বিয়ের আসর
বিয়ের আসর
মোঃ মাহিম খান

গল্প - বিয়ের আসর

লেখক: মোঃ মাহিম খান
প্রকাশ - শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ধরণ: জীবনবাদী

রসুলপুর গ্রামের তালেব বেপারীর একমাত্র কলেজ পড়ুয়া মেয়ে সাহিদা। সে পড়াশোনা, জ্ঞানবুদ্ধিতে সবারই প্রশংসা পায়। সাহিদা একদিন কলেজে খবর পেল তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার মা আগে থেকেই কঠিন এক রোগে আক্রান্ত। সে দ্রুত বাড়িতে ছুটে গেল। মাকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার জানাল, তার মায়ের রোগটি পুরোনো হয়ে যাওয়ায় তা আর স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তাই তাকে সুস্থ করতে হলে অপারেশন করতে হবে। ডাক্তার আরও বললো অপারেশন করতে হলে লাখখানেক টাকা লাগবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করতে হবে।
তালেব বেপারী চিন্তায় পড়ে গেলেন। সে চায়ের দোকান করে সামান্যই আয় করেন। তার পরিবারে একমাত্র সে-ই উপার্জন করে। সংসারের সকল খরচ তাকেই বহন করতে হয়। তার স্ত্রীর অপারেশনের এত টাকা কোথায় পাবে! আর টাকা না হলে অপারেশনই বা কী করে হবে! ঐদিকে ডাক্তার বলে দিয়েছে তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে হবে।
তালেব বেপারী চিন্তা করতে করতে হাসপাতাল থেকে বের হলেন। আর ভাবতে লাগলেন কার কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়া যায়। হঠাৎ করে তার মনে পড়লো, গ্রামের সাদেক মাতাব্বরের কথা। সাদেক মাতাব্বর হলেন সেই গ্রামের একজন ধনী ব্যক্তি। তার দুই ছেলের মধ্যে একজন হলো ফয়সাল। ফয়সালের কাজকর্ম তেমন ভালো নয়। সে গ্রামে ছেলেপেলে নিয়ে বিভিন্ন কুকর্ম করে বেড়ায়। গ্রামের মেয়েদেরকে নানানভাবে জালাতন করে। ফয়সাল আগে থেকেই বেপারীর মেয়ে সাহিদাকে পছন্দ করে। ফয়সাল একথা তার বাবা মাতাব্বরকেও জানিয়েছিল। তার বাবা বলেছিল, আরও কিছুদিন পর সাহিদার বাবাকে প্রস্তাব পাঠাবে। কিন্তু ফয়সালের এসব কাজের জন্য সাহিদা তাকে অপছন্দ করে। একথা ফয়সালও জানে।
তালেব বেপারী মাতাব্বরের বাড়িতে আসলেন। এসে তাকে পেয়ে তার কাছে তার স্ত্রীর অসুস্থতা ও অপারেশনের কথা বলেন। মাতব্বর সব শুনলেন। হঠাৎ করেই তারা মাথায় তার ছেলে সাহিদাকে পছন্দ করে সে কথা চলে আসে। সে ভাবলো, সাহিদা তো আমার ছেলেকে পছন্দ করে না। কিন্তু এখন যদি তার বাবাকে টাকা দিয়ে উপকার করি, তাহলে পরে হয়তো প্রস্তাব পাঠালে রাজি হবে। এই ভেবে সে তালেবকে টাকা দিতে রাজি হয়। বললো, ‘ঠিক আছে তালেব! কাল সকালে এসে টাকা নিয়ে যেও।’ তালেব বেপারী খুশি হয়ে স্ত্রী ও মেয়ের কাছে হাসপাতালে চলে গেল। ডাক্তারকে বললো, ‘স্যার আপনি আমার স্ত্রীর অপারেশনের ব্যবস্থা করেন, কাল সকালে আমি টাকা পরিশোধ করে দেব।’ সাহিদা তার কাছে জানতে চেয়েছিল এত টাকা কীভাবে ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু সে কিছু বলেনি।
পরেরদিন সকালেই তালেব মাতাব্বরের বাড়িতে ছুটে যায় টাকা আনতে। মাতাব্বর তাকে পুরো এক লাখ টাকা বুঝিয়ে দিলেন। তালেব কৃতজ্ঞতার ভাষা প্রকাশ করে টাকা নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গেল। এদিকে মাতাব্বরও খুশি হলেন। ভাবলেন, এবার সাহিদা রাজি হবে আমার ছেলেকে বিয়ে করতে। ডাক্তার অপারেশনের সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তালেব বেপারী টাকা পরিশোধ করলো। তার স্ত্রীকে অপারেশনের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। সাহিদা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। পৃথিবীতে তার আপনজন বলতে এই মা আর বাবা-ই আছেন। বেপারী সাহিদাকে স্বান্তনা দিলেন। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে জানাল, অপারেশন সফল হয়েছে। একটু পরেই তারা গিয়ে দেখা করতে পারবে। সাহিদা ও তার বাবা কিছুক্ষণ পর দেখা করলো এবং তারা চিন্তামুক্ত হলো। ডাক্তার বেপারীকে বললো, ‘দুদিন পরেই আপনার স্ত্রীকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন।’
দুদিন পর তারা বাড়িতে ফিরল। সাহিদার মা এখন রোগমুক্ত। তবে কিছুদিন ঔষধ খেতে হবে। রাতের বেলা সাহিদা দেখলো তার বাবা একা বসে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে কোনো চিন্তায় আছেন। সাহিদা তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। তখন তার বাবা জানাল সে মাতাব্বরের কাছে টাকা ধার নিয়েছে। এত টাকা কীভাবে শোধ করবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন। সাহিদা তার বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, চিন্তা করার দরকার নেই আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন। পরের দিন সকালবেলা সেই মাতাব্বর সাহেব তালেব বেপারীর চায়ের দোকানে আসেন। তালেব বেপারীর স্ত্রীর খোঁজখবর নিয়ে মাতাব্বর তালেব বেপারীকে বললেন ‘তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।, এরপর মাতব্বর সাহেব বললেন, ‘আমার ছেলে ফয়সাল তোমার মেয়ে সাহিদাকে পছন্দ করে, তুমি রাজি থাকলে শীঘ্রই আমার ছেলের সাথে তোমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারি। এবং তোমার সেই এক লাখ টাকা আর শোধ করতে হবে না।’ মাতব্বরের এই প্রস্তাব শুনে তালেব বেপারী একটু চিন্তায় পড়লেন এবং বিরক্তি ও বোধ করলেন। কারণ তার ছেলে ফয়সাল ভালো ছেলে নয়। এমন একটা ছেলের সাথে তার মেয়েকে কিভাবে বিয়ে দিতে পারে। তালেব বেপারী মাতব্বর কে বললেন, সাহিদা এবং সাহিদার মায়ের সাথে আলাপ করে তাকে জানাবে। তালেব বেপারী যখন বাড়িতে গিয়ে সাহিদাকে প্রস্তাবের কথা জানান তখন সাহিদা রাজি হলো না। সাহিদার মাও বললো, এমন একটা ছেলের সাথে আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দেবো না। এসব শুনে তালেব বেপারী আবার চিন্তায় পড়লেন, যদি তার মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি না হয় তাহলে মাতাব্বর সাহেব যদি এখন আবার টাকা চেয়ে বসে তাহলে টাকা কিভাবে দিবে।
পরের দিন সাহিদা কলেজে যাওয়ার সময় গ্রামের তরিকুল মাস্টারের ছেলে মতিনের সাথে দেখা হয়।
মতিন শহরে থেকে লেখাপড়া করেছেন এবং শহরে এখন একটি ভালো চাকরিও করেন। সাহিদার সাথে কথা বলে সাহিদার সরলতা মতিনের খুব ভালো লেগে যায়। মতিন বাড়িতে গিয়ে তার বাবা তরিকুল মাস্টারকে সাহিদার কথা জানায়। সে তার বাবার কাছে সাহিদাকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করে। তার বাবাও সাহিদাকে ভালো মেয়ে হিসেবেই জানে। পরের দিন তরিকুল মাস্টার তালেব বেপারীর চায়ের দোকানে যায়। সেখানে তালেব বেপারীকে তার ছেলের ব্যাপারে বলে। এবং তার মেয়েকে তার পুত্রবধূ করে নেওয়ার প্রস্তাব জানায়। তালেব ব্যাপারী অবশ্য প্রস্তাব পেয়ে খুশি হয়েছেন। কারণ তরিকুল মাস্টার একজন ভালো মানুষ এবং তার ছেলেও ভালো। তালেব বেপারী বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রী এবং সাহিদা কে এ ব্যাপারে জানায়। সাহিদা এবার না বলেনি। তার স্ত্রীও এ প্রস্তাবে রাজি হলেন। কিন্তু তালেব বেপারী একটু চিন্তিত। ওইদিকে মাতব্বর সাহেব তার ছেলের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। তাকেও না বলতে সাহস পাচ্ছে না। পরের দিন তরিকুল মাস্টার তালেব বেপারীর বাড়িতে আসলেন। তার দেওয়া প্রস্তাব সম্পর্কে তালেব বেপারীর কাছে জানতে চায়। তখন তালেব বেপারী তাকে জানায় এই প্রস্তাবে সবাই রাজি। এরপর তালের বেপারী তরিকুল মাস্টারকে মাতাব্বর সাহেবের থেকে টাকা ধার নেওয়ার ব্যাপার এবং তার ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব সম্পর্কেও বলে। তরিকুল মাস্টার বাড়িতে গিয়ে তার ছেলে মতিনকে এসব জানায়। এসব শুনে মতিন তালেব বেপারীর সাথে কথা বলতে চায়। মতিন তালেব বেপারীর সাথে দেখা করে তাকে সাহস দিলেন এবং বললেন আপনারা রাজি থাকলে বিয়ের ব্যবস্থা করুন। মাতাব্বর সাহেব কিছু করতে পারবে না। আপনার যখন সময় হবে তখন আপনি তার টাকা পরিশোধ করবেন। তালেব বেপারেী তার স্ত্রী ও সাহিদার সাথে কথা বলে বিয়ের তারিখ ঠিক করলেন। বিয়ের সকল ব্যবস্থা এবং আয়োজন শুরু হলো। এদিকে সাহিদার বিয়ের খবর মাতাব্বর সাহেবের কানে গেল। এবং ফয়সালও শুনলো। মাতাব্বর সাহেব এবং তার ছেলে মিলে এ বিয়ে ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করলো। বিয়ের দিন বিয়ের আসরে এসে মাতাব্বর সাহেব ও তার ছেলেপেলেরা ঝামেলা শুরু করলো। মাতব্বর সাহেব বলল, যদি সাহিদাকে তার ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া না হয় তাহলে এই মুহূর্তে তার টাকা পরিশোধ করতে হবে। একথা শুনে বিপাকে পড়ে গেলেন তালেব বেপারী। মুহূর্তেই মতিন দাঁড়িয়ে মাতাব্ব্র সাহেব কে বলল, আপনার টাকা এখনই পরিশোধ করা হবে এবং আপনি আপনার বাহিনী নিয়ে এখান থেকে চলে যান। মতিন জানতেন মাতব্বর সাহেব বিয়ের আসরে এসে ঝামেলা করতে পারে। এজন্য সে আগে থেকেই টাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। এরপর মতিন তালেব বেপারীর পক্ষ থেকে মাতাব্বরের সব টাকা পরিশোধ করলেন।

১৬৮
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন