আজ ভাষাসৈনিক, কবি, সাংবাদিক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জন্মদিন
আজ ভাষাসৈনিক, কবি, সাংবাদিক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জন্মদিন
সাহিত্য বার্তা

আলোচনা - আজ ভাষাসৈনিক, কবি, সাংবাদিক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জন্মদিন

লেখক: সাহিত্য বার্তা
প্রকাশ - বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪

অমর একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র রচয়িতা কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। পরাধীন জাতিকে যেমন উদ্বেলিত করেছিলো রবীন্দ্রনাথের গান ‘আমার সোনার বাংলা;’ নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ তেমনি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কবিতাটিও বাঙালি জাতিকে অগ্নি শিখার মত প্রজ্জ্বলিত করেছিলো। পাকিস্তানি শাসকদের ফাঁসির দাবি করা মোটেও সহজ কথা নয়। একটি মাত্র কবিতা শাসক গোষ্ঠীকে এতটা তীব্রভাবে চিনিয়ে দিয়েছিলো যা শত শত পৃষ্ঠা গবেষনা দিয়েও সম্ভব হয়নি। এটা আকস্মিক ভাবে হয়নি, এই অমর কবিতার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর চেতনার মধ্যে। সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্ধুদ্ধ মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছোটকাল থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন। তিনি বিপ্লবী কবি সুকান্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ‘চট্টগ্রামের ছাত্র আন্দোলন, রাজনৈতিক উদ্যোগও সাংস্কৃতিক কর্মধারার সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। ১৯৫২ সালে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম প্রাদেশিক ভাষা আন্দোলন কমিটির সদস্য। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এসবই তাকে প্রতিবাদী করেছে। কোনো দুষ্কালের নির্মম প্রহারও তার চেতনা থেকে বাঙালি ঐতিহ্যের বিচ্যুতি ঘটাতে পারেনি। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী তার মত লড়াকু কবির ওপর চড়াও হতে কুন্ঠিত হয়নি। তিনি নিজে বলেছেন, ‘এক সময় রাজনীতি করতাম- এই অজুহাতে এই দেশে যখনই রাজনৈতিক দুর্যোগ নেমে এসেছে তখনি আমার বাসস্থান বার বার পুলিশ কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছে। আর আমার বইপত্র, মূল্যবান রাজনৈতিক দলিল ও পান্ডুলিপি গুলো হয়েছে এই আক্রমণের শিকার।’ ১৯২৭ সালের আজকের দিনে তিনি চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার গহিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অমর একুশের প্রথম কবিতার কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী জন্মদিন ফুলেল শুভেচ্ছা।

১৯৫০ সালে পাকিস্তান মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সে রিপোর্টে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা এ অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। মাহবুব উল আলম চৌধুরী ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালেল ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনার খবর পেয়ে চট্টগ্রামে জ্বরাক্রান্ত অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে মুখে মুখে “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি” কবিতাটি রচনা করেন। এ কবিতাটি ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত প্রথম কবিতা হিসেবে স্বীকৃত। কবিতাটি প্রকাশের পর পরই বাজেয়াপ্ত হয়। দীর্ঘকাল নিষিদ্ধ থাকার কারণে এক সময় কবিতাটি হারিয়ে যায়। কারো কাছ থেকেই কবিতাটির পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায় নি। এমনকি কবি নিজেও তা দিতে পারেন নি। দীর্ঘদিন পরে ১৯৯১ সালে অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হকের গবেষণায় কবিতাটি সম্পূর্ণ রূপ পায়

১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। ১৯৫৩ সালে গণতন্ত্রী পার্টি গঠিত হলে তিনি তার কেন্দ্রীয় কমিটির সভ্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করেন। ১৯৬৫-৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টির দুটি অংশের মধ্যে আদর্শগত দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে দলটি দ্বিখন্ডিত হয়ে যাবার পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণ করেন এবং শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত থাকেন। ১৯৫৩ সালে তিনি কবি নজরুল নিরাময় সমিতি গঠন করেন এবং এ সমিতির অর্থায়নে অসুস্থ কবি নজরুলকে চিকিৎসাকল্পে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৬৬ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ফাদার পীয়ের সহায়তায় গ্রামের উন্নতি সাধনের জন্যে নিজ গ্রামে শান্তির দ্বীপ প্রকল্প শুরু করেন। ১৯৭২ সালে তিনি চট্টগ্রাম হতে প্রকাশিত দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন।১৯৫৪ সালে ঢাকার কার্জন হলে প্রগতিশীল লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং সংস্কৃতিসেবীদের উদ্যোগে চার দিনব্যাপী সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে মাহবুবুল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে শতাধিক লেখক-সংস্কৃতিসেবী চট্টগ্রাম থেকে এ সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী আয়োজিত টাঙ্গাইলের কাগমারী সম্মেলনেও তাঁর নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক স্কোয়াড অংশগ্রহণ করে।

কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী ১৯২৭ সালের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার এক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আহমদুর রহমান চৌধুরী এবং মাতা রওশন আরা বেগম। ১৯৪৭ সালে গহিরা হাইস্কুল হতে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। তরুণ বয়সে মাহবুব উল আলম চৌধুরী ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলোকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সমাজতন্ত্রের সাড়া জাগানো ভাবাদর্শের প্রভাবে উজ্জীবিত হয়েছিলেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের জীবনে সোনালি ভবিষ্যৎ রচনার সংগ্রামী মন্ত্রে। এ সবই তাঁকে প্রণোদিত করেছিল বামপন্থী আন্দোলনে শামিল হতে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর কলেজ পরিদর্শনে এসে ছাত্রদের উদ্দেশে বক্তৃতা প্রদানকালে আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করলে মাহবুব উল আলম চৌধুরী প্রতিবাদে সোচ্চার হন এবং শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখেই কলেজ ছাড়তে বাধ্য হন। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্র রাজনীতির সংস্পর্শে এসেছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে। ক্রমেই হয়ে উঠেছিলেন বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় কর্মী এবং বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তিনি রাজনীতির গণ্ডিতেই জীবনকে আবদ্ধ রাখেননি। বরং দীর্ঘ কর্মজীবনে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মধ্যে মেল-বন্ধন রচনায় সচেষ্ট ও ব্রতী হয়েছিলেন।

(লেখাটি সামু ব্লগ থেকে নেওয়া হয়েছে।)

১৫৫
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন