বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন আজ
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন আজ
সাহিত্য বার্তা

আলোচনা - বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন আজ

লেখক: সাহিত্য বার্তা
প্রকাশ - বুধবার, ০৭ মে ২০২৫ ধরণ: জন্মদিন

আজ ২৫ বৈশাখ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ ও বাংলা ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকোর এক ধর্ণাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যিক হিসেবে তিনি এই পুরস্কার লাভ করেন, আর তাই রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন (১৮৬১–১৯০১)
বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও ব্রাহ্ম দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের প্রথম চারটি দশক (১৮৬১–১৯৪১) ছিল তার শৈল্পিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শের বিকাশপর্ব।

পারিবারিক প্রেক্ষাপট
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম জোড়াসাঁকোর ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের পারিবারিক বাসভবনে। জোড়াসাঁকো ছিল সেযুগে “ব্ল্যাক টাউন” (বাঙালি অধ্যুষিত নগরাঞ্চল; ইউরোপীয়দের আবাসস্থল দক্ষিণ কলকাতা ছিল “হোয়াইট টাউন”) নামে পরিচিত উত্তর কলকাতার চিৎপুর রোডের (বর্তমান নাম রবীন্দ্র সরণি) নিকটে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আশেপাশের অঞ্চলগুলি সেই সময় ছিল দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল এবং শহরে কেন্দ্র। রবীন্দ্রনাথের পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭–১৯০৫) এবং মাতার নাম সারদা দেবী (১৮৩০–১৮৭৫)। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর বন্ধু তথা সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের প্রধান সংগঠক ও অনুশাসনকর্তা। রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন ব্রাহ্মসমাজের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর অনুগামীরা তাকে মহর্ষি অভিধায় ভূষিত করে। আমৃত্যু দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতা। অস্পৃশ্যতা প্রথার কারণে কেবল পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) যশোর-খুলনার পিরালী ব্রাহ্মণ কন্যারাই ঠাকুর পরিবারে বধূ হয়ে আসতেন।

শৈশব ও কৈশোর (১৮৬১–১৮৭৮)
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর পিতামাতার পঞ্চদশ সন্তানের মধ্যে চতুর্দশতম। ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যপত্রিকা, সঙ্গীত ও নাট্যানুষ্ঠান পরিবেষ্টিত পরিবেশে প্রতিপালিত হন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল সেযুগের বিদ্যোৎসাহী ও শিল্পোৎসাহী সমাজে এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন একজন সম্মানীয় দার্শনিক ও কবি। তাঁর মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন সে যুগের অভিজাত ও শ্বেতাঙ্গ-প্রধান ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের প্রথম ভারতীয় সদস্য। নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন একজন প্রতিভাবান সংগীতস্রষ্টা ও নাট্যকার। তাঁর এক দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন একজন স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক। বালক “রবি”-র উপর এঁদের সকলের প্রভাব ছিল অপরিসীম। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের থেকে সামান্য বড়ো। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধুস্থানীয় এবং তাঁর রচনার এক অনুপ্রেরণা। ১৮৮৪ সালে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু বহু বছর রবীন্দ্রনাথের মনকে অশান্ত করে রেখেছিল। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেও এই মৃত্যু চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যায়।

জীবনের প্রথম দশ বছরে পিতার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাননি রবীন্দ্রনাথ। এই সময় দেবেন্দ্রনাথ প্রায়শই উত্তর ভারত, ইংল্যান্ড ও অন্যান্য স্থানে পর্যটনে রত থাকতেন। এদিকে রবীন্দ্রনাথ মূলত পারিবারিক গণ্ডীতে আবদ্ধ থাকতেন। একমাত্র স্কুলে যাওয়া ছাড়া অন্য সময় বাড়ির বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ফলত বাইরের জগৎ ও প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন বালক রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুরবাড়ির ভৌতিক ও রহস্যময় সত্ত্বাটিও রবীন্দ্রনাথকে সন্ত্রস্ত করে রাখত। জীবনের এই পর্বে বাড়ির ভৃত্যদের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর নিজের ভাষায় এ ছিল এক “ভৃত্যরাজক তন্ত্র”। জানা যায়, এক এক সময় ছোটোদের শান্ত করতে ভৃত্যেরা তাদের মাথা পানীয় জলের বড়ো বড়ো পাত্রের মধ্যে চুবিয়ে রাখত। ভৃত্যদের সন্তুষ্ট রাখতে বালক রবীন্দ্রনাথ অল্প আহার করতেন। শ্যাম নামের একটি চাকর তাকে একটি খড়ির রেখার গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করে রাখত আর ভয় দেখানোর জন্য রামায়ণের সীতাহরণের উপাখ্যান এবং রক্তপিপাসু ডাকাতদের ভীতিপ্রদ গল্পগুলি শোনাতো।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা আরম্ভ হয় দাদা হেমেন্দ্রনাথের হাতে। ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ শারীরিকভাবে সুস্থসবল ও বলবান ছিলেন – তিনি গঙ্গায় সাঁতার কাটতেন, পাহাড়ি রাস্তায় হেঁটে বেড়াতেন, এমনকি বাড়িতে জুডো ও কুস্তি অনুশীলন করতেন। বাংলা ভাষায় শারীরস্থান, অঙ্কন, ইংরেজি ভাষা (সেই সময় তাঁর সর্বাপেক্ষা অপ্রিয় বিষয়), ভূগোল, ইতিহাস, সাহিত্য, গণিত ও সংস্কৃত চর্চা করতেন গৃহে ও বিদ্যালয়ে। অবশ্য বিদ্যালয়ের ধরাবাঁধা শিক্ষাব্যবস্থা তাকে আকৃষ্ট করে রাখতে পারেনি। নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাদেমি, ওরিয়েন্টাল সেমিনারি ও শেষে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে কিছুকাল পড়াশোনার পর তিনি অবশেষে বিদ্যালয়ে যেতে অস্বীকার করেন। বিদ্যালয়ের নিষ্প্রাণ শিক্ষাব্যবস্থা পরবর্তীকালেও তাঁর দ্বারা সমালোচিত হয়েছিল।

আট বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ কাব্যরচনা শুরু করেন। তাঁর এক দাদা তাকে এই কবিতাগুলি বাড়ির অন্য সকলকে পড়ে শোনাতে বলতেন। রবীন্দ্রনাথের এক শ্রোতা ছিলেন জনৈক ব্রাহ্ম জাতীয়তাবাদী, সংবাদপত্র সম্পাদক ও হিন্দুমেলা সংগঠক। এগারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন দীক্ষানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ব্রাহ্মণ্য সংস্কার অনুযায়ী মস্তক মুণ্ডন করে উপবীত ধারণ করেন রবীন্দ্রনাথ। এরপর ১৮৭৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পিতার সঙ্গে কয়েক মাসের জন্য কলকাতার বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয় তাঁর। প্রথমে তারা যান শান্তিনিকেতনের পারিবারিক এস্টেটে। ১৮৬৩ সালে এখানকার আম্রকুঞ্জ ও উদ্যানমধ্যে দেবেন্দ্রনাথ একটি দুই কামরার গৃহ নির্মাণ করেছিলেন। প্রকৃতির সান্নিধ্যে এই দিনগুলি সম্পর্কে পরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:

“যাহা দেখিলাম না তাহার খেদ মিটিতে বিলম্ব হইল না – যাহা দেখিলাম তাহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট হইল। এখানে চাকরদের শাসন ছিল না। প্রান্তরলক্ষ্মী দিক্‌চক্রবালে একটি মাত্র নীল রেখার গণ্ডী আঁকিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহাতে আমার অবাধসঞ্চরণের কোনো ব্যাঘাত করিত না।”

তারা কয়েক সপ্তাহ সেখানে অতিবাহিত করে অমৃতসরে আসেন। সেখানে হরমন্দির সাহিবের নিকট অবস্থান করে তারা একটি শিখ গুরুদ্বারে প্রার্থনা করেন। এই সময় রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেন ইংরেজি ও সংস্কৃত গ্রন্থাবলি, বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের জীবনী, এবং এডওয়ার্ড গিবন রচিত দ্য হিস্ট্রি অফ দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অফ দ্য রোমান এম্পায়ার এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সপুত্র দেবেন্দ্রনাথ যাত্রা করেন হিমালয়ের শৈলশহর ডালহৌসির (বর্তমানে হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে জম্মু ও কাশ্মীর-হিমাচল প্রদেশ সীমান্তের নিকটে অবস্থিত) উদ্দেশ্যে। ডালহৌসিতে ২,৩০০ মিটার (৭,৫০০ ফুট) উচ্চতায় বক্রোটা পাহাড়চূড়ার একটি বাংলোতে অবস্থান করেন তারা। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু ছেদ পড়ে না পাঠাভ্যাসেও। হিমশীতল অতি প্রত্যূষে উঠে সংস্কৃত পড়তে বসতেন তিনি; দুপুরে মধ্যাহ্নভোজের ছুটি পেতেন। তারপর আবার চলত পড়া। অবশ্য পড়তে পড়তে প্রায়শই ঘুমিয়ে পড়তেন রবীন্দ্রনাথ। দুই মাস ডালহৌসিতে কাটিয়ে পিতার সঙ্গে কলকাতায় ফিরে আসেন তিনি।

সুত্র – উইকি

২০১
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন