শিরোনাম: পাপের ফসল

গল্পকার: Author Avatar শংকর ব্রহ্ম

অণুগল্প পাপের ফসল

পাপের ফসল
শংকর ব্রহ্ম
————————

আমি তখন আহিড়িটোলার একটা মর্নিং-স্কুলে পড়াই। একদিন একমহিলা, একটি ছেলেকে নিয়ে সকাল আটটা নাগাদ স্কুলে এলো, তাকে স্কুলে ভর্তি করাবে বলে।
গোপাল ব্যানার্জী তখন ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনিই ছেলেটিকে ভর্তি করে নিচ্ছিলেন, এডমিশন রেজিষ্টারে তার নাম লিখে।
ছেলেটির নাম লেখার পর, মহিলার কাছে জানতে চাইলেন, ওর বাবার নাম কি?
মহিলা বললেন, জানি না
– সে কি? এ আপনার ছেলে নয়?
– আমার না তো কার হবে?
– তবে, ওর বাবার নাম জানেন না? ওর বাবার নামের জায়গায় কি লিখব?
– আপনার নামটাই লিখে দিন না স্যার। আমার ছেলেটাকে স্কুলে ভর্তি করে নিন।

তারপর?
তারপর ছেলেটিকে গার্জিয়ান এর জায়গায়
ওর মায়ের নাম লিখে ছেলেটিকে স্কুলে ভর্তি করে নেওয়া হয়েছিল।
ওই স্কুলে আমি তিন বছর ছিলাম পড়িয়ে ছিলাম। ছেলেটি ব্রিলিয়েন্ট ছিল,পড়াশুনায় না। নাচে গানে। ওর কাছেই আমি প্রথম ব্রেক ডান্স দেখি। ওর মা মাঝে মাঝে আসত ছেলের পড়াশুনার খবর নিতে। আমার সাথে তার খুব ভাব হয়ে গেছিল। আমাকে ওর সোনাগাজির ঘরে নিয়ে গেছিল।
সেদিন ওর কাছে ওর জীবনের গল্প শুনেছিলাম। মহিলার আসল নাম কৃষ্ণা। এখানে সবাই চেনে পদ্মা নামে চেনে। পদ্মার কাহিনী শুনুন তবে।
ওরা থাকতো বারাসতের এক ভাড়া বাড়িতে। এক বোন এক ভাই। কৃষ্ণাই সবার বড়। কৃষ্ণা ভালবাসতো দিব্যেন্দুকে। সে ছিল গ্লাস ফিটিং মিস্ত্রি। ফ্ল্যাট বাড়িগুলির কাচের জানলা দরজা ফিটিংয়ের কাজ করত সে। মানুষ হিসাবে খুব ভাল ছিল। কোন নেশা ভাঙ করত না। সাধাসিধা সহজ সরল মানুষ ছিল।
বাড়ির অমতে দুজনে বিয়ে করে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা শহরে চলে আসে ওরা। এখানে দিব্যেন্দুর কাজকর্ম পেতে কোন অসুবিধা হয় না। শহরে প্রতিদিন কত ফ্ল্যাট উঠছে। কাজের অভাব নেই। এখানে অনেক কাজ। বেশ ভালই চলছিল তাদের সংসার।
বেলেঘাটার একটা বস্তিতে ভাড়া নিয়ে থাকত ওরা। দুটো প্রাণ আনন্দে মেতে থাকতো সবসময়। তারপর হঠাৎ একদিন সব আনন্দ সুখ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, মুহূর্তের বিপাকে। খুব ভাল কপাল নাকি ভগবানের সহ্য হয় না। মানুষের খুব ভাল থাকাটা, তবে কি তার পছন্দ নয়? কৃষ্ণা আজও তা ভাবে। না হলে কেন এমনটা ঘটবে ?
দিব্যেন্দু একদিন সকালে টিফিন খেয়ে, তার সাথে নিত্যদিনের মতো খুনসুটি সেরে, কাজ করতে বের হলো। তিলজলার একটা তিনতলা ফ্ল্যাট বাড়ির জানলার কাচ লাগাবার কাজ। কাজ করতে করতে হঠাৎ সে অসাবধানে পা ফসকে নীচে পড়ে যায়। হাসাপাতালে নিয়ে যেতে যেতে সব শেষ হয়ে যায়, বেরিয়ে যায় তার প্রাণ। কৃষ্ণার কাছে খবর আসে সন্ধ্যায়। সে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। কান্নায় ভেঙে পড়ে। প্রতিবেশীরা এসে সান্ত্বনা দেয়। “কেউ কি আর চিরদিন থাকে। ওর আয়ু ফুরিয়ে ছিল, তাই চলে গেছে। কেঁদে আর কি হবে বলো? সে কি আর ফিরে আসবে? ”
সে কথায় মন বুঝ মানে না তার। কয়েকটা দিন পাগলের মতো কাটে তার। তারপর একদিন মা বাবার কাছে ফিরে যায় সে। সেখানে তার ঠাঁই হয় না। দাদা বৌদি ঘরে ঢুকতে দেয় না তাকে। মা বাবাও তাকে ঘরে ডেকে নেয় না। বাধ্য হয়ে সে ফিরে আসে পুনরায় বেলেঘাটার বস্তিতে। কি করে চলবে তখনও বুঝতে পারে না। ঘরভাড়া দেওয়া,খাওয়া খরচ। সুলতা বস্তিরই মেয়ে, সে তাকে একটা কাজ জুটিয়ে দেয় বাবুর বাড়ি। বাবুকে সারদিন দেখভাল করার কাজ। বাবুর বউ দু’বছর আগে মারা গেছে। একমাত্র ছেলে দিল্লিতে কাজকর্ম করে। এখানে থাকে না। কয়েকমাস ভালই কাটলো তার সেখানে। তারপর বিপত্তিটা ঘটলো হঠাৎ একদিন। বাবুর ছেলে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাবাকে দেখতে এলো।
প্রথম দিনই কৃষ্ণাকে দেখে তার কামনা জাগল মনে।
এবং সে সুযোগের অপেক্ষা করেছিল। দু’দিন বাদেই সে সুযোগ তার জুটে যায়। কৃষ্ণা বাথরুমে বাবুর জামা কাপড় কেঁচে দিচ্ছিলো। হঠাৎ সেখানেই সে ঢুকে পড়ে । তারপর যা হবার তাই হয়ে যায়। কৃষ্ণা ভয়ে লজ্জায় কোন চিৎকার করতে পারেনি।
এইভাবে সে কৃষ্ণাকে ব্লাকমেল করে, তারপর থেকে রোজ ভোগ করতে থাকে। তারপর সে দিল্লি ফিরে যায়। তারপরও কৃষ্ণা সে কাজটা হাত ছাড়া করেনি এই ভেবে যে, তাহলে কি করে চলবে তার?
তারপর আবার কিছুদিনের মধ্যেই বাবুর সেই ছেলেটা আবার ফিরে আসায়, ওই কামুকটার হাত থেকে নিন্তার পাওয়ার জন্য সে কাজটা ছেড়ে দেয় সেখান থেকে। ভাবে এসব করেই যদি খেয়ে পরে বাঁচতে হয়। তবে আর সোনাগাজি কি দোষ করলো। এই বস্তিরই মালতির হাত ধরে কৃষ্ণা চলে এলো দেহ-ব্যবসার জীবিকায়। নিজেই নিয়ে এসে ওঠে এই সোনাগাজির ঘুপচি-ঘরে। বাবুর ছেলের কৃতকর্মের ফলে এখানেই জন্ম হয় তার সন্তানের। যখন জানতে পারল যে সে সন্তানসম্ভবা, তখন একবার ভেবে ছিল, এই সন্তানকে নষ্ট করে ফেলবে সে। তারপর ভাবল , এ-পৃথিবীতে তার তো আর কেউ নেই। এই সন্তানই না হয় তার জীবনের শেষ অবলম্বন হবে। এই ভেবে সে সেচ্ছ্বায় তার সন্তানের জন্ম দেয়। যেন এই সমাজকে সে মুখ-ঝামটা দিয়ে দেখাতে চায়, তাদের পাপের ফসলকে।

এখন পর্যন্ত গল্পটি পড়া হয়েছে ৮১ বার
যদি গল্পটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন