বর্তমানে \’ধর্মনিরপেক্ষ\’ শব্দটি এদেশের সর্বনাশের মূল কারণ নাকি তা পরিকল্পিত এক রাজনৈতিক শিকার এ নিয়ে রামে-বামে চুলোচুলির সাক্ষী গোটা দেশ। অপর দিকে মানুষ কি আদতেই কখনো নিরপেক্ষ ছিলো? বা পক্ষ না নিয়ে থাকতে পেরেছে এ নিয়ে আমার প্রবল সংশয় থাকলেও ধর্মীয় অন্ধ প্রজাতির যে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই তা নিয়ে আমিও আপাতত নিশ্চিত ।
তারপর হঠাৎ এক হাওয়ার ঝাপটায় আমাদের প্রগতিশীলতার চাদর খুলে গেলো এবং আমরা উলঙ্গ নাচ নাচতে শুরু দিলাম।
ভাষা মানুষের বিবেক, সভ্যতার পাথেয়। কিন্তু যখন সেই ভাষা রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন শব্দ হারায় তার নিরপেক্ষতা, বিকৃত হয় অর্থ, কলুষিত হয় মানুষের চেতনাও। শিক্ষিত মানুষের ভাষা – যে ভাষা আদর্শ, মানবতা, সাম্য ও প্রগতির কথা বলে – বারবার ব্যবহৃত হয়েছে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য।
যেমন,
– ফরাসি বিপ্লব(১৭৮৯) থেকে ভাতৃত্ববোধ। ফরাসি বিপ্লবের স্লোগান ছিল – \”Liberté, Égalité, Fraternité\” (স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব)।
এই বিপ্লব রাজতন্ত্র, চার্চ ও ধনিক শ্রেণির নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিদ্রোহ ছিল। \”Fraternity\” বা ভ্রাতৃত্ববোধ শব্দটি রাজনৈতিক ও সামাজিক বন্ধনের প্রতীক হিসেবে গৃহীত হয় এবং পরবর্তীতে সংবিধান ও আইনি নথিতেও ঢুকে পড়ে।
– \’ধর্মনিরপেক্ষতা\’
চার্চ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা বিভাজনের দাবিতে এই শব্দটি আসে। ১৮৫১ সালে ব্রিটিশ লেখক George Jacob Holyoake এই শব্দটিকে প্রথম ‘secularism’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন – যার অর্থ ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক নীতিতে বিশ্বাস।
খ্রিস্টীয় মধ্যযুগে গির্জা ছিল রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্র। একাধিক ধর্মসংঘাতের পর রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথক করার প্রয়োজন দেখা দেয়।
ভারতবর্ষে বহু প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মীয় সহাবস্থান ছিল।
অশোকের বৌদ্ধ ধর্মগ্রহণ (খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক) ছিল এক ঐতিহাসিক উদাহরণ, যেখানে তিনি হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন সহ সকল ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের আহ্বান জানান।
অকবরের দীন-ই-ইলাহী (১৫৮২): তিনি চেয়েছিলেন সব ধর্মের সারাংশকে মিলিয়ে একটি ধর্মীয় সহনশীল সাম্রাজ্য গঠন করতে।
১৯৭৬ সালে, ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে, “Secular” শব্দটি সরাসরি ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু এই সামান্য ইতিহাস টুকু না জেনেই মানুষ বাবা সাহেব আম্বেদকর নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থে তৈরি করা মিম গুলো না বুঝেই অন্ধের মতো শেয়ার করে চলেছে।।
যাইহোক আসি
\’সাম্য\’ শব্দে, যার উৎপত্তির সন্ধান করলে ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকান স্বাধীনতার যুদ্ধের কথা প্রথমে উঠে আসে। \”All men are created equal\” – এই বাক্যটি আমেরিকার ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রে ছিল। এরপর ফরাসি বিপ্লব এই নীতিকে রাজনৈতিক চেতনায় রূপ দেয়। সামাজিক শ্রেণি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এটি ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এবং হিমালয় সমান সেই প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে মানুষ খানিকটা হলেও পেরেছিলো।
অপরদিকে গির্জা-কেন্দ্রিক ভাবনার বিপরীতে মানুষের যুক্তি, স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে প্রাধান্য দেওয়ার যে ধারা শুরু হয়েছিল, তার হাত ধরেই জন্ম নিলো \’ মানবতা\’ শব্দটি।
কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র, মানবতা,গণতন্ত্র,বাকস্বাধীনতা,
সার্বভৌমত্ব,চেতনা,সহমর্মিতা,সংহতি ইত্যাদি
– এসব শব্দ আজ যেন রাজনৈতিক তামাশার পুতুল।
একসময় ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল সহাবস্থানের প্রতীক। ভারতে সংবিধানের অন্যতম মূল স্তম্ভ এই শব্দই এখন প্রশ্নের মুখে। ১৯৭৩ এ ঐতিহাসিক কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার কোনভাবেই পরিবর্তন করা যাবে না বলে ঘোষণা করলেও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি আজ এমনভাবে ব্যবহৃত হয়, যেন এটি একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে তোষণ করার হাতিয়ার। অথচ এটি ছিল রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ অবস্থান এবং সব ধর্মের সমান মর্যাদার গ্যারান্টি। ইতিহাসে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ফ্রান্সের বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম কিংবা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি আদর্শবাদী তত্ত্ব ছিল, যার মূল ছিল ‘মানব’কে কেন্দ্রে রাখা।
ধর্ম মানব সভ্যতার এক মৌলিক অনুষঙ্গ। পাশাপাশি প্রতিটি ধর্মকে সামনে রেখে তার পেছনে চলা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদ আজ এক নতুন রুপ নিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা এক ধরনের বিষবৃক্ষ—যার গোড়ায় ঢালা হয় ধর্মের জল, আর ফল ধরে ঘৃণা ও বিভেদের। সেই বৃক্ষ রাজনীতির ছায়ায় বেড়ে ওঠে, সমাজকে ছায়া দেয় না, বরং ঢেকে দেয় সত্য ও সহানুভূতির আলো।
– \’ক্রুসেড\’ (১১শ-১৩শ শতক)পোপের আহ্বানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের যুদ্ধ।স্প্যানিশ ইনকুইজিশন- খ্রিস্টধর্ম ছাড়া অন্য ধর্ম মানলেই মৃত্যু বা অত্যাচার।হিটলারের ইহুদি নিধন, মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব বহু শতাব্দী ধরে রক্তপাতের উৎস। কিংবা
১৯০৯ সালের মার্লে-মিন্টো সংস্কার, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ যা স্বাধীনতার পরও সেই ইতিহাস থেমে থাকেনি।
১৯৮৪-র শিখবিরোধী দাঙ্গা,১৯৭১ এর উদবাস্তুর ইতিহাস, ২০০২-র গুজরাট দাঙ্গা কিংবা ২০২৫ এর কাশ্মীর। সবকিছুর সাক্ষী এ দেশ।
বর্তমানের কাশ্মীরে ঘটে যাওয়া হত্যালীলা ও তাকে ঘিরে রাজনৈতিক তোরজোর যার চরমতম উদাহরণ।
একটু লক্ষ্য করে দেখবেন মুসলিমদের একটা বড় অংশ ধর্ম জিজ্ঞেস করে কাশ্মীরে হত্যা লীলার বিষয়টিকে উপেক্ষা করে ইন্টালিজেন্স ফেইলিওর বিষয়টিতে বেশি গুরুত্ব দিতে চাইছে অপর দিকে হিন্দুদের একটা অংশ ইন্টালিজেন্স ফেইলিওর বিষয়টি নিয়ে খুব একটা সচেতনতা দেখাতে চাইছে না বোধহয়। আরও লক্ষ্য করে দেখবেন
যারা ধর্ম জিজ্ঞেস করে মারলো তারা কিন্তু কোনো সাম্প্রদায়িক হিন্দুকে মাররেনি বা কোনো সাম্প্রদায়িক হিন্দু গিয়ে কোনো সাম্প্রদায়িক মুসলমানকে হত্যা করেছে এমন উদাহরণ দেখা যায় না।
দুই পক্ষের দ্বারাই প্রান যায় সাধারণ নিরীহ মানুষের। হয়তো উদ্দেশ্য মাফিক ভাবেই সাধারণ নিরীহ মানুষের প্রান নেওয়া হয় যাতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ আরও শক্ত হয় মানবতার মাটিতে।
\’ধর্ম\’ সাধারন মানুষের একটা আশ্রয় নেওয়ার স্থান কিন্তু অপর দিকে
বিশ্ব ইতিহাস যে রক্তের দাগের লজ্জা আজও বহন করে নিয়ে চলেছে তার অধিকাংশ কারনই \’ধর্ম\’।
কোথাও একজন নাস্তিক রাইফেল নিয়ে কোনো ধার্মিকের মুখোমুখি হয়নি, কোথাও একজন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ হাতে তরবারি নিয়ে সাধারণ মানুষের বুকের উপর আঘাত হানেনি। তাই মানুষ যে আসলেই কখনো নিরপেক্ষ ছিলো তা বলা যায় কি ?
স্বাধীনতার পূর্বে একদল আইন সভায় বসে যেমন হকের দাবির জন্য চিৎকার করছে অপর দিকে একদল রাইফেল হাতে কিংসফোর্ড মারছে।
নিরপেক্ষ হলে আদেও ইতিহাস লেখা হতো কি?
কিন্তু বর্তমানে সব থেকে আশঙ্কার জায়গা শিক্ষিত মানুষের ভাষা আজ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদের রাইফেলের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে ।
ইতিহাসের নানা পর্যায়ে, সেই ভাষাগুলির অপব্যবহার হয়েছে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য। ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্যবাদ, মানবতা, সমাজতন্ত্র—এসব ধারণা যদি তাদের মূল উদ্দেশ্য অনুযায়ী রয়ে যেত, তাহলে সমাজে কোনো ধরনের বৈষম্য, সহিংসতা বা রাজনৈতিক দমন-পীড়ন দেখা যেত না। আজ সময় এসেছে, যখন আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চর্চায় এই ভাষাগুলির প্রকৃত উদ্দেশ্য খুঁজে বের করে আগামীর পথে ধাবিত হওয়া, যাতে একে অপরকে শ্রদ্ধা করে, মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাস রেখে একটি সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
🖊️ নন্দ দুলাল মন্ডল।
___________________________
___________________________
#বিদ্র : এই প্রতিবেদনটি একটি শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যেই লেখা। এর মধ্যে ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক স্বার্থ নেই। তাই অনিচ্ছাকৃতভাবে কেউ কিছু খুঁজে পেলে তার দায় কারো নয়।
সঠিক,সুন্দর,উপযুক্ত…
Sundor