বিসর্জন

জসীম উদ্দীন জসীম উদ্দীন

কি করে আদিল সময় কাটাবে? নানা সন্দেহ ভার,
দহন বিষের তীর বিঁধাইয়া হানিতেছে প্রাণে তার।
সে যেন দেখিছে আকাশ বাতাস সবাই যুক্তি করি,
সকিনারে তার পঙ্কিল পথে নিয়ে যায় হাত ধরি।
যারে দেখে তারে সন্দেহ হয়, পাড়া প্রতিবেশী জন,
সকিনার সাথে কথা কহিলেই শিহরায় তার মন।
ঘরের বাহির হইতে সে নারে; পলকে আড়াল হলে,
এই পাপিয়সী আবার ডুবিবে পঙ্কিল হলাহলে।
হাতে লয়ে ছোরা চোরের মতন বাড়ির চারিটি ধারে,
ঘুরে সে বেড়ায় যদি বা কাহারে ধরিতে কখন পারে।
আহার-নিদ্রা ছাড়িল আদিল, ঘুম নাই তার রাতে,
কোথাও একটু শব্দ হইলে ছোটে বাতাসের সাথে।

সকিনার সেই সোনা দেহখানি সরষে ক্ষেতের মত,
রঙে রঙে লয়ে তাহার পরাণে কাহিনী আনিত কত।
সেই দেহে আজ কোন মোহ নাই, বাসর রাতের শেষে
নিঃশেষিত যে পানের পাত্র পড়ে আছে দীন বেশে।
যে কন্ঠস্বরে বীনাবেনু রব জাগাত তাহার প্রাণে,
মাধুরী লুপ্ত সে স্বর এখন তীব্র আঘাত হানে।
মোহহীন আর মধুরতাহীন দেহের কাঠাম ভরে,
বিগত দিনের কঠোর কাহিনী বাজিয়ে তীব্র স্বরে।
কোন মোহে তবে ইহারে লইয়া কাটিবে তাহার দিন,
চিরতরে তবে মুছে যাক এই কুলটার সব চিন।

গহন রাত্রে ঘুমায় সকিনা শিয়রের কাছে তার,
হাঁটু গাড়া দিয়া বসিল আদিল হাত দুটি করি বার;
খোদার নিকটে পঞ্চ রেকাত নামাজ আদায় করি,
সাত বার সে যে মনে মনে নিল দরুদ সালাম পড়ি।
রুমালে জড়ায়ে কি ওষুধ যেন ধরিল নাকের পরে,
বহুখন ভরি নিশ্বাস তার দেখিল পরখ করে।
তারপর সে যে অতীব নীরবে হাত দুটি সকিনার,
বাঁধিল দড়িতে চরণ দুইটি পরেতে বাঁধিল তার।
সন্তর্পণে দেহখানি তার তুলিয়া কাঁধের পরে,
চলিল আদিল নীরব নিঝুম গাঁর পথখানি ধরে।

সুদূরে কোথায় ভুতুমের ডাকে কাঁপিয়া উঠিছে রাত,
ঘন পাট ক্ষেতে কোঁড়া আর কুঁড়ী করিছে আর্তনাদ।
নিজেরি পায়ের শব্দ শুনিয়া প্রাণ তার শিহরায়,
নিজ ছায়া যেন ছুল ধরে কার সাথে সাথে তার ধায়।
বাঘার ভিটার ডনপাশ দিয়ে, ঘন আমবন শেষে,
আঁকাবাঁকা পথ ঘুরিয়া ঘুরিয়া নদীর ঘাটেতে মেশে।
সেইখানে বাঁধা ডিঙ্গি তরনী, তার পাটাতন পরে,
সকিনারে আনি শোয়াইয়া দিল অতি সযতনে ধরে।

সামনে অথই পদ্মার নদী প্রসারিয়া জলধার,
মৃদু ঢেউ সনে ফিসফিস কথা কহিতেছে পারাপার।
সকল ধরনী স্তব্ধ নিঝুম জোছনা কাফন পরি,
কোন সে করুণ মরণের বেশে সাজিয়াছে বিভাবরী।
ধীরে নাও খুলি ভাসিল আদিল অথই নদীর পরে,
পশ্চাতে ঢেউ বৈঠার ঘায়ে কাঁদে হায় হায় করে।
রহিয়া রহিয়া চরের বিহগ চিৎকারি ওঠে ডেকে,
চারি দিগন্ত কেঁপে কেঁপে ওঠে তাহার ধাক্কা লেগে।

সুদূরের চরে ভিড়াল তরনী, ঘন কাশবনে পশি,
নল খাগড়ায় আঘাত পাইয়া উঠিতেছে জল স্বসি।
মাছগুলি দ্রুত ছুটিয়া পালায় গভীর জলের ছায়।
আবার আদিল পঞ্চ রেকাত নফল নামাজ পড়ি,
খোদার নিকট করে মোনাজাত দুই হাত জোড় করি।
উতল বাতাস কাশবনে পশি আছাড়ি পিছাড়ি কাঁদে,
রাতেরে করিছে খন্ডিত কোন বিরহী পাখির নাদে।
ডিঙ্গার তলে পদ্মার পানি দাপায়ে দাপায়ে ধায়,
সুদূরের চরে রাতের উক্লা আগুন জ্বালায়ে যায়।

না-না তবু এরে মরিতে হইবে! বাঁধিয়া কলসীখানি,
সকিনার গলে, আদিল তাহারে পার্শ্বে আনিল টানি!
শব্দ করিয়া হঠাৎ নায়ের বৈঠা পড়িল জলে,
জাগিয়া সকিনা চারিদিকে চায় কোথা সে এসেছে চলে!
স্বামীরে শুধায়, এ আমি কোথায়, এমন করিয়া চেয়ে
কেন আছ তুমি? কন্ঠের স্বরে স্তব্ধতা ওঠে গেয়ে।
না! না! এযে মায়া, কভু আদিলেরে ভুলাতে পাবে না আর,
কেহ নাই কোথা টলাতে পারে প্রতিজ্ঞা হতে তার্
কর্কশ স্বরে কহে সকিারে, অকে চিন্তা করে,
স্থির জানিয়াছি, নাহি অধিকার তোমার বাঁচার তরে।

সকিনা কহিল, সোনার পতিরে! এত যদি তব দয়আ,
তবে কেন এই অভাগীরে লবে পাতিলে সুখের ময়া।
সোঁতের শেহলা ভেসে ফিরিতাম আপন সোঁতের মুখে,
কেন তারে তবে কুড়ায়ে আনিয়া আশ্রয় দিলে বুকে!
আমি ত তোমারে কত বলেছিনু, এ বুকে আগুন ভরা,
যে আসে নিকটে তারে দেহ শুধু ইহারি দারুণ পোড়া।
আশ্রয় নিতে গেলাম যে আমি বট বৃক্ষের ছায়ে,
পাতা যে তাহার ঝরিয়া পড়িল মোর নিম্বাস ঘায়ে।
এ কথা ত পতি, কত বলেছিনু তবে কেন হায় হায়,
এ অভাগিনীরে জড়াইলে তব বুক-ভরা মমতায়!
আমারে লইয়া বক্ষের মাঝে লিখেছিলে যত কথা,
সে কথায় যে গো ফুল ফুটায়েছি রচিয়া সুঠাম লতা;
সে লতারে আমি কি করিব আজ! গৃহহীন অভাগীরে,
কেন ঘর দিলে স্নেহছায়া ভরা তোমার বুকের নীড়ে?
আদিল কহিল, ভুল করেছিনু, ভেবেছিনু এই বুকে
এত মায়া আছে তা দিয়ে স্বর্গ গড়িব সোনার সুখে।
আজি হেরিলাম, আমার স্বর্গে হাবিয়া দোজখ জ্বলে,
তোমার বিগত জীবন বাহিনী তার বহ্নির দোলে।
ভাবিয়াছিলাম, এ বাহুতে আছে এত প্রসারিত মায়া,
ঢাকিয়া রাখিব তব জীবনের যত কলঙ্ক-ছায়া।
আজি হেরিলাম, সে পাপ-বহ্নি বাহুর ছায়ারে ছিঁড়ে,
দিকে দিগনে- দাহন ছড়ায় সপ্ত আকাশ ঘিরে।
এই বোধ হতে নিস্তার পেতে সাধ্য নাহিক আর,
আমার আকাশ বাতাসে আজিকে জ্বলিতেছে হাহাকার।
সেই হাহাকারে, তোমার জীবন ইন্ধন দিয়ে আজ,
মিটাইব সাধ, দেখি যদি কমে সে কালি-দহের ঝাঁজ।

সকিনা কহিল, পতি গো! তুমি যে আমারে মারিবে হায়,
হাসিমুখে আমি সে মরণ নিব জড়ায়ে আঁচল ছায়।
আমি যে অভাগী এ বুকে ধরেছি তোমার বংশধর,
তার কিবা হবে, একবার তুমি কও মোরে সে খবর?

থাপড়িয়া বুক আদিল কহিল, ওরে পাপীয়সী নারী,
আর কি আঘাত আছে তোর তূণে দিবি মো পানে ছাড়ি!
আর কি সাপের আছে দংশন, আছে কি অগ্নি জ্বালা,
আর কি তীক্ষ্ম কন্টক দিয়ে গড়েছিস তুই মালা!
মোর সন্তান আছে তোর বুকে হায়, হায়, ওরে হায়,
বড় হলে তারে জানিতে হইবে, কুলটা তাহার মায়।
তোর জীবনের যত ইতিহাস দহন সাপের মত,
জড়ায়ে জড়ায়ে সেই সন্তানে করিবে নিতুই ক্ষত।
পথ দিয়ে যেত কহিবে সকলে আঙুলে দেখায়ে তায়,
চেয়ে দেখ তোরা, নষ্টা মায়ের সন্তান ওই যায়!
আপন সে ছেলে শত ধিক্কার দিবে নাকি তার বাপে,
গলবন্ধনে মরিবে না হায়, সে অপমানের তাপে?
তার চেয়ে ভাল, ওরে কলঙ্কী! ভেসে-র সেই ফুল,
তোর সনে যেয়ে লভুক আজিকে চির জনমের ভুল।
ক্ষণেক থামিয়া রহিল আগিল, সারাটি অঙ্গে তার,
কোন অদম্য হিংসা পশু যে নড়িতেছে অনিবার।
জাহান্নামের লেলিহা বহ্নি অঙ্গভূষণ করে,
উন্মাদিনী কে টানিছে তাহারে, অধরে রুধির ঝরে।
না! না! না! সে ফুল চির নিষ্পাপ, হাঁকিয়া সে পুন কয়,
ওরে কলঙ্কী!তোর সনে তার এক ঠাই কভু নয়।
নল খাগড়ার ওই পথ দিয়ে খানিক এগিয়ে গেলে,
ঘন পাট ক্ষেত, ওই ধারে গেলে চরের গেরাম মেলে!
সেই পথ দিয়ে যতদূর খুশী হাটিয়া যাইবি পায়,
মোর পরিচিত কেউ যেন কভু তোরে না খুঁজিয়া পায়।

নীরবে সকিনা আদিলের পায়ে একটি সালাম রাখি,
নল খাগড়ার ঘন জঙ্গলে নিজেরে ফেলিল ঢাকি।
আদিলের তরী কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মানদীর গায়,
সবল হাতের বৈঠার ঘায়ে কাঁদে ঢেউ হায় হায়।
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ১৮৪ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন