প্রসূন গোস্বামী

কবিতা - পাহাড় জ্বলে, উপত্যকায় কাঁদে ঘুম

প্রসূন গোস্বামী

আজও দেখছ, বন্ধু, সেই পুরোনো রক্তক্ষরণ—
উপত্যকা থেকে উঠে আসে কেমন এক তীব্র আর্তনাদ?
যেন পদ্মা নয়, এ আমার প্রাণের স্রোতস্বিনী কর্ণফুলী,
যার বুক চিরে চলে যায় তীক্ষ্ণ, অদৃশ্য এক ফাটল।

এ তো শুধু কয়েকটি পাহাড়ের কথা নয়,
এ আমার জন্মভূমির একটি মানচিত্র, যেখানে
সাদা মেঘের মতো সহজ জীবন কাটে না আর।

শোনো, এই মেয়েটির কণ্ঠস্বর—
এখানে বাজার করা মানে যুদ্ধের জন্য রসদ সংগ্রহ,
কে কতটুকু চাল নিয়ে ফিরবে, সে হিসেবও
অন্য হাতে লেখা; এক অলিখিত ফরমান।
দৈনন্দিন পথচলা মানে শহরের রাজপথ নয়,
প্রতি পদক্ষেপে বারো আনা সন্দেহের ব্যারিকেড।

যেন আমরা নই এই মাটির আদিম সন্তান,
যেন অন্য গ্রহের আগন্তুক, যাদের পরিচয়
বারবার দিতে হয় শতবার, আর প্রতিটিবারই
আমাদের বুকে সেঁটে দেওয়া হয় এক পোড়া তকমা—
বিচ্ছিন্নতাবাদী! সন্ত্রাসী!

৬১টি জেলার মানুষ যেমন খোলা হাওয়ায়
নিঃশব্দে হেঁটে যায়, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে,
যেমন কোনো কবি কফিহাউসের টেবিল ছেড়ে
অনায়াসে পৌঁছায় ভিক্টোরিয়ার সবুজ ঘাসে;
তেমনি করে কেন তবে এ পাহাড়ের মানুষ
হয়ে গেল এক নিষিদ্ধ বিজ্ঞাপন?

আমাদের দিকে তাকানো হয় এমন এক সন্দেহ নিয়ে,
যেন আমাদের শরীরের প্রতিটি লোমকূপ
লুকিয়ে রেখেছে কোনো গোপন অস্ত্রাগার।
কোথায় গেল সেই পার্বত্য চুক্তির আশ্বাস?
সে তো কেবলই কালি-ঝরা এক পুরনো দলিল,
যা আজও রাঙ্গামাটির হাটে বিক্রি হয় না—
বিক্রি হয় শুধু আমাদের চাপা দীর্ঘশ্বাস।

বন্ধ করো এই দৈনন্দিন জীবনযাপনের উপর
তোমাদের অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপের চাবুক।
আমরা কয় কেজি চিংড়ি কিনে ফিরব, বা
কখন সন্ধ্যার তারা দেখব আমাদের উঠোনে—
তাও কি তবে তোমাদের চেকিং পোস্টের অনুমতি নিয়ে?

না, এ আগুন বাইরের নয়, এ জ্বলন শুধু মনের গভীরে,
যখন স্বদেশেই আমরা হয়ে যাই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।
পাহাড়ের মানুষ তবে কেন এই অকারণ বন্দিত্বের শিকার?
কেন তারা কেবলই বিচ্ছিন্নতার ট্যাগ নিয়ে মাথা নীচু করবে?

আজ সেই প্রশ্নটি আকাশের দিকে ছুড়ে দিলাম—
যেমন করে এককালের বিক্ষুব্ধ যুবকেরা ছুড়েছিল
এক মুঠো লাল শ্লোগান!

এই কণ্ঠস্বর, বন্ধু, এ কোনো নিছক অভিযোগ নয়,
এ আমার সমুদ্রের চেয়েও গভীর এক দাবি:
শান্তি নয়, চাই পূর্ণ মুক্তি—পরিচয়ের এবং চলার পথের।

পরে পড়বো
৩৬
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন