ঘড়িতে তখন রাত দুটো। পুরনো বাড়ির নিচতলায় একা বসে বই পড়ছিলাম আমি। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। গ্রামের এই অংশে বিদ্যুৎ চলে যাওয়াটা নতুন কিছু নয়। তাই টেবিলের ওপর রাখা মোমবাতির টিমটিমে আলোতেই বইয়ের অক্ষরগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই কোথা থেকে যেন একটা মিষ্টি ফুলের গন্ধ ভেসে এলো, অনেকটা বেলি ফুলের মতো। অবাক হলাম, কারণ এই অসময়ে এমন মিষ্টি গন্ধ আসার কথা নয়। গন্ধটা যত তীব্র হচ্ছিল, আমার ভেতর একটা অজানা ভয় ততই জেঁকে বসছিল।
বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালাম। মোমবাতি হাতে নিয়ে করিডোরের দিকে এগোতেই দেখলাম, দরজার ঠিক সামনে এক জোড়া আবছা পায়ের ছাপ। ছাপগুলো ভেজা, যেন কেউ কাদা মাড়িয়ে এসেছে। কিন্তু বাইরে তো বৃষ্টি হয়নি! আর বাড়ির মূল দরজা তো ভেজানোই ছিল। তাহলে কে এলো? বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। মোমবাতির আলোয় পায়ের ছাপগুলো অনুসরণ করতে লাগলাম। ছাপগুলো সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দিকে উঠে গেছে।
দোতলায় আমার ঠাকুরমার ঘর। অনেক বছর হলো তিনি মারা গেছেন, তাই ঘরটা তালাবদ্ধ। কিন্তু আজ সেই ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে একটা আবছা আলো আসতে দেখলাম। বুকের ধুকপুকানি যেন কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছিল। মোমবাতিটা হাতে নিয়ে কাঁপা হাতে দরজার তালাটা স্পর্শ করতেই দেখি, তালাটা খোলা। অথচ আমি নিজেই শেষবার তালাটা লাগিয়েছিলাম।
ধীরে ধীরে দরজাটা খুললাম। ঘরের ভেতরে ঢুকেই যা দেখলাম, তাতে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। ঘরের মাঝখানে রাখা পুরনো দোলনায় কেউ একজন দুলছে। মোমবাতির আলোয় আবছাভাবে দেখা যাচ্ছিল, সাদা শাড়িতে ঢাকা একটি অবয়ব। তার চুলগুলো মেঝে পর্যন্ত নেমে এসেছে। সে আমার দিকে পিছন ফিরে ছিল। মনে হচ্ছিল সে যেন গুনগুন করে গান গাইছে। কিন্তু কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। গানটা যেন কেবল আমার মনের ভেতরই বাজছিল।
হঠাৎ করে দোলনাটা থেমে গেল। সেই অবয়বটি ধীরে ধীরে আমার দিকে ফিরল। মোমবাতির আলোয় তার মুখটা দেখতে পেলাম না, কেবল একজোড়া জ্বলন্ত চোখ ছাড়া। চোখ দুটো যেন আগুনের গোলা। সেই চোখে কোনো রাগ ছিল না, ছিল কেবল অসীম বেদনা। সে হাত বাড়িয়ে আমার দিকে ইশারা করল। আর তখনই সেই বেলি ফুলের গন্ধটা আবার আমার নাকে এলো।
ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। এক পা, দুই পা করে পেছাতে লাগলাম। হঠাৎ করেই মোমবাতিটা নিভে গেল। পুরো ঘরটা গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল। আমি অনুভব করলাম, কেউ যেন আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “ভয় পেয়ো না, আমি কেবল তোমাকে দেখতে এসেছি।”
পরের দিন সকালে আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় ঘরের মেঝেতে পাওয়া গিয়েছিল। এরপর থেকে সেই পুরনো বাড়িটিতে আমি আর একা থাকি না। কিন্তু আজও রাতের গভীর অন্ধকারে যখন চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তখন সেই বেলি ফুলের মিষ্টি গন্ধটা আর সেই ফিসফিসানিটা আমি আজও শুনতে পাই।

০
০
সেভ বা রিয়েক্ট করার জন্য লগইন করে নিন!
২৬
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন