মোঃ জুনাইদ তালুকদার

গল্প - পুনর্মিলন

লেখক: মোঃ জুনাইদ তালুকদার
প্রকাশ - শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫ ধরণ: বিরহ, ভালোবাসা

ঢাকার কমলাপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম কুয়াশায় ঢাকা। একটা ট্রেন ধোঁয়া ছেড়ে বেরিয়ে গেল, কোলাহল কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলো, কিন্তু প্ল্যাটফর্মের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা নড়ল না।
ইমতিয়াজ হোসেন।
পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বয়স, লম্বা পাঞ্জাবির ওপরে চাদর জড়ানো, মাথায় সাদা টুপি। শীতের কুয়াশার মধ্যে তার চোখ দুটো অস্থির, যেন কাউকে খুঁজছে।
তার হাতে একটা চিঠি।
চিঠিটা এসেছে এক সপ্তাহ আগে, হলুদ হয়ে যাওয়া খামে।
“ইমতিয়াজ,
পঁচিশ বছর আগে, ঠিক এই দিনে, এই প্ল্যাটফর্মে তুমি বলেছিলে, ‘আমি ফিরে আসব।’
কিন্তু তুমি আসোনি।
আমি অপেক্ষা করেছি, বহুদিন। তারপর জীবন বয়ে গেছে।
কিন্তু আজও মাঝে মাঝে মনে হয়, কোনো একদিন হয়তো তুমি ফিরে আসবে।
আমি থাকব, আসরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত।
—মারিয়াম”

ইমতিয়াজের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল আবার।
পঁচিশ বছর! কত কিছু বদলে গেছে এই সময়ে। জীবন বদলে গেছে, মানুষ বদলে গেছে, ঢাকা শহর বদলে গেছে— কিন্তু কিছু অনুভূতি কি সত্যিই বদলায়?
ইমতিয়াজ বসে পড়লেন স্টেশনের কাঠের বেঞ্চে। চারপাশের ব্যস্ততা তার চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে গেল।
পঁচিশ বছর আগে, এই স্টেশনেই দাঁড়িয়ে ছিল তারা— তিনি আর মারিয়াম।
তখন ইমতিয়াজ একেবারেই ভিন্ন মানুষ ছিলেন। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করা তরুণ, স্বপ্ন ছিল অনেক, কিন্তু বাস্তবতা ছিল কঠিন। মারিয়ামের পরিবার তার বিরুদ্ধে ছিল, তারা চায়নি মেয়েটা এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সঙ্গে জীবন জড়াক।
“তুমি কি আমার সাথে থাকবে?”
মারিয়ামের প্রশ্ন ছিল সহজ, কিন্তু উত্তর দেওয়া কঠিন।
ইমতিয়াজ চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ। চারপাশের কোলাহল তখন তার কানে আর পৌঁছায়নি।
সে জানত, তার পক্ষে তখনকার পরিস্থিতিতে মারিয়ামের হাত ধরে নতুন একটা জীবন শুরু করা সম্ভব নয়। সে নিজেই তখন দিশেহারা।
“আমি ফিরে আসব,” অবশেষে শুধু এটুকুই বলেছিল সে।
তারপর সে চলে গিয়েছিল।
কিন্তু আর ফিরে আসে নি।
আজকের এই দিনে এসে তার মনে হচ্ছে, সময়ের কাছে সে হেরে গেছে।
সে যদি ফিরে আসত, তাহলে কি সবকিছু অন্যরকম হতে পারত?
সে যদি সাহস করত, তাহলে কি মারিয়ামের জীবনটা অন্যরকম হতো?
কিন্তু এখন এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না।
তার চারপাশে স্টেশনের কর্মব্যস্ততা। কিছু মানুষ দ্রুত ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করছে, কেউবা বিদায় জানাচ্ছে কাছের কাউকে।
কিন্তু তার মনে হচ্ছে, এই ভিড়ের মাঝেই কোথাও হারিয়ে গেছে তার নিজের একটা অধ্যায়।
কিছুক্ষণ পর সে তাকাল প্ল্যাটফর্মের এক কোণে।
একজন নারী দাঁড়িয়ে আছেন।
লম্বা কালো বোরকা, মাথায় ধবধবে সাদা ওড়না। মুখের বেশিরভাগটাই ঢাকা, কিন্তু চোখ দুটো গভীর, সেসব চোখের ভাষা একদিন সে বুঝতে পারত খুব ভালো করে।
মারিয়াম?
ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন।
মহিলাটি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
তারপর ধীরে ধীরে, কোনো কথা না বলে, পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলেন।
ইমতিয়াজ চাইলো কিছু বলতে।
কিন্তু কী বলবে?
“আমি দুঃখিত”?
“আমি ফিরে আসতে পারিনি”?
“তোমার জন্য কষ্ট হয়েছে”?
সবকিছুই কি খুব দেরিতে বলা হবে না?
তার পা একবার এগিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে এল স্টেশনের মসজিদ থেকে।
মারিয়াম এক মুহূর্ত থেমে গেলেন।
তারপর ধীরে ধীরে স্টেশনের ভিড়ে মিশে গেলেন, যেন কখনো ছিলেনই না।
ইমতিয়াজ বোঝেন, এই অপেক্ষার কোনো শেষ নেই।
জীবনের সব গল্পের শেষ হয় না।
কিছু গল্প শুধু অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।

৫২
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন