আমি তো রাইফেলের গুলি নই যে সটান্ ছুটে যাবো—
ঢোঁড়া সাপ, আমাকে এঁকে বেঁকে চলতে হয় |
যতই এ-গলি ও-গলি করি না কেন
আমার লক্ষ্য কিন্তু বাদশাহী সড়ক,
অবশ্য আমরা যখন পৌঁছব তখন সেটা আর বাদশাহী থাকবেন,
বাদশাহরা তার আগেই ইতিহাসের পচা ডোবায় পেটফোলা
কোলাব্যঙের মতো
চিৎপটাং হয়ে পড়ে থাকবে
ফলে, পদ্ধতিটা বুঝে নেবার জন্য দেওয়ালগুলোর উপর
নজর রাখতে হয়,
কারা কখন কীভাবে কেন লিখছে এবং কী লিখছে
কারা মুছে দিচ্ছে এবং কারা তাবৎ মোছামুছি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে
আবার লিখছে,—- সবই আমাকে মুখস্ত করতে হয় |
যখন দেখি, ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ তখন বুঝতে পারি
বিষয়টা সহজে হবার নয় | কিংবা যখন দেখি অমুকচন্দ্র তমুককে
ছারপোকা-মার্কা বাক্সে ভোট দিন, তখন বুঝতে পারি বাক্সের আড়ালে
মস্ত কলা এবং কৌশল আছে | অথবা যখন অধ্যয়ন করি —-
‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য জিন্দাবাদ’ তখন রাস্তার মোড়ে একটা ভিখিরির
বাড়ানো হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আমি এই দু’নম্বর মুক্তিসূর্যের দিকে
ভুরু কুচকে তাকাই—- ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে চোখ পুড়ে যায়, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়,
কিন্তু ঝলসানো তামার থালার মতো আকাশ আমাকে
মুক্তির কথা কিছুই বলে না |
যখন পড়ি, ‘কমরেড কানু সান্যালকে জেল ভেঙে ছিনিয়ে আনুন’—-
তখন ভাবি এঁরা অন্যের উপর দায়িত্ব দিয়ে
চলে গেলেন কেন ? কিংবা আলকাতরা ও ব্রাশের নৈশসংঘর্ষে
যখন দেওয়ালে ফুটে ওঠে, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ তখন
ক্ষমতার আগে ‘রাজনৈতিক’ শব্দটা নেই ব’লে আমি আঁতকে উঠি এবং
খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ি এবং চিন্তা করতে করতে বার তিনেক
হোঁচট খেয়ে, একটা গুঁতায়মান ষাঁড়কে ধাপ্ পা মেরে,
সেই সারি সারি ভাঙা টালির ঘরগুলোর সামনে এসে দাঁড়াই | এবং
সমস্ত নিস্তব্ধ উনুন, নর্দমার গড়ানো নোংরা জল, পচা গোবর,
বিচুলির বোঁটকা গন্ধ, আর কানে আঙুল-দেয়া খিস্তির বান
এড়িয়ে এ-গলি ও-গলি ক’রে শেষ পর্যন্ত পল্টুদের দরজায় এসে
কড়া নাড়ি ; কিন্তু খুব সূক্ষ্ম দরকার থাকা সত্ত্বেও পল্টুকে পাই না—-
তা’র নাকি দুটো-দশটা ডিউটি |
পল্টুকে পেলাম না বলে আমি অতিশয় মুষড়ে পড়ি এবং
হতাশ হ’তে হ’তে পৃথিবীর সমস্ত শ্লেগানের অর্থ এবং
অন্তঃসারশূন্যতা বিষয়ে যখন মনে মনে তর্ক ক’রে একমত হই এবং
আলবেয়ার কাম্যু কিংবা বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসের নায়কের মতো
আমার ফোক্ লা অস্তিত্বের বিলকুল গহন প্রদেশে যখন
মহান শূন্যতার রুচিকর ঘনঘটা দেখা দিতে আরম্ভ করে এবং
আমি ক্রমশ রাতের হাওড়া ব্রিজের মতো বড্ড একা কিংবা অভিমানী
শুশুকের মতো
ডোবা-ভাসা হয়ে যাই— ঠিক সেই সময়ে
একটা খোলার ঘরের বারান্দায়
ঠান্ডা উনুনের পাশে
দু’হাত কোমরে রেখে
খাটিয়ার উপর ডান পা তুলে দিয়ে
গন্ গনে রাগ এবং কান্নায় ফুঁসে-ওঠা একটা আট-দশ বছরের
উলঙ্গ ছেলে
গুলমার্গ থেকে বিবেকানন্দশিলা পর্যন্ত থর থর করে কাঁপিয়ে দিয়ে
ভারতবর্ষের সমস্ত দক্ষিণবাহিনী নদীকে
বাঁ দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে
সমস্ত অস্ত্র-কারখানা বিমানবন্দর, সমস্ত বেনামী জমির দলিল
পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার খসড়া, যৌন সাহিত্যে আগুন লাগিয়ে দিয়ে
বিশাল পর্বতমালা জলস্রোত মাঠ-ময়দানের সমস্ত
খসশান জমায়েতকে তিনটি শব্দের মধ্যে স্তব্ধ ভয়ঙ্কর তোলপাড় ক’রে
খাটিয়ার উপর লাথি মারতে মারতে তার
সুকেশিনী ধূর্ত সৎমাকে চীত্কার করে বললো—-
‘ভাত দে হারামজাদী’ |
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন