ছোটবেলায় আমি অনেক চেষ্টা করতাম, একটা ফড়িংএর ছবি আঁকাবো বলে। ডানাটায় রঙ নেই অথচ দেহেটা রঙিন, বড়ো বড়ো চোখ। আমার মনে হতো , আপুর মতো দামি রং পেন্সিল থাকলে হয়তো ঠিক এঁকে দিতে পারতাম ফড়িং এর ছবিটা। আজ সকালে ছাদ বাগানে, একটা ফুল গাছের উপর, একটা ফড়িং বসেছিল অনেকক্ষণ। মনটা খুশিতে রঙিন হয়ে গেলো। মোবাইল দিয়ে ছবি তুলে নিলাম। হুবাহুব ছবি উঠেছে। যেটা আমার রং পেন্সিল কোনদিনও যা করতে পারে নি সেটা এই যন্ত্রটা করে দিলো। তবে এখন বুঝতে পারেছি রং পেন্সিল থাকলেই , জীবনের সব কিছু রঙিন করা যায় না। যেমনটা আমরা চাই তেমনটা হয় না।
যেমন আমার জীবনের রং হারিয়ে গেলো হঠাৎই, ঠিক টুনিদির মতো। কারণ যাইহোক রং হারিয়েতো গেছে এ জীবন থেকে। বাড়িতে ফি বছর রং করলেই রং ধরে রাখে। কিন্তু ঘরের ভিতরে, যে রঙীন স্বপ্নগুলো আঁকেছিলাম, মনের রং পেন্সিল দিয়ে , সে গুলো তো মুছে গেছে হঠাৎই। তবে আমি ভাবি টুনিদির কথা। জামাই বাবু মারা পর, ওর জীবনের সব রং হারিয়ে গেলো। ও রঙ পেন্সিলটার মতোই ওদের সংসারে দায়িত্ব পালন করতে করতে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ও আসতে আসতে। ও হারিয়ে ফেলেছে জীবনের সব রঙ। যদিও সুজয়দাতো চেয়েছিলেন ওর জীবনটাতে আবার রং ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু সব চাওয়া তো পরিনতি পায় না।
সকালের রৌদ্রটা পুকুর জলের ওপর খেলা করছে। রাতের অন্ধকারের পরে রৌদ্রের আলো , যেন সেই রূপকথার গল্পের জাদুকর মতো হঠাৎ করে সব কিছুতে রঙ পেন্সিল দিয়ে রং ভরে জীবন্ত করে দিল। বেশ ভালো লাগলো সকালটা আমার।আমার ভালোলাগে বাংলাদেশের বাংলা নাটক দেখতে, তাই- হঠাৎ ই একটা গান মনে পড়ছে আজ খুব।
” জানি রাখতে পারবোনা,
জানি থাকতে পারবো না,
তোর খুব কাছাকাছি।
তুই ও জানিস, তুই ও বুঝিস
আমার এই ভালোবাসা নয় কানামাছি।
রং পেনসিল তোকে কাটতে পারিনা,
কোনো শার্পনার এ।
রং পেন্সিল তোকে রাঙাতে পারিনা,
মন ক্যানভাসে, যদি তুই ক্ষয়ে যাস।
আকাশটাও বলে আবোল-তাবোল
ঠিক যেন টোরি মতো।
তবুও আমি হারায় নিজেকে
থাকুক অনিশ্চয়তা যতো।
তুই ও জানিস, তুই ও বুঝিস
আমার এই ভালোবাসা নয় কানামাছি।
রং পেনসিল তোকে কাটতে পারিনা,
কোনো শার্পনার এ।
রং পেন্সিল তোকে রাঙাতে পারিনা,
মন ক্যানভাসে,
যদি তুই ক্ষয়ে যাস।
রোদ গুলো ঠিক বোঝে আমাকে
তুই রোদ হলে খোতি কি বল?
ভালোলাগা গুলো নিয়ে সব
মনের ক্যানভাস রাঙাই চল।
তুই ও জানিস, তুই ও বুঝিস
আমার এই ভালোবাসা নয় কানামাছি।
রং পেনসিল তোকে কাটতে পারিনা,
কোনো শার্পনার এ।
রং পেন্সিল তোকে রাঙাতে পারিনা,
মন ক্যানভাসে,
যদি তুই ক্ষয়ে যাস।”
যতোই সাবধান হও সম্পর্কটাও কখনো কখনো ভেঙে যায় পেন্সিল এর মতো। আবার সত্যি তো মোম রং খুব তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে যায়।আমি যখন আঁকা স্কুলে যেতাম । আমি পেন্সিল স্কেচ করেই সাদা কালো ছবি বানাতে ভালো বাসতাম। রঙ পেন্সিল বাক্সটা তাই বেঁচে ছিলো। কারণ আমি তো অন্য এর ফেলে দেওয়া , ক্ষয়ে যাওয়া টুকরো রঙ গুলো যত্ন করে রাখতাম।ছেলেবেলাটা সবার রঙিনই হয় , কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলাম বলেই হয়তো। তাই রঙের মূল্য আমার কাছে অনেক।
নীলাঞ্জনা এসে রঙিন করলো জীবনটা কিছুটা । ঘর গুছাতে গিয়ে আমার রঙ পেন্সিল এর বাক্সটা ও পেয়েছিল ।নীলাঞ্জনা খুব একটা ভালো ছবি আঁকাতো না , তবুও ওর একটা আঁকা , রামধনুর ছবি দিয়ে ঘরটা সাজিয়ে ছিলো। আসলে রামধনু মতো , একটা রঙিন জীবন চাইতো ও। আমি ছোট বেলা যখন প্রথম আঁকা শিখতাম তখন খুব বকাঝকা খেয়েছি। প্রথমে ছবি এঁকে , পরে রঙ পেন্সিল দিয়ে রং ভরতে হতো আমাদের। আমি পারতাম না। এখন পারি হয়তো। কিন্তু বাস্তব জীবনের ক্ষেত্রে পারি না এখনো। তাই রামধনুর ছবিটা থাকলেও ঘরে ভীতরে। নীলাঞ্জনা চলে গেছে অন্যকারো জীবন রঙিন করতে।
আসলে ওকে দোষ দিই না আমি।একটা মেয়ে একটা ছেলের ঘরে খাবার আর টাকার জন্য বউ হয়ে আসে না, আসে নির্ভরযোগ্য একটা বুকে নিজের বাকি জীবনের ঠাঁই খুঁজে নিতে।আর যেই মানুষেরা এটা বুঝে উঠতে পারেনা, তারা মানুষের পর্যায়েও পড়েনা। হয়তো আমি সেই অমানুষ এর দলেই পরি।
আচ্ছা আমি সত্যি কি পেন্সিল ব্যবহার করতে পেরেছি আমাদের সম্পর্কে মধ্যে । পেন্সিল দিয়ে যদি কয়েক – একটা সুন্দর ছবি এঁকে দিতে পারতাম ওর মনের ক্যানভাসে , তাহলে সেই স্মৃতি “ও” ভুলতে পারতো না। ভালোই হয়ছে হয়তো তাহলে ও কষ্ট পেতো আমার মতো। জানেন বেশিরভাগ পেন্সিলের রঞ্জক বস্তু বা মূল অংশটি গ্রাফাইট এবং কাদামাটির সংমিশ্রণে তৈরি করা,
যা কাগজে ধূসর বা কালো রঙের দাগ কেটে যায়। গ্রাফাইটের পেন্সিলগুলোর দাগ দীর্ঘস্থায়ী। এগুলো আর্দ্রতার প্রভাবে, রাসায়নিক প্রভাবে, অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে বা সময়ের সাথে নষ্ট হয় না।রঙ পেন্সিলগুলোতে মূল অংশে মোমের মিশ্রণ থাকে, যা দ্বারা কাগজে দাগ কাটলে তা মুছে ফেলা যায় না। এগুলো ছবি আঁকার কাজে কাজে ব্যবহার করি আমারা। গ্রেজ পেন্সিল আছে যেগুলোর মূল অংশটি অনেকটা চকের মতো নরম এবং মোমের তৈরী। এগুলো সিরামিক বা কাঁচের বস্তুর উপরে দাগ কাটতে ব্যবহৃত হয়। যদিও প্রথমে পেন্সিল
গ্রাফাইট ব্যবহারের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল, যার জন্য প্রথমে কাঠকয়লা ও ধাতব বিন্দু ব্যবহার করা হতো। ১৫৬০ সালের দিকে ইতালিতে প্রথম আধুনিক পেন্সিলের ধারণা আসে।
জীবন জীবনের নিয়মে ছবি এঁকে আমাদের।যাইহোক হতে পারে জীবনের এই অংশটুকুর পাতা গুলোই হয়তো ছিঁড়ে ফেলেছে ও। কারণ হয়তো রঙ পেন্সিল দিয়ে নয় গ্রাফাইটের পেন্সিল দিয়ে আমি আঁকেছি কালো কালো সব ছবি। সেই গুলো হয়তো দুঃখ দিয়েছে অনেক ওকে।
জানেন ছোটবেলায় কলম ব্যবহারের লোভ ছিলো আমার। অথচ আজ খুব ইচ্ছে হয় , পেন্সিল ব্যবহার করতে।চাইলে দাগগুলো রাবার দিয়ে মুছেও ফেলা যায়। জীবনটা পেন্সিলে আঁকা ছবি হলে , জীবনের ভুল গুলো মুছে দিতে পারতাম। পেন্সিল দিয়ে লেখা হলে, মুছে দিতাম নীলাঞ্জনার অপছন্দের রঙ , আমাদের জীবনের নিতো কথাগুলো।
ও একটা কথা বলি।ইংরেজি ‘পেন্সিল’ শব্দটি প্রাচীন ফারসি ভাষার ‘পিন্সেল’ অথবা ল্যাটিন শব্দ ‘পেনিসিলাস’ থেকে এসেছে।যার আক্ষরিক অর্থ ‘ছোট লেজ’। সেই যুগের পেন্সিল বা চক বা এ জাতীয় কোনো লেখার বা ছবি আঁকার বস্তু ছিল না। তো সেই সময়ে অনেকেই ব্রাশ হিসেবে উটের চুল বা লেজের অংশ ব্যবহার করতন। তাই এই নামকরণ। তবে প্রাচীন রোমানে ‘স্টাইলাস’ নামক একটা বস্তু ছিলো। সে সময়কার লেখার কাগজ হিসেবে প্যাপিরাস নামক গাছের শুকানো বাকল ব্যবহৃত হতো। এই প্যাপিরাস কাগজে লেডের তৈরি স্টাইলাস দিয়ে দাগ দিলে তা পড়া যেত।এই স্টাইলাসের গঠন থেকেই আজকের পেন্সিলের রূপলাভ।তবে সেটা ১৫৬৪ সালের পর । ইংল্যান্ডের বোরোডেল অঞ্চলে গ্রাফাইটের খনি আবিষ্কার এরপর দেখা যায় , লেডের চেয়েও গাঢ় এবং স্থায়ী দাগ কাটতে পারে গ্রাফাইট।তখন থেকেই লেখালেখির জন্য গ্রাফাইট ব্যবহার করা শুরু হয়। তখন কিন্তু কোনো কাঠের বা অন্য পদার্থের তৈরি কেসে গ্রাফাইট দন্ড রাখা হতো না, বরং সরাসরি হাতে ধরে বা সুতা পেঁচিয়ে ব্যবহৃত হতো। তবে কি হবে পেন্সিল ইতিহাস জেনে? নিজের জীবনটাই যখন ঘেঁটে ঘ হয়ে আছে। তখন কোন রং পেন্সিল তাতে, রং ভরাতে পারবে না আর। তাছাড়া রং পেন্সিল টাও ভেঙে গেছে হয়তো।
© Manab Mondal
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন