সমরেশ-মজুমদারের-গল্প-গুচ্ছ-সমরেশের-সেরা-১০১-গল্প.

শিরোনাম: রক্তমাংসের স্বামী

গল্পকার: Author Avatar সমরেশ মজুমদার

বিয়ের তিন মাস বাদে এক সকালে চা খেতে-খেতে তিয়া বলল, শ্যাম, তোমাকে কিছু কথা বলা দরকার হয়ে পড়েছে।

চায়ের সঙ্গে আনন্দবাজার পড়া ছয় পুরুষের অভ্যেস, তবু কথাগুলো কানে যাওয়ামাত্র চমকে উঠল শ্যাম। এত মোলায়েম গলায় আজকাল কোনও মেয়ে কথা বলে না। মোলায়েম গলায় স্ত্রীর কথা শুনতেন তার প্রপিতামহ। পুরাতত্ব লাইব্রেরিতে ভিডিও টেপে সে ব্যাপারটা দেখে ও শুনে। এসেছিল বিয়ের আগে। এখন যেন সেই গলা, নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

তিয়া বলল, স্বামী হিসেবে তুমি চলেবল। অ্যাটলিস্ট আমি যা বলি তা তুমি শোনো। স্ত্রী হিসেবেও আমি খারাপ নই। কাজের জন্যে তুমি আমাকে ওয়ান ভোল্টের রোবট কিনে দিতে চেয়েছিলে, আমি নিইনি।

আসলে দামি রোবট কিনতে পারিনি, বিয়ের আগেই তোমাকে বলেছিলাম। কম দামিটায় কিছু কাজ চালানো যেত, তুমি নিলে না।

টাকাটা জমিয়েছি। এরপর তো কিনতেই হবে পাঁচ ভোল্টের রোবট। এখন তো কোনও কাজ আটকে যাচ্ছে না, তুমি দারুণ কো-অপারেট করছ। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, স্বামী হিসেবে তুমি চলেবল কিন্তু আমার সন্তানের বাবা হিসেবে তোমাকে মানতে পারছি না। তিয়া চায়ের কাপ শেষ করল।

কেন? শরীর ঝিমঝিম করতে লাগল শ্যামের।

তোমার পেডিগ্রি দ্যাখো। তোমার বাবা সাধারণ লোক ছিলেন, তাঁর বাবা এমন কিছু করেননি যা তুমিও মনে রাখতে পারো। তাঁর বাবা শুনেছি অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন, তুমিই বলেছ। তাঁর। বাবা নাকি এই আনন্দবাজারেই গল্প লিখতেন। অথচ এখনকার আনন্দবাজারে তাঁর নাম। কখনই উল্লেখ করা হয় না। এই ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে তোমার সন্তান কী হতে পারে? সাধারণ একটি

মানুষ, তাই না?

মাথা নাড়ল, হুঁ।

তোমার সন্তান কীরকম হলে তুমি খুশি হও?

খুব নামকরা একজন বিজ্ঞানবিদ। দারুণ আবিষ্কার করবে।

ওই পেডিগ্রিতে কোনও চান্স নেই। আমিও একটি দারুণ সন্তানের মা হতে চাই। সারা জীবন গর্ব করতে পারব। তিয়া উঠে এসে শ্যামের শরীরের সঙ্গে নিজের মাপা শরীর ঘনিষ্ঠ করে বলল, আমি তোমাকে খুব প্রাউড ফাদার করতে চাই। তোমার মন খারাপ শুরু হয়ে গেছে তো! বারো ঘণ্টা থাকবে, তারপর আবার এ নিয়ে আমরা কথা বলব। আজ ছুটির দিন, কোথাও বের হব না। এই বারো ঘণ্টা আমি তোমাকে চোখে-চোখে রাখব। তিয়া শ্যামের মাথায় হাত বোলাল।

দেড়শো বছর আগেও পৃথিবীর মানুষের মন একবার খারাপ হলে কিছুতেই ভালো হতে চাইত না। আত্মহত্যা, যুদ্ধ, খুন–অনেক কিছু করে ফেলত সেই অসহায়। তখন মন ছিল স্যাঁতসেঁতে, শ্রাবণের রাস্তাঘাটের মতো, কাদা প্যাঁচপেচে।

কিন্তু বিজ্ঞানবিদরা যেসব অসাধ্যকে সাধ্যে এনেছেন তার মধ্যে একটি হল মানুষের মন কখনই বারো ঘণ্টার বেশি খারাপ থাকছে না। জন্মাবার সময় আর ট্রিপল অ্যান্টিজেন পোলিও ভ্যাকসিন প্রয়োজন পড়ছে না। তার বদলে অন্য কয়েকটি ওষুধ দেওয়া হয়। ওরই একটার ফল হল বারো ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারলে মন একদম চৈত্রের দুপুরের মতো তপ্ত হয়ে যায়। গরম হৃদয় যাকে বলে। বিজ্ঞানবিদরা চেষ্টা করছেন যাতে সময়টা আরও কমানো যায়। বারো ঘণ্টার মন খারাপে কিছুদিন আগে দুটো দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগব-লাগব হচ্ছিল। সময়টা কেটে যেতেই শান্তি এসেছে।

সেইদিন রাত এগারোটার সময় শ্যাম টিভি দেখছিল। এখন কলকাতায় বসে সাতানব্লুইটা চ্যানেল ধরা যায়। আইরিশ ফোক সঙ শুনছিল সে। নাইনটিনথ সেঞ্চুরির গান। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা তিয়াকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা তিয়া, তুমি কবে মা হতে চাও?

ফাইভ ভোল্টের রোবটটা কিনতে পারলেই।

সেটা তো আমরা ইনস্টলমেন্টেও কিনতে পারি।

এখন পারি। টাকাটা আমি মাসে-মাসে দিতে পারব। গত মাসেই তো দুজনের ইনক্রিমেন্ট হয়েছে। খুব ভালো বলেছ।

শ্যাম খুশি হল। তিয়া প্রশংসা করলে তার খুব ভালো লাগে।

তিয়া একটু ভেবে বলল, আমায় বয়স এখন আঠাশ। আর তিরিশ বছর আমার যৌবন থাকবে। তার মধ্যেই ওকে বিখ্যাত হতে হবে।

শ্যাম টিভির চ্যানেল পালটাল। কোপেনহেগেন। স্পষ্ট ভাসছে। ডেনিশ ভাষায় কোনও আলোচনা সভা চলছে। হঠাৎ ইংরেজিতে সাব টাইটেল ফুটল। খুব জরুরি ঘোষণা করা হচ্ছে। আজ কোপেনহেগেনে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানবিদ সম্মেলনে আমেরিকার বিজ্ঞানবিদ যোশেফ পয়টার একটি আলোড়ন তোলা আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেছেন। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানবিদরা তা মেনে নিয়েছেন।

তিয়ার নজর টিভির ওপর পড়েছিল। সে বিছানা থেকে নেমে শ্যামের পাশে এসে বসল। একজন কালো আমেরিকান এবার ক্যামেরায়। তিনিই যোশেফ পয়টার। ছিপছিপে, পঞ্চাশের মধ্যে। বয়স। যোশেফ ইংরেজিতে বললেন, আমি এই পৃথিবীর মা এবং বোনদের জন্যে একটা। চমৎকার খবর পরিবেশন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। সন্তান জন্মাবার আগে মাতৃগর্ভে দশমাস সময় কাটাতে বাধ্য হত। আর এই সময়টা হবু মায়েরা অত্যন্ত কষ্টে কাটাতেন। শেষের কয়েক মাস তাঁদের প্রায় জড়ভরত হয়ে থাকতে হত। গত দশ বছর ধরে আমি চেষ্টা করেছিলাম এই সময়টাকে কমানোর জন্যে। আমার বিশ্বাস হয়েছিল জ্বণ থেকে পূর্ণ মানুষ করতে প্রকৃতি বড্ড বেশি সময় নিচ্ছে। আমি শেষ পর্যন্ত এই সময়টাকে কমিয়ে তিনমাসে আনতে সক্ষম হয়েছি। এখন থেকে আর কোনও মাকে বাড়তি সাত মাস কষ্ট করতে হবে না। এর ফলে মায়েদের কাজের ক্ষমতা এবং অন্যান্য সৃজনশীলতা বহুগুণ বেড়ে যাবে বলে বিশ্বাস।

যোশেফকে জিজ্ঞাসা করা হল, তাঁর স্ত্রী কী করেন? তিনি বললেন, মার্থা বিজ্ঞানচর্চা করে। তার বিষয় রোবট। পরদায় এবার তিন মাসে মা হওয়া এক আমেরিকান যুবতী এবং তার সন্তানকে। দেখানো হল।

খবরটা শেষ হওয়ামাত্র উল্লাসে চিৎকার করে তিয়া লাফ দিল। তারপর শ্যামকে জড়িয়ে ধরে তিনপাকে নেচে নিল, উঃ, কি ভালো, কি ভালো।

শ্যাম গদগদ গলায় বলল, তুমি সাত মাস গেইন করছ।

গ্রান্ড। তিয়া শ্যামকে আদর করল, সাত মাসে বাচ্চাটাকে আরও অভিজ্ঞ করা যাবে। ওর জীবন সাত মাস বেড়ে গেল।

এই সময় টেলিফোন বাজতেই শ্যাম সেটা ধরে বলল, তোমার মা।

কর্ডলেস রিসিভার তুলে তিয়া জিজ্ঞাসা করল, শুনেছ?

শুনছি। কি হবে রে!

কি আর হবে। বাঁচা গেল। তোমার কষ্টটা আমাকে ভোগ করতে হবে না।

দূর। তাড়াহুড়ো করে তিন মাসে নিয়ে এল, হাত-পা না হয় ডেভলপ করাল কিন্তু ব্রেন? ওইটে তো আসল। পরে ক্যাবলা হয়ে রইল। তুই বরং একটু অপেক্ষা কর। ধর, বছরতিনেক। বাচ্চাগুলো জন্মাক, কি হয় দ্যাখ, তারপর বুঝেসুঝে সিদ্ধান্ত নিস। বুঝলি?

মা, তুমি এখনও প্রাগৈতিহাসিক রয়ে গেলে।

শ্যামু কী বলছে? মায়ের গলা পালটে গেল।

ওর মন খারাপ ছিল বারো ঘণ্টা। এখন ঠিক হয়ে গিয়েছে।

কলকাতা শহরে এখন আটটা স্পার্ম ব্যাঙ্ক আছে। ওরা পরদিন বিকেলে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে গেল। সুবিধে হল, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক কম্পুটারে অন্যান্য ব্যাঙ্কের স্টকের বিবরণ দিয়ে দেয়। সাধারণত তিন মাসের বেশি ব্যাঙ্ক ওগুলো প্রিজার্ভ করে না। কি ধরনের মানুষ, তাদের জীবন এবং কাজ। কীরকম ছিল তা পরদায় দেখানো হচ্ছে। আরও কয়েকজন মহিলা রয়েছেন সেখানে। এই শহরে সবচেয়ে বড় যিনি বিজ্ঞানবিদ তিনি দৃষ্টিশক্তি খারাপ হলে চশমা অথবা কন্ট্যাক্ট লেন্স ছাড়াই শুধু একটি প্রত্যহসেব্য ট্যাবলেটের মাধ্যমে দৈনিক দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন। এঁকে পছন্দ হল না তিয়ার। তারপরে যার ছবি ফুটে উঠল তাকে দেখেই এক মহিলা চেঁচিয়ে উঠলেন, আমি একেই চাই।

সেলসম্যান আঁতকে উঠল, কী বলছেন ম্যাডাম? এই লোকটা খুনি!

আপনারা রেখেছেন কেন?

স্রেফ মজা করার জন্যে। গতমাসে ওর প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

জানি। কিন্তু আমি ওরটাই চাই। মহিলা শক্ত গলায় বললেন।

কিন্তু ম্যাডাম আপনার সন্তান খুনি হতে পারে!

আমি তো তাই চাইছি। মহিলা হাসলেন।

তিয়া আর শ্যাম বেরিয়ে এল বিরক্ত হয়ে। পর পর তিনদিন ওরা ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ রাখল, যদি নতুন কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু এমন কোনও আশাও পাওয়া গেল না, যা তিয়াকে উজ্জীবিত করতে পারে। সে রেগেমেগে বলল, যাচ্ছেতাই শহর এই কলকাতা।

মাথা নাড়ল শ্যাম, ঠিক বলেছ। প্রতিভাবান মানুষের বড় অভাব।

সেই রাত্রে স্বপ্ন দেখল তিয়া। ঘুম ভাঙামাত্র সে সরকারি মনোবিজ্ঞান দপ্তরে টেলিফোন করল। আধঘণ্টার মধ্যে কর্মীরা এসে গেলেন। তিয়াকে ওদের বাড়িরই একটা সাদা দেওয়ালওয়ালা ঘরে নিয়ে গিয়ে অন্ধকার করে দেওয়া হল। তার আগে সম্মোহন শক্তি ইলেকট্রিক চার্জারের। মাধ্যমে তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়ে চৈতন্য স্তিমিত এবং মানসিক অবস্থা রি-উইন্ড করা শুরু হল। বিজ্ঞানীরা এইটুকুই করতে পেরেছেন। স্বপ্ন দেখার সময় কিছু করা সম্ভব হয়নি, তার চার ঘণ্টার মধ্যে সেই দেখা অংশটিকে মনের মধ্যে থেকে তুলে এনে দ্বিতীয়বার দেখার কায়দা এখন করায়ত্ত। ফলে ঘুমন্ত অবস্থার স্বপ্ন জেগে উঠেও দিব্যি দেখা যাচ্ছে। অতএব সামনের সাদা দেওয়ালে স্বপ্নের ছবি পড়ল। একটা সুন্দর মেঘের গা ঘেঁষে একদল বক উড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ তাদের কেউ ডিম পাড়ল। ডিম মাটির দিকে দ্রুত পতিত হচ্ছিল। কিন্তু মাঝপথে সেটি ফেটে গেল। এবং তার শাবক শূন্যে ডিগবাজি খেয়েই পাখা নাড়তে-নাড়তে পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করল। এই হল স্বপ্ন।

স্বপ্নটা ভিডিও রেকর্ডারে ধরে তিয়াকে সম্পূর্ণ চৈতন্যে ফিরিয়ে এনে দেখানো হল। এবার ব্যাখ্যা দেওয়া হল, তিয়া মা হতে চাইছে। সাম্প্রতিক আবিষ্কারের সুযোগ নিয়ে খুব অল্প সময়ে মা হতে চায় সে। এবং তার সন্তান অত্যন্ত দ্রুত গতিময় হোক এই বাসনা।

ব্যাখ্যা শুনে তিয়া খুব খুশি হল। একা হওয়ামাত্র সে শ্যামকে বলল, অ্যাই শোনো, তুমি যোশেফকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাও।

কোন যোশেফ? বুঝতে অসুবিধে হল শ্যামের।

আঃ, তোমার মাথা এত ডাল হয়ে যাচ্ছে। এখন আমি যোশেফ পয়টার ছাড়া আর কারও কথা ভাবতে পারি? ভদ্রলোকের গায়ের রংব্রাউন হলেও কি ছিপছিপে শরীর। আর মেধা? ভাবতেই পারা যায় না। তিয়া চোখ বুজল।

দুদিন বাদে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেল। এখন কলকাতা থেকে নিউইয়র্ক পৌঁছতে মাত্র আট ঘণ্টা সময় লাগে। উনি অবশ্য থাকেন মায়ামির কাছে। ওরা সেখানে পৌঁছে সোজা বিচে চলে এল।

কয়েকশো নারী-পুরুষ প্রায় জন্মদিনের পোশাকে সূর্যের সমস্ত উত্তাপ শরীর দিয়ে শুষে নিচ্ছে। সেদিকে এক পলক তাকিয়েই তিয়া ঠোঁট ওলটাল, বিজ্ঞান এত উন্নতি করছে অথচ মানুষের মনে প্রিমিটিভ নেচার রয়েই গেল।

প্রিমিটিভ? শ্যাম জানতে চাইল।

নয়তো কী? জন্তু-জানোয়ারের মতো শুয়ে থাকা। ড্যাবডেবিয়ে দেখোনা হাঁদারাম। পিত্তি জ্বলে যায়।

শ্যাম বালিতে চোখ রাখল। রেগে গেলে তিয়া টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির কিছু নির্বাচিত শব্দ ব্যবহার করে। এগুলো ও পেয়েছে মায়ের কাছ থেকে, তিনি তাঁর মায়ের কাছ থেকে। একটা সংস্কৃতির মতো যুগ-যুগ ধরে এইভাবে বেঁচে আছে।

যোশেফ পয়টারের নাম এখন মুখে-মুখে। ওরা জানতে পারল বিয়ের আগে নাকি যোশেফের স্ত্রী মার্থা বেশি সম্ভাবনাময় ছিলেন বিজ্ঞানবিদ হিসেবে। যোশেফকে সাহায্য করার জন্যে নাকি তিনি নিজেকে পরদার আড়ালে রেখেছেন। তিয়া শ্যামকে বলল, শুনে রাখ। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।

সমুদ্রের ধারে খানিকটা ঘেরা জায়গায় যোশেফ পয়টারের বাড়ি। মূল দরজার বেল বাজাতে লাগল শ্যাম। মিনিট তিনেকেও কারও সাড়া নেই। হঠাৎ ওপরের ঘরের জানলা খুলে এক ভদ্রমহিলা, তাঁর কালো মুখে বিরক্তি নিয়ে বললেন, কাকে চাই?

শ্যাম মিনমিন করল, মিস্টার পয়টার।

অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে? খেঁকিয়ে উঠলেন মহিলা।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কানের মাথা খেয়েছে। বন্ধ ঘর থেকে আমি শুনতে পাচ্ছি আর উনি বাগানে বসে শুনতে পাচ্ছেন না। বাঁ-দিকের দরজাটা ঠেলে ভেতরে চলে যান। দড়াম করে জানলা বন্ধ হল।

খিড়কি দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে কিছুটা হাঁটতেই দেখতে পেল একজন মধ্যবয়স্ক ছিপছিপে মানুষ খুরপি দিয়ে বালি খুঁড়ছেন। ওদের দেখতে পেয়ে উঠে এলেন তিনি। তিয়া চাপা গলায় বলল, দারুণ।

আলাপ হওয়ার পর তিয়া জিজ্ঞাসা করল, আপনার মতো এত বড় একজন মানুষ এসব ঘরোয়া কাজ করছেন?

যোশেফ হাসলেন, আর বলবেন না। তিন-তিনটে রোবটকে আমার স্ত্রীর জ্বালায় সরিয়ে দিতে হয়েছিল। এখন বাড়িতে কাজের রোবট নেই।

কেন? উনি কি রোবট পছন্দ করেন না? তিয়া অবাক।

বরং উলটো। তিনি বড্ড বেশি পছন্দ করেন। তবে তাদের কাজ করতে দেননি। তিনি তাদের বুকে হৃদয় ঢোকাবার চেষ্টা করছেন।

বাঃ। উৎফুল্ল হল শ্যাম।

আপনি বাঃবললেন? বিরক্ত হলেন যোশেফ, রোবটেরা যদি মন পায় তাহলে কি আর আমাদের কথা শুনবে? নিজেদের নির্যাতিত ভাববে। আর তারপরেই ইউনিয়ন, বিংশ শতাব্দীর ব্যাপার আমদানি করবে। আমি তাই এ-বাড়িতে রোবট ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছি। যন্ত্র যন্ত্র আর মানুষ মানুষই।

তিয়া জিজ্ঞাসা করল, আপনার ছেলেমেয়ে?

নাঃ, নেই। আমার শারীরিক কিছু বিচ্যুতি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যোশেফ যেন এক মুহূর্তের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।

কিন্তু আপনার স্ত্রী তো মা হতে পারেন। শ্যামকে খুব উজ্জীবিত দেখাল।

মাথা নাড়লেন যোশেফ, পাচ্ছি না। খুব দুঃখের ব্যাপার কিন্তু ঘটনাটা তাই। আমরা দুজনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের সন্তান খুব সহজ সরল সাধারণ হবে। সে তার নিজের মতো বড় হবে। আমাদের জটিলতা রক্তে নিয়ে সে পৃথিবীতে আসবে না। ব্যাঙ্কে গেলে আপনি জটিল মানুষের স্পার্ম পাবেন। তাঁরা আর যাই হোন সরল হবেন না। গত বছর আফ্রিকায় গিয়েও আমরা সহজ মানুষ খুঁজে পাইনি। একটাও মানুষ পেলাম না যে জটিলতার বাইরে আছে। খুব স্যাড ব্যাপার।

আপনি সহজ সরল খুঁজছেন কেন? কাঁপা গলায় জানতে চাইল তিয়া।

দেখুন, এখন মাতৃগর্ভে থাকার সময় তিন মাস। ফলে জন্মানোর পরেই ওরা বেশি সময় পাবে নিজেকে গড়ার। সহজ সরল মানুষ তার স্বাভাবিক প্রকৃতিতে পথ খুঁজে নেবে। আমার বা কোনও ডাক্তারের সন্তান একটি বিশেষ খাতে চলবে। যাক, আমার কাছে আপনাদের আসার কারণ জানতে পারি?

এবার শ্যাম বলল, ওঁর সাধ ছিল খুব বড় বিজ্ঞানবিদ-এর সাহায্যে মা হতে।

এই সময় ভেতর থেকে চিৎকার ভেসে এল। নারীকণ্ঠের।

আতঙ্কিত যোশেফ দৌড়লেন। পেছন-পেছন ওরা। দেখা গেল মিসেস পয়টার লাফাতে-লাফাতে একটি বন্ধ ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসছেন। স্বামীকে দেখামাত্র তিনি চেঁচিয়ে উঠে দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন, আমি পেরেছি, পেরেছি। কী পেরেছ?

রোবট।

মানে? তুমি রোবট নিয়ে এসেছ? খেপে গেলেন যোশেফ।

হ্যাঁ! তুমি যখন বাইরে গিয়েছিলে।

তুমি, তুমি আমার অনুরোধ রাখলে না মার্থা?

তুমি যে পরীক্ষায় আপত্তি করেছ তা কি আমি করতে পারি?

ও। যোশেফ হাসতে চেষ্টা করেন, থ্যাঙ্ক ইউ! কিন্তু–।

আমি ওকে পুরুষ করেছি। ও একটা মানুষের মতো, সেই প্রিমিটিভ মানুষের মতো, সরল বাচ্চার বাবা হতে পারবে। মিসেস পয়টার বলামাত্র যোশেফ তাঁকে জড়িয়ে ধরে আদর করে ছুটলেন। টেলিফোনে খবর দিতে। মানুষের সৃষ্ট রোবট সরল মানুষের জন্ম দিতে পারবে। বিরাট আবিষ্কার।

তিয়া শ্যামের হাত ধরে টানল, অ্যাই, চলো।

যাবে?মানে–। শ্যাম অবাক।

ডাকছি, চলো। গম্ভীর মুখে বলল তিয়া।

কিন্তু রোবটটাকে দেখবে না?

রক্তমাংসের থাকতে আমি যন্ত্রের দিকে হাত বাড়াব কেন? এসো। তিয়ার পেছন-পেছন হাঁটতে লাগল শ্যাম।

এখন পর্যন্ত গল্পটি পড়া হয়েছে ১৬ বার
যদি গল্পটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন