আজও দেরি হয়ে গেল অর্ধেন্দু বাবুর
ইদানিং রোজ ই এরকম দেরি হয়ে যাচ্ছে
ঘুম ভাঙতেই চায় না
সকালে উঠে হাঁটুতে আর গোড়ালির নিচে অনেকক্ষণ একটা আরষ্ট ব্যথা খুব দুর্ভোগে ফেলে
তারপর বারো ঘর একখানা কলের বারোয়ারি সংসার
বস্তির টলির ঘরে একাজ সে কাজ সেরে
অর্ধেন্দু বাবুর বড্ড দেরি হয়ে যায়
আজও দেরি হয়ে গেল অনেকটা
ছাত্রের বাড়ি অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হয়
রিক্সায় গেলে নগদ দুটো টাকা
তার চেয়ে হাঁটাই ভালো
ইদানিং বয়স তো আর কম হলো না হাঁটার গতিও গেছে কমে
চোখের শক্তি ও যেন এসেছে অনেকটাই কমে
ছাত্রের বাড়ি সকালের এই পড়ানো টুকু
নানান দিক থেকে অর্ধেন্দু বাবুর ভারী প্রিয়
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই স্যান্যালবাবুরা ভদ্রলোক
পড়াতে গিয়ে কিছুক্ষণ পরেই ছাত্রের মা ঘরে এসে
নিজের হাতে দিয়ে যান সুন্দর কাপ প্লেটে চা সঙ্গে
অন্তত দুখানা ভালো বিস্কুট
সারাদিনে আর তো খুব একটা চা খওয়া হয় না অর্ধেন্দু বাবুর নিজের
একলা সংসারে চা-টাইয়ের কোনো পাট রাখেননি
অর্ধেন্দু বাবুর এই ছাত্রটি নিখিলেশ, এমনিতে খারাপ নয় তবে উঠতি বয়স, নানা আকর্ষণ, নানা দুষ্টুমি
দিন দিন বড় অমনোযোগী হয়ে পড়েছে
রেজাল্টও ভাল করছে না
এমনি নিখিলেশের মা অনেকবার হাসিমুখে অভিযোগ জানিয়েছেন ছেলের বৃদ্ধ টিউটরের কাছে
আপনি মাস্টার মশাই একটু ভালো করে দেখুন ওকে
আর একটু সময় দিন ওতো পড়েই না আপনি এলে ওই যেটুকু ওর পড়া
তারপর দিনদিন বড্ড অবাধ্য আর জেদি হয়ে উঠছে
আপনি একটু কড়া হোন মাস্টার মশাই
আজ মিত্তির পাড়ায় ঢুকেই অবনী ডাক্তারের চেম্বারে ঘড়িটা দেখলেন—
না ,সত্যিই আজ বড্ড দেরী করে ফেলেছেন
নিখিলেশের পরীক্ষা সামনেই
বারান্দায় চটি টা রেখে ঘরে ঢুকে অর্ধেন্দু বাবু বসলেন তার নির্দিষ্ট চেয়ারে
ঘরের টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে নিখিলেশ নেই
মিনিট কয়েক পরে নিখিলেশের মা ঢুকলেন
হাতে চায়ের কাপ প্লেট চা খেয়ে নিন মাস্টারমশাই
গৃহকর্ত্রীর কণ্ঠস্বরে যেন কেমন থমথমে ভাব
মাস্টারমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, নিখিল বাড়ী নেই ?
নিখিলেশের মা এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না
বললেন চা টা খেয়ে নিন, আমি আসছি
কেমন অবাক লাগল অর্ধেন্দু বাবুর
এ বাড়িতে তিনি অনেক বছর ধরে আছেন
কখনো এই মহিলাকে এমন গম্ভীর দেখেননি তিনি
নিখিলেশের মা আবার ঘরে ঢুকলেন থমথমে মুখ
অর্ধেন্দু বাবু বললেন আজও বড্ড দেরী করে ফেললাম মা
আসলে বয়স হয়ে যাচ্ছে তো একসময় এটুকু পথ
পাঁচ মিনিটে পেরিয়ে যেতাম হনহন করে
রক্তের জোর গেছে কমে
এটুকু আস্তে প্রায় কুড়ি মিনিট লেগে যায়
বাতের ব্যথা তার ওপর
মাস্টারমশাই এই নিন আপনার এক মাসের টাকা
টাকা? এখন কেন? আজ তো সবে দশ তারিখ
এইতো এক তারিখে মাইনে দিলে মা?
উনি বলে গেছেন নিখিলকে আর আপনাকে পড়াতে হবে না
আপনি যথাসাধ্য করেছেন এতদিন
ওই নিজের বুদ্ধির দোষে গোল্লায় যাচ্ছে
ওর জন্য ওর বাবা একজন কড়া খাতের
ইয়ং মাস্টার জোগাড় করেছেন
আপনি ভুল বুঝবেন না আপনি বৃদ্ধ হয়েছেন
শরীর চলছে না আপনার এবার বিশ্রাম নেবার সময়
আপনি আসুন
যাই আমি রান্নাঘরে অনেক কাজ পড়ে আছে
টাকাটা পকেট এ নিয়ে নিন মাস্টার মশাই
আসবেন মাঝে মাঝে
মফস্বলের মিল ফ্যাক্টরি এই আধা শহরে নটার বাঁশী বাজছে
মিলের ভোরের শিফটের কর্মীদের এখন টিফিন হল
রাস্তা জুড়ে এখন সাইকেল আর মানুষের ভিড়
কলকাতার অফিস বাবুরা উল্টো মুখে ছুটছেন স্টেশনে
কোলাহল ভিড় মিত্তির পাড়া এখন সরগরম
শুধু একটা খুব চেনা খুব জানা ঘরের ভিতরে কাঠের চেয়ারে বসে অর্ধেন্দু বাবু
সব কোলাহল এর বাইরে
এক আশ্চর্য স্তব্ধতায় থমকে বসে রইলেন তারপর আস্তে করে উঠে দাঁড়ালেন
চা- টা পুরো খাওয়া হয়নি
টাকার নোট গুলোর দিকে তাকালেন
আর তারপর তাকালেন তার
এতদিনের বসার সেই চেয়ার খানার দিকে
দামি শাল কাঠের শৌখিন চেয়ার
এ বাড়ির রুচি আর অর্থের ঝাঁপ লাগা
সেই চেনা চেয়ারটার পিঠে হাত রেখে একটু দাঁড়ালেন
তারপর যেন ছেলে বেলার স্কুলের ফাংশনে আবৃত্তি করছেন এমন ভাবে বলতে লাগলেন
গাছ বুড়ো হয়ে গেলে কাঠ হয়
কাঠের চেয়ার হয় কাঠের খাট হয়
টেবিল হয় কাঠ মানুষের কত কাজে লাগে
মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে
মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে
তিনি না পরের লাইনগুলো ভুলে গেছেন
কিছুতেই মনে আসছে না
বিড়বিড় করতে করতে বারান্দায় চটিতে পা গলিয়ে
মিত্তির পাড়া ছেড়ে ধীর পায়ে বৃদ্ধ অর্ধেন্দু বাবু ফিরে গেলেন
পড়ার ঘরে টেবিলে তখন
আধখাওয়া চায়ের কাপে মাছি বসেছে
পেপার ওয়েট এ চাপা দেওয়া
পাঁচটা দশ টাকার নোট
হাওয়াই কাঁপছে।।

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন