে নিত। কিন্তু এখনকার কালে কেউ সাধনা করে না। মহা মুশকিল।

জগদীশ এল, ডাক্তারবাবু ডাকছেন।

কেন?

তোর জন্যে সবাই বসে থাকবে নাকি?নাওয়া-খাওয়া করবি না?

আমার ভালো লাগছে না।

সেটা তুই নিজের মুখে বলে আয়। জগদীশ ফিরে গেল খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে।

রান্নাঘরের বারান্দায় আসন পেতে ডাক্তারবাবু খেতে বসেছিলেন। এইভাবেই খাওয়া ওঁর অভ্যেস। এই মফস্বল শহরে ওঁর খাওয়া নিয়ে লোকে গল্প করে। আমের সময় সব খাওয়ার পর কুড়িখানা আম খেয়ে নেন। এককেজি মাংস একাই শেষ করে ফেলতে পারেন। অথচ এসবের। জন্যে ওঁর শরীর কখনও খারাপ হয় না।

উঠোনে দাঁড়িয়ে সুন্দর দেখল ডাক্তারবাবু মাছের মুড়ো খাচ্ছেন। এতবড় মুড়ো এর আগে কারও পাতে দেখেনি সে। তাকে দেখলেন ডাক্তারবাবু। সমুদ্র শুষে নেওয়ার মতো মুড়োর ঘিলু শুষে। বললেন, ইডিয়ট। আমার ওপর রাগ করে তুই নিজের পেটকে কষ্ট দিচ্ছিস? তোকে চড় মেরেছি কারণ শাস্তিটা তোর প্রাপ্য ছিল। তাই বলে না খেয়ে কাকে কষ্ট দিচ্ছিস?যা স্নান করে নে, আজ। রান্নাটা জব্বর হয়েছে। পেট পুরে খেয়ে ফ্যাল।

অনেক কথা মাথায় এসেছিল কিন্তু বলতে পারা গেল না।

সেই বিকেলে ডিসপেনসারি খোলার আগে ডাক্তারবাবু তাকে ডাকলেন, হ্যাঁ রে, আমার মনে হচ্ছে তোর আর এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। তাই তো?

সুন্দর জবাব দিল না। চট করে কিছু বলা ঠিক নয়।

তোর মুখ-চোখ দেখে তাই মনে হচ্ছে। তা বাবা, মতলবটা খুলে বলো।

আমার এইভাবে থাকতে ভালো লাগে না।

কীভাবে?

আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ হতে চাই। বলার সময় আচমকা মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল।

শ্রেষ্ঠ মানুষ? বাঃ। খুব ভালো। স্বপ্ন দেখতে হলে বড়সড় দেখাই ভালো। তা কীরকম শ্রেষ্ঠ মানুষ? মিস্টার ইউনিভার্স? পৃথিবীর সেরা শরীর?

সুন্দর একঝলক ভেবে নিয়ে মাথা নাড়ল, অনেকটা।

অনেকটা আবার কি রে? বলো, পুরোটা। শোন, সবার সেরা তো এমনি-এমনি হওয়া যায় না। তোকে তার জন্যে পরিশ্রম করতে হবে। সকাল বিকেল কারও কোচিং-এ কঠোর অনুশীলন। করতে হবে। তামিস্টার ইউনিভার্স হওয়ার জন্যে যে বয়স থেকে ওটা করতে হয়, সেটা প্রায়। পেরিয়ে এসেছিস। তবু চেষ্টা কর। কলকাতায় গিয়ে মনোতোষ রায় মশাই-এর কাছে ভরতি হ। আমি চিঠি দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু মনে রাখিস এটা খেলা নয়, কঠোর পরিশ্রম এবং সাধনা। আর। এসব করেও শেষপর্যন্ত যে তুই মিস্টার ইউনিভার্স হবি এমন কোনও গ্যারান্টি নেই। নইলে রানার্স আপ পদটা থাকবে কেন? তাকেও তো একই সাধনা করতে হয়।

তারপর?।

তারপর? পুলিশে চাকরি করবি। না হলে অন্যদের ব্যায়াম শেখাবি। তারপর শরীর বুড়িয়ে গেলে বলবি আমি একসময় মিস্টার ইউনিভার্স হয়েছিলাম। ব্যস!

না। আমি ওরকম হতে চাই না।

অ। কীরকম চাও?

আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ হব। যা চাইব তাই করতে পারব।

তাহলে তোমাকে নীলগাইয়ের দুধ খেতে হবে। ডাক্তারবাবু খুকখুক করে হাসলেন।

নীলগাইয়ের দুধ?

হুঁ। সেটা এমনি খেলে চলবে না। বাঁটে মুখ লাগিয়ে খেতে হবে। আর খাওয়ার সময়টা ঠিক রাতদুপুরে জ্যোৎস্না ফুটলে। পারবি?

পারব। কিন্তু নীলগাই কী জিনিস?

গরু। তবে আমাদের চারপাশের পোষা গরুদের মতো নয়। তারা জঙ্গলে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। দলবেঁধে। জ্যোৎস্না রাতে তাদের শরীর থেকে অদ্ভুত নীলচে আভা বের হয়। স্বপ্ন আর জাগরণ একাকার হয়ে যায়। মাকে টাকা পাঠিয়েছিস?

অ্যাঁ?

এ মাসে মাইনে পেয়ে মাকে টাকা পাঠিয়েছিস?

হ্যাঁ।

বাঃ। আমি বলি কী, প্রতি রাত্রে স্বপ্নেনীলগাই দেখার চেষ্টা কর। যতদিন পর্যন্ত সেটা না দেখবে ততদিন এখানেই কাজ কর। সামনের সপ্তাহে আমি ইনজেকশন দেওয়া শিখিয়ে দেব। যাঃ।

রাত্রে ঘুম আসছিল না। চোখের সামনে শুধুনীলগাই তার বাঁটভরতি দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তারবাবুর গোয়ালে যে সাদা গোরুটা দুধ দেয় তাকে দেখে এসেছে। বাঁটে মুখ দিতে গেলে ও লাথি মারতে চাইবে বটে তবে শ্রেষ্ঠ পুরুষ হওয়ার জন্যে ওরকম লাথি খাওয়া যায়।

পর-পর তিনটে রাত সে ঘুমাল অথচ স্বপ্ন দেখল না। স্বপ্নই যখন দেখা হল না তখন নীলগাই অনেক দূরে থেকে গেল। হঠাৎ তার মনে হল, যদি সে কোনওদিন স্বপ্ন না দেখে তাহলে তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়ে যাবে। সে জগদীশকে একা পেয়ে প্রশ্ন করল। জগদীশ মাথা নাড়ল, নীলগাই? তারা তো এখানে থাকে না।

কোথায় থাকে?

তুই বরং হারান মাস্টারকে জিজ্ঞাসা কর। ও ঠিক ঠিকানা বলে দেবে।

অগত্যা হারান মাস্টারের শরণাপন্ন হল সুন্দর। হারান মাস্টার মাথা নাড়ল, তারা থাকে পাহাড় আর সমতলের মাঝখানে। বেশি উঁচুতে নয় আবার নিচুতেও নামে না। তবে সেই পাহাড়ের বুকে যদি নদী থাকে আর শীতকালে তার জল শুকিয়ে যায় তাহলে নীলগাইয়ের দল সেই নদীর চরে ঘুরে বেড়াতে খুব ভালোবাসে।

কিন্তু জায়গাটা কোথায়?

ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে, আফ্রিকার উত্তর ভাগে, ব্রাজিলে এবং কিছু-কিছু দেখা যায় অস্ট্রেলিয়াতেও। ম্যাপ দেখবে?

আমাদের এখানে পাওয়া যায় না?

নিশ্চয়ই যাবে। যাবে না কেন?

পাহাড়। কোনখানে? কোন ট্রেন সেখানে যায়? স্টেশনে গিয়ে খবরটা পেতেই আর কিছু মনে রইল না। পকেটে কিছু নেই, পুঁটলিটা ডিসপেনসারির কোনায়, কী-এক ঘোরের মধ্যে সে ট্রেনে উঠে বসল। জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে চোখ যখন টনটন করছে তখনই দিগন্তে। পাহাড়ের রেখা দেখা গেল। ধীরে-ধীরে আরও স্পষ্ট হচ্ছিল পাহাড়। ছোট স্টেশনে ট্রেন থামছে, হাঁপাচ্ছে, আর সুন্দরের মনে হচ্ছিল কতক্ষণে ছাড়বে। পাশের লোকটাকে সে জিজ্ঞাসা করল, ওই পাহাড়ে ট্রেনটা কতক্ষণে পৌঁছবে?

পাহাড়ে তো ট্রেন যায় না। পাহাড়ের পাশ কাটিয়ে চলে যাবে।

সে কী! সুন্দর হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ল।

আজ তার দিকে কোনও কালো কোট পরা মানুষ হাত বাড়াল। ট্রেন চলে গেলে সে হাঁটা শুরু করল। আধ ঘণ্টা হাঁটতেই সে পাহাড়ের নিচে। পাথুরে হলেও পাহাড়ের গায়ে গাছপালা আছে। শেষ দেহাতি লোকটাকে সে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, এই পাহাড়ে কী নীলগাই আছে?

জানি না বাবু। তবে অনেককিছু আছে।

নদী আছে?নদীর চর?

নাঃ। তবে খুব বড় দিঘি আছে একটা।

পাহাড়ের বুকে দিঘি? সুন্দরের মনে হল নদীর চরে যদি নীলগাই বেড়াতে আসতে পারে তাহলে দিঘির ধারে আসবে না কেন? সে হাঁটতে লাগল। পাহাড়ে চড়ার অভ্যেস না থাকলেও সে দ্রুত উঠছিল। ক্রমশ লোকালয় হারিয়ে গেল। পাখির ডাক আর বাঁদরের চিৎকার ছাড়া কোনও শব্দ নেই। দুপুর পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। খিদে-তেষ্টায় শরীরের শক্তি ক্রমশ উধাও হয়ে যাচ্ছিল। সে নিজেকে বোঝাচ্ছিল, এসবই তার পরীক্ষা। সাধনার পথে এভাবেই পরীক্ষা দিতে হয়।

হঠাৎ তার খেয়াল হল। এখন কি চাঁদ ওঠার রাত? গতরাতেও বৃষ্টি হয়েছিল। তার আগে? জ্যোৎস্না দেখেছে বলে মনে হয় না। অথচ চাঁদের রাত হওয়া দরকার। এই বনপাহাড়ে নীলগাই যদি থাকে তাহলে সে অপেক্ষা করবে চাঁদের জন্যে। কথাটা যদি আগে মাথায় আসত তাহলে সময় বুঝে আসা যেত।

এতটা পথ পাহাড়ে-জঙ্গলে হেঁটে এল কিন্তু কোনও প্রাণীর দেখা সে পায়নি। এই জঙ্গল কী প্রাণীশূন্য? বাঁদর আছে, মানে গাছে ফল আছে। কিন্তু বড়সড়া জন্তুরা থাকবে এমন কথা নেই। সে ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে-হাঁটতে বিলের ধারে একটা পাথরে ঠেস দিতেই প্রশ্নটা ভেসে এল, অ্যাই? কে তুই?

চমকে পেছনে তাকাতেই সে অবাক হয়ে গেল। একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মাথারচুলে জটা পাকিয়ে চুড়ো হয়ে আছে। পরনে আলখাল্লা, হাতে একটা ত্রিশূল। কপালে মস্ত সিঁদুরের টিপ। মহিলার চোখদুটো খুব বড় এবং জ্বলছে। সে ভয় পেয়ে গেল। বর্ধমানের শ্মশানে একজন ভৈরব। তাঁর ভৈরবীকে নিয়ে কদিনের জন্যে এসেছিল। সেই ভৈরবী এমন ভয়ঙ্কর সুন্দরী ছিল না। হ্যাঁ, সুন্দরী তো বটেই। গায়ের রং ফরসার দিকে, শরীর টানটান এবং লম্বা। ডানহাতে একটা পুঁটুলি।

কে তুই? আবার গর্জন ভেসে এল।

আমি সুন্দর। সে মিনমিনে গলায় বলল।

সু-ন্দ-র! বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন ভৈরবী। তারপরই গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মতলব কি? এখানে এসেছিস কেন?

কেন? এখানে আসা কি বারণ?

হ্যাঁ বারণ। এ তল্লাটের সব্বাই জানে। মড়া পোড়ানো ছাড়া কেউ এদিকে পা বাড়ায় না। মতলববাজদের পেট ফুঁড়ে দিই আমি। আমাকে চিনিস?

আজ্ঞে না। আমি বর্ধমানে থাকি।

বর্ধমান! সে তো অনেক দূর। এখানে কেন?

সুন্দর বুঝল তার পরিত্রাণ নেই। তারপরই খেয়াল হল। এই ভৈরবী যদি এখানে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই জানেন নীলগাই এই পাহাড়ে আছে কিনা, সে হাতজোড় করল, আমি কোনও অন্যায় করতে আসিনি। আপনি বলোতে পারেন, এই পাহাড়ে নীলগাই আছে কিনা! আমার খুব দরকার!

নীলগাই? কীসের দরকার?

একটা সাধনা আছে।

সাধনা? ফক্কিবাজি! মিথ্যে বললে দেব তোর জিভ খসিয়ে।

আমি নীলগাইয়ের বাঁট থেকে দুধ খেতে চাই।

অ্যাঁ? কেন?

সেটা বলা নিষেধ।

তিনকুলে কেউ আছে?

না। কেউ নেই।

এখানে থাকা হয় কোথায়?

এখনও থাকিনি। ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে এসে পড়েছি।

ট্রেন। সে তো অনেক দূর।

আজ্ঞে নীলগাই কি আছে?

ভৈরবী তার ত্রিশূল আর পুঁটুলি পাথরের উপর রাখলেন। চোখ বন্ধ করে কিছু বিড়বিড় করে হাঁকলেন, অ্যাইলব, অ্যাই কুশ। সঙ্গে-সঙ্গে দুটো প্রমাণ সাইজের হনুমান ঝুপঝুপ করে কোথা থেকে পাথরের ওপর এসে পড়ল। ভৈরবী বললেন, এরা খুব রাগি। যেখানে দাঁড়িয়ে আছিস সেখানেই থাকবি। নড়বি না। আমি স্নান করে আসি। বলেই আলখাল্লা-সমেত জলে নেমে গেলেন। গুনে-গুনে আটবার ডুব দিলেন ভৈরবী। তাঁর জটপাকানো চুলে জল ঢুকল কিনা বোঝা গেল না। তারপর কোমরজলে উঠে এসে পট করে আলখাল্লাখানা খুলে ফেললেন এদিকে পেছন ফিরে। তাঁর নগ্নপিঠ কোমর হাত-মুখের চেয়ে ঢের ফরসা। জলের ওপর আছাড় মেরে আলখাল্লা কাচলেন তিনি। তারপর সোজা উঠে এলেন ওপরে। মুখে মন্ত্র। চিৎকার করে বলা শব্দগুলো যেন তাঁকে আড়াল করে রাখছিল। এক পলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল সুন্দর। জীবনে প্রথমবার সে একজন নগ্নিকাকে দেখল। কিন্তু নারীদেহের সম্পদ তাকে বিন্দুমাত্র আলোড়িত করল না।

সঙের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে যা জিগ্যেস করছি তার উত্তর দাও।

মুখ ফেরাল সুন্দর। শুকনো আলখাল্লাটা নিশ্চয়ই পুঁটলিতে ছিল। সেটি এখন অঙ্গ ঢেকেছে। ভেজাটা পুঁটলিতে নিয়ে ত্রিশূল হাতে ভৈরবী এখন দাঁড়িয়ে।

কেন এসেছিস?

নীলগাইয়ের দুধ খাব বলে এসেছি।

নীলগাইয়ের দুধ?

হ্যাঁ। জ্যোৎস্নারাতে নীলগাইয়ের দুধ খেলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ হওয়া যায়।

নীলগাইয়ের দুধ কে এনে দেবে তোকে?

আনা দুধ খেলে হবে না। বাঁটে মুখ লাগিয়ে খেতে হবে।

ভৈরবী তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন, পেটে কিছু পড়েছে?

না।

আয় আমার সঙ্গে। পেছন-পেছন আসবি। বেশি কাছাকাছি এলে লব-কুশ তোকে ছিঁড়ে ফেলবে। ভীষণ শয়তান এ দুটো।ভৈরবী হাঁটতে শুরু করলেন।

পাথর ডিঙিয়ে-ডিঙিয়ে পাহাড়ে চড়তে শুরু করল সে ভৈরবীকে অনুসরণ করে। ওদের মাঝখানে হনুমানদুটো রাশভারী মেজাজে হাঁটছে। একটা মাঝে-মাঝেই পেছন ফিরে তার দিকে তাকিয়ে দাঁত দেখাচ্ছে। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর একটা চাতাল গোছের জায়গায় উঠে এল ওরা। চাতালের একপাশে ছোট্ট বাখারির ঘর যার মাথায় টিন দিয়ে ছাদ তৈরি। ভৈরবী সেখানে গিয়ে প্রণাম করল। সুন্দর দেখল ঘরের মধ্যে কালীমূর্তি রয়েছে। ছোট্ট কিন্তু ভয়ঙ্করী। এই মায়ের পায়ের তলায় শিব নেই, হাতে খড়গ। যেন যুদ্ধে মত্ত তিনি। ভৈরবী বললেন, মাকে প্রণাম কর।

সে আদেশ মান্য করল। তারপর চারপাশে নজর ফেলতেই বেশ কয়েকটা জায়গায় পোড়া ছাই দেখতে পেল। কাঠে আগুন দিলে এমন ছাই হয়।

ভৈরবী হাসলেন, কী দেখছিস? ওগুলো চিতা। গ্রামের লোক মড়া নিয়ে এসে এখানে পোড়ায়। মায়ের সামনে। সব শালা স্বর্গে যাবে। হু! আমাকে যে ভৈরব এখানে এনেছিল, সে-ই নিয়মটা চালু করেছিল। চিতায় আগুন দেওয়ার পর সবাইকে নেমে যেতে হত এখান থেকে। সেই সময়। ভৈরব মড়ার মাথা চিতা থেকে বের করে ঘিলু খেত। তারপর পুরো ছাই হয়ে গেলে লোকজনদের ডেকে অস্থি দিয়ে দিত। ভৈরব মরে যাওয়ার পর আমি আত্মীয়স্বজনদের চিতার কাছে থাকার অনুমতি দিয়েছি। ওসব ঘিলু-ফিলু খাওয়ার কথা ভাবলেই গা গোলায় আমার। আয়।

চাতালের একপাশে পাথরের সিঁড়ি। সেটা দিয়ে ওপরে উঠতেই গুহা দেখতে পেল সুন্দর। ভৈরবী বললেন, এখানে কোনও পুরুষের ওঠা নিষেধ। ভৈরব মারা যাওয়ার পর শুধু তোকেই নিয়ে এলাম। ওখানে জল ধরা আছে। হাত-মুখ ধুয়ে নে, আমি দেখি তোকে কি দিতে পারি। ভৈরবী গুহার মধ্যে ঢুকে গেলেন।

একটা বড় ড্রামে জল রয়েছে। তাই দিয়ে মুখ হাত-পা ধুতে শরীর একটু জুড়াল সুন্দর ঘুরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। অনেকটা ওপরে বলে বিল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এমনকী বিলের ধারের গাছগাছালিও। চোখ জুড়িয়ে যায়। তারপরই খেয়াল হল, ভৈরবীর সঙ্গে এখানে চলে আসাটা কী ভালো হল? ওরা অনেক মন্ত্রট জানে। তাকে যদি বশ করে ফেলে! কামাখ্যা বলে একটা জায়গায় নাকি মানুষকে ছাগল বানিয়ে দেয় মন্ত্র পড়ে। সে হনুমানদুটোকে খুঁজল। নিচের চাতালে বসে একজন আর একজনের শরীর থেকে পোকা বাছছে। ওরা মানুষ নয়, মন্ত্র পড়ায় হনুমান হয়ে গেছে। কীরকম ছমছম করতে লাগল শরীর।

আয়। এদিকে আয়। ভৈরবীর গলা ভেসে এল।

একটা কলাইয়ের থালাভরতি ভাত আর কিছু সেদ্ধ। একপাশে নুন। ভৈরবী নিজেও তাই নিয়েছে। ভৈরবী বললেন, আমি এই খাই, খেতে হয় খা, নইলে রেখে দে।

মাছ-মাংস খাওয়া হয় না?

ও আবার কী ধরনের কথা! হয় না! হয় তুমি বলবি, নয় আপনি। আমি তোর চেয়ে বয়সে ঢের বড়। তিরিশ হয়ে গেল, এর মধ্যে তিন-তিনটে ভৈরব পার করেছি। খেতে-খেতে ভৈরবী বলছিলেন, তা অস্বীকার করব না, তিনজনের কাছে অনেককিছু শিখেছি। মাছ-মাংস! মড়ার মাংস খেতে হয়েছে আমাকে, শুধু ঘিলুটা পারিনি। তুই যদি খেতে চাস তাহলে বিল থেকে মাছ ধরে আন, জঙ্গলে খরগোশ, বনমুরগি আছে, ধরে নিয়ে এলে নুন-হলুদ দিয়ে ফুটিয়ে দেব। কিন্তু আমি নিরামিষ খাই।

আমি ধরে আনব?

তোকে তো দিন-দশেক এখানে থাকতেই হবে। তারপর চাঁদ উঠবে। হ্যাঁ, নীলগাই এখানে আছে। দলবেঁধে বের হয়। তদ্দিন তো পেটে দিতে হবে।

এতক্ষণে স্বস্তি হল। এই বিস্বাদ খাবারও ভালো লাগল। সে জিজ্ঞাসা করল, এখানে একা থাকতে তোমার ভয় লাগে না?

দূর! ভয় করব কাকে? উলটে লোকেরাই আমাকে ভয় পায়। এর পর রাত্রে খেতে হবে নাকি? আমি বাপু রাঁধতে পারব না। আমার রাতের ভাত তোকে দিয়ে দিলাম। দুটো পেয়ারা আছে, খিদে পেলে খেয়ে নিস।

খাওয়ার পর ভৈরবী ভেতরে চলে গেলেন। শরীরটা এখন শান্ত। সে বিলের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। ছায়া ঘন হয়েছে। একটু পরেই আঁধার নামবে। হঠাৎ নাকে কটু গন্ধ লাগল। বাতাসে ভেসে আসছে। গন্ধটা কীসের? সে উঠল। চারপাশে নাক টেনে বুঝল ওটা আসছে গুহার ভেতর থেকেই। গুহার মুখে দাঁড়িয়ে দেখল ভৈরবী বাবু হয়ে বসে দু-হাতে কলকে ধরে টান দিচ্ছেন। গাঁজা খাচ্ছেন ভৈরবী। তাকে দেখামাত্র হেসে ইশারা করলেন কলকে দেখিয়ে। সে দ্রুত মাথা নেড়ে না বলল।

সঙ্গে-সঙ্গে চোখ বড় হয়ে গেল আরও। গুহা থেকে বেরিয়ে এসে ভৈরবী কড়া গলায় বললেন, তিনটে টান দে। এখানে থাকতে হলে আমি যা-যা খাব তাই তোকে খেতে হবে। তারপর হালকা। হাসলেন, কোনও ক্ষতি হবে না। বরং মন হালকা হবে। শরীরে বল পাবি। খা।

কাঁপা হাতে কলকে নিল সুন্দর। ভয়ে-ভয়ে একটা টান দিতেই কাশি এল। ভৈরবী বললেন, গলার কাঁটা সরছে। দে টান, জোরে-জোরে।

তিনটে টানেই অবস্থা কাহিল। কোনওমতে কলকে ফিরিয়ে দিয়ে সে একপাশে বসে পড়ল। মাথা ঘুরছে, নাকী পৃথিবীটা! চোখ খুলে রাখতে পারছিল না সে।

তোকে নীলগাই এমনি-এমনি বাঁটে মুখ রাখতে দেবে? তার জন্যে অনেককিছু শিখতে হবে। আমার কথা শুনে চললে সেসব আমি শিখিয়ে দেব। এখন শুয়ে পড়।

এত ঘুম সে কোনওদিন ঘুমায়নি। চোখ মেলতেই কানে শব্দ আসতে লাগল। মন্ত্র পড়ার শব্দ। এখনও আকাশে পাতলা অন্ধকার। ভোর হব-হব। সে মাথা তুলে চারপাশে তাকাল। তারপর। উঠে এগোতেই নিচের চাতালে নজর গেল। মায়ের মন্দিরের সামনে কাঠের আগুন জ্বেলে বসে আছেন ভৈরবী। বসার ভঙ্গিটায় শরীর আরও টানটান দেখাচ্ছে।

ওপাশে কিছু লোক নিভে আসা চিতাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। ভৈরবী মন্ত্র পড়ে চলেছেন। শ্মশানযাত্রীদের কেউ চিতায় জল ঢাললে শব্দ হল আগুন নেবার। এবং তখনই মন্ত্রপাঠ শেষ হল।

ভৈরবী বললেন, যাঃ। ওর আত্মা আর এখানে থাকবে না। অস্থি নিয়ে তোরা বিদায় হ এবার।

আগুন নিবিয়ে অস্থি সংগ্রহ করে লোকজন নেমে গেল। রাতেও কখন কোনওসময় মড়া নিয়ে লোকজন এসেছিল, ভৈরবী নেমে গিয়েছিল, তা সে টের পায়নি। অদ্ভুত ঘুম হল তার।

সুন্দর নিচে নেমে আসতেই ভৈরবী বললেন, কী খবর? মশাইয়ের ঘুম ভাঙল। এখন এই বস্তাটা ওপরে নিয়ে যাও। চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, নুন যা আছে তাতে আমার এক-দেড় মাস সচ্ছন্দে চলে যেত। এখন তো মুখ বেড়েছে তাই মা আগেভাগে পাইয়ে দিল।

সুন্দর বস্তাটা তুলল। বেশ ভারী।

সারাটা সকাল ভৈরবী পড়ে-পড়ে ঘুমাল। এর মধ্যে সুন্দর জঙ্গলের অনেকটা ঘুরে এসেছে। বনমুরগি আর খরগোশ চোখে পড়লেও ধরার চেষ্টা করেনি। কিন্তু আচমকা তার চোখ পড়ল জঙ্গুলে কলাগাছের দিকে। বাঁদরদের নজর এড়িয়ে কী করে কলাগুলো অত পুরুষ্ট হয়ে রয়েছে, ভগবান জানে! সে টেনে হিঁচড়েও কলার কাঁদি ছিঁড়তে পারছিল না। এইসময় হুপ-হুপ শব্দ হল। সুন্দর দেখল কয়েকটা হনুমান গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে-লাফিয়ে নেমে আসছে। সে দৌড়োল। এদের সঙ্গে লড়াই করার কোনও অস্ত্র তার কাছে নেই।

কিছুদূর আসার পর খুব আপশোস হল। সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ হতে চায় অথচ কয়েকটা হনুমানকে শায়েস্তা করার ক্ষমতা নেই। নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিল সে। গুহায় ফেরার অনেকক্ষণ বাদে ভৈরবীর ঘুম ভাঙল। বাইরে বেরিয়ে এসে ওপরে হাত তুলে যখন আলস্য ভাঙছেন ভৈরবী, তখন হঠাৎ বুকের মধ্যে কী যেন নড়ে উঠল সুন্দরের। ভৈরবীর ঊর্ধ্বাঙ্গে এখন অনেক স্থির-ঢেউ।

কী রে? মন খারাপ করে আছিস কেন?

সে শুকনো গলায় বলল, আমাকে মন্ত্র শিখিয়ে দেবে?

মন্ত্র? কীসের মন্ত্র?

মানুষ, প্রাণীকে বশ করার মন্ত্র?

দূর শালা! তোর আর এখানে থাকার দরকার নেই। যা, বিদায় হ।

কেন? আমি কী অন্যায় বললাম?

তোর কোনও যোগ্যতা আছে মন্ত্র নেওয়ার? ভৈরবী চিৎকার করলেন।

তুমি যদি শিখিয়ে দাও!

ভৈরবী এবার অদ্ভুত চোখে তাকাল। চোখ সরিয়ে নিল সুন্দর। ওরকম অদ্ভুত চাহনির সামনে সে কখনও দাঁড়ায়নি। প্রায় মিনিট দুয়েক বাদে ভৈরবী বললেন, প্রমাণ দে যে তোর যোগ্যতা আছে।

কীভাবে দিতে হবে? নিজের প্রস্রাব খেতে পারবি?

সুন্দরের মনে পড়ল। কোনও এক নেতা নাকি তাই খেতেন। লোকে এই নিয়ে খুব হাসাহাসি করত। সেই লোকটা সংসারে থেকে যদি কাজটা করতে পারে তাহলে সে পারবে না কেন? সুন্দর মাথা নাড়ল, পারব।

বাঃ। আমারটাও? অন্য লোকেরটা? পারবি?

উত্তরটা জিভে আসছিল না। ভৈরবী বললেন, নিজেরটা করা ঢের সহজ। স্বার্থপর হলে কোনও অসুবিধে নেই। ঠিক আছে, আমাকে একটু ভাবতে দে।

এখন এখানে মেঘ নেই তাই বাইরে শুতে অসুবিধে নেই। বিলের জলে স্নান আর নিরামিষ। খাওয়া। ভৈরবী তার সঙ্গে প্রয়োজনের বাইরে কথা বলেন না। তিনি যে সারারাত জেগে থাকেন। মন্দিরের সামনে, তা সে দ্বিতীয় রাতেই টের পেয়েছিল। এখন রাতেরবেলায়, একরকম কিন্তু দিন কাটতেই চায় না সুন্দরের।

কিন্তু কাটল। দেখতে-দেখতে চাঁদের রাত চলে এল। প্রথমে ফিনফিনে জ্যোৎস্না। বিলের ধারে। সারারাত জেগে দাঁড়িয়েও নীলগাইয়ের দর্শন পেল না সে। কিন্তু যেদিন পূর্ণচন্দ্র সেদিন বিকেলে ভৈরবী বেশ বদল করলেন। আজ তাঁর পরনে টকটকে লাল শাড়ি। গায়ে জামা নেই। সুডৌল কাঁধে অদ্ভুত মায়া। ভৈরবী বললেন, আজ পূর্ণিমা।

সুন্দর বলল, কিন্তু নীলগাইয়ের যে দেখাই পাচ্ছি না।

ওরা ওদের মতো নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। ধৈর্য না রাখতে পারলে কিছুই পাওয়া যায় না। তোমার কপাল ভালো থাকলে আজ রাত্রেই স্বপ্ন পূর্ণ হবে।

সন্ধ্যার আগেই জ্যোৎস্নায় পৃথিবী ভেসে গেল। রুপোর টাকার মতো চাঁদ লাফিয়ে উঠল। আকাশে। ঘর-খোঁজা পাখিরা হা-হারবে উড়ে গেল ডানায় হাততালির শব্দ তুলে। সুন্দর এই মায়াময় বনানীর মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রতীক্ষায়।

গাছে-গাছে পাখিদের নীরবতা নেমে এল। জ্যোৎস্নায় পাহাড়-জঙ্গল এখন সিনেমার মতো। সুন্দর। সুন্দর মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। সন্ধে পেরিয়ে রাত ঘন হল। মশার কামড় উপেক্ষা করতে আর পারছিল না সে। হঠাৎ দুদ্দাড় শব্দ হল। বিলের ওপাশে পাহাড়ের গা বেয়ে নীলগাইয়েরা নেমে আসছে বিলের দিকে। সেখানে পৌঁছাতে হলে এই বিল সাঁতরে পার হতে হয়। বর্ধমানের পুকুরের সাঁতার কাটার অভিজ্ঞতা নিয়ে জলে নামল সে। প্রথম-প্রথম তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল। শেষপর্যন্ত হাতে-পায়ে টান ধরল। কোনওরকমে বিল পার হয়ে মুখ তুলতেই সে নীলগাইয়ের দেখতে পেল। অদ্ভুত গোটাকুড়ি বলশালী প্রাণীর সঙ্গে তিনটে শিশু ঘুরছে। জলে দাঁড়িয়েই সে শিশুদের লক্ষ করতেই তাদের মায়েদের দর্শন পেয়ে গেল। একটা বাচ্চা মাঝে মাঝেই ছুটে গিয়ে বাঁটে মুখ রাখছে। এই স্বপ্নের জ্যোৎস্নায় যেন আকাশ থেকে নেমে আসা

পরীরা তার সামনে। কোনওমতে কাছে পৌঁছে বাঁটে মুখ রাখলেই স্বর্গলাভ। জল ছেড়ে উঠল। সুন্দর। সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল নীলগাইরা। সতর্ক চোখে তারা দেখল সুন্দরকে। কয়েক মুহূর্ত। তারপর দৌড় শুরু হল। ঝড়ের গতিতে ফিরে যাচ্ছে তারা। সুন্দর দৌড়াতে লাগল। একটা বাচ্চা তাল রাখতে পারছে না। পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সেটা। দৌড়ে কাছে গিয়ে তাকে তুলতেই সুন্দর দেখতে পেল মা নীলগাই দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারপর উলটো দিকে ছুটে আসতে লাগল সেটা। এই জ্যোৎস্নায় তার ভরা বাঁট চোখে পড়ল সুন্দরের। কিন্তু একই সঙ্গে আত্মরক্ষার তাগিদে সে বাচ্চাটাকে ঠেলে দূরে সরে এল। বাচ্চাটা এবার মায়ের দুধ খাচ্ছে। মা চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কিন্তু দৃষ্টি সুন্দরের দিকে।

ওই দুধ খেতে পারলে আর কোনও চিন্তা নেই। সুন্দর পায়ে-পায়ে এগোল। সঙ্গে-সঙ্গে মা নীলগাই হাঁটা শুরু করল বাচ্চাটাকে নিয়ে। মরিয়া হয়ে ছুটে গেল সুন্দর আর তখনই প্রচণ্ড একটা লাথি তার শরীরটাকে ছিটকে দিল।

তখনও জ্যোৎস্না রয়েছে কিন্তু নীলগাইয়েরা নেই। ডানপায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। উঠে দাঁড়াতে সময় লাগল। রক্ত ঝরছে পা থেকে। ওই অবস্থায় জলে নামল সে। এই বিল পেরিয়ে তাকে ফিরতে হবে।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে গুহার অন্ধকারে। সমস্ত শরীরে চাপ। সে নড়ে উঠতেই ভৈরবী বললেন, চুপচাপ শুয়ে থাকো। তোমার শরীরের সব যন্ত্রণা আমি নিচ্ছি।

কী করে?

এমনি করে।

সে টের পেল। ভৈরবী তাকে জড়িয়ে শুয়ে আছেন। এবং ভৈরবীর শরীরে কোনও কাপড় নেই। তার ডানপায়ে যন্ত্রণা হচ্ছিল। কী করে সে বিল পার হল, এখানে এসে তার কিছুই এখন মনে পড়ছে না। সে শুধু বলল, পারলাম না। পারবে। আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব।

দেবে?

হ্যাঁ। এতক্ষণ তুমি সুপ্ত ছিলে। এখন জেগেছ। কেমন লাগছে?

ভালো। যন্ত্রণা উপেক্ষা করল সে।

আমার শরীর টের পাচ্ছ?

হুঁ। বলমাত্র ভৈরবীর শারীরিক সম্পদ তাকে বিদ্ধ করল। সমস্ত শরীরের রক্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠল।

ভৈরবী বলল, নিজেকে সংযত করো। শরীরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। চোখ বন্ধ করে মায়ের মুখ স্মরণ করো। তিনি তোমাকে শক্তি দেবেন।

অথচ সমস্ত শরীরে প্রতিবাদের ঢেউ। সুন্দর নিজেকে সংযত রাখার জন্যে মা কালীর মুখ মনে করতে চেষ্টা করল। এ কি! মায়ের জিভ বাইরে বের করা নেই। সেটা ভেতরে ঢুকে যাওয়ায় মাকে সম্পূর্ণ অচেনা লাগছে। ভিন্নতর আবেগ আরও উসকে দিচ্ছে তপ্ত রক্তধারাকে।

আগামী পূর্ণিমায় আবার নীলগাইয়েরা পাহাড় বেয়ে নেমে আসবে। পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন স্বপ্নের নীলগাই জ্যোৎস্নায় জল খেয়ে যাবে। কিন্তু সুন্দরের সামনে এখন আগুনের রথ। ভৈরবী তার চারপাশে গণ্ডি কেটে দিয়েছে। জীবনে কখনও যে নীলগাইয়ের দুধ খায়নি তার তো আগুনের রথেও চড়া হয়নি।

এই সময় ভৈরবী ফিসফিসিয়ে বলল, কাকে চাই? নীলগাই না আমাকে?

ভৈরবী ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লেন। হেসে বললেন, আজ এই পর্যন্ত। এর নাম সাধনা। আমার ভৈরবরা এই সাধনাই আমাকে শিখিয়ে গেছেন। আবার সামনের পূর্ণিমায় আমরা এই সাধনায় বসব। কেমন!

ভৈরবী নেমে গেছেন নিচে। তাঁর পুজো শুরু হয়ে গেল।

শরীরে একফোঁটা শক্তি নেই। মৃতদেহের মতো পড়েছিল সুন্দর। আশ্চর্য, আচমকা তার রক্ত একেবারে শান্ত হয়ে গেল। বদলে এক অবসাদ।

নীলগাইয়ের লাথি আর ভৈরবীর হঠাৎ উঠে যাওয়া যেন একই যন্ত্রণা ছড়িয়ে দিয়ে গেল তার শরীরে। পূর্ণিমা আসবে এক মাস পরে। তদ্দিন অপেক্ষা করে থাকতে হবে তাকে।

দুটো পথই একই লক্ষ্যে গিয়েছে।

কিন্তু ভৈরবী তাকে অগ্নিরথের সন্ধান দিতে পারে।

নীলগাইরা সেটা কখনও পারবে না।

এখন পর্যন্ত গল্পটি পড়া হয়েছে ২৬ বার
যদি গল্পটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন