এখনও বৃষ্টির দিনে মনে পড়ে তাকে |
প্রাদেশিক শ্যমলিমা যেই পাংশু সাধারণ্যে ঢাকে,
অমনই সে আসে,
রোখারিক্ত ভাবচ্ছবি অবচ্ছিন্ন স্মৃতির উদ্ভাসে
লাক্ষণিক,—নেত্রসার, কপোলপ্রধান
প্রাক্ প্রচ্ছদ নটী যেন | সঙ্গে-সঙ্গে ঘোচে ব্যবধান
দৃশ্য ও দ্রষ্টার মধ্যে : ভুলে যাই
উত্তরচল্লিশ আমি ; উদ্ গ্রীব হ’য়েও যদি চাই,
তবু গলকম্বলের থর
মুকুরের অধিকাংশ জোড়ে ; নতোদর
লুকায় পায়ের ডগা অধোমুখে কচিৎ তাকালে ;
স্থানবিনিময় করে চাঁদিতে কপালে,
চুলের প্রলেপ ওড়ে নামমাত্র বাতাসে যখন |
বীমাই জীবন
বুঝি বটে, কিন্তু ঠিক মাসে-মাসে কিস্তির যোগান
দিতে গিয়ে বাজারখরচে পড়ে টান
অথচ ডাক্কতারে বলে তন্তুক্ষয়
এ-বয়সে নিতান্ত নিশ্চয় ;
পুষ্টিকর পথ্য বিনা অতএব গত্যন্তর নেই ;
এবং যেকালে আজও রয়েছি বেঁচেই,
তখন কী ক’রে মরি, মৌরসের উচ্ছেদ না হোক,
অন্তত চৌধুরীদের ভদ্রাসনক্রোক
স্বচক্ষে না দেখে :
তাতে যদি দুলালেরা নম্রতা বা কাণ্ডজ্ঞান শেখে ||
বৃষ্টির বিবিক্ত দিনে ভুলি সে- সকলই
এ-বাড়ির অনুমিত গলি
মনে হয় অগ্রণীর পদপার্থী পথ,
যার প্রান্তে মুদ্রিত জগৎ
স্ফুর্তির প্রতীক্ষা করে |
তখন থাকে না মানে—- দিগন্তরে
উচ্ছিষ্ট উঞ্ছের বাটোয়ারা
হিংসার প্রমারা,
স্থগিত মারীর বীজ শস্যশূন্য মাঠে ;
চ’ড়ে বসে নিহত বা নির্বাসিত স্বৈরীদের পাটে
প্রতিদ্বন্দ্বী সর্বেসর্বা যত ; নিরর্থক
পূষার একর্ষি নাম, অসূর্যের পুরাণ ঝলক,
হিরন্ময় পাত্র ঠেলে ফেলে,
দেয় মেলে
অন্ধতম অতিপ্রজ বল্মীকে-বল্মীকে,
বিমানের ব্যূহ চতুর্দিকে,
মাতরিশ্বা পরিভূ কবির কন্ঠশ্বাস |
মূল্যহ্রাস
সর্বত্র সর্বথা
আবশ্যিক, — বোঝে না সে-সোজা কথা
শুধু যার ভূসম্পত্তি আছে ;
উদয়াস্ত ভেবে মরি,—খেয়ে-প’রে নেহাৎ যা বাঁচে
নির্ভয়ে তা খাটাতে পারি না |
অথচ প্রত্যহ শুনি চার্চিলের স্বেচ্ছাচার বিনা
অসাধ্য সাম্রাজ্যরক্ষা, অব্যর্থ প্রলয়,
এবং যে-ব্যক্তিস্বত্ব সভ্যতার সম্মত আশ্রয়,
তারও অব্যাহতি নেই অপখাত থেকে :
একা হিটলারের নিন্দা সাধে আজ বাধে কি বিবেকে ?
কিন্তু তার দিব্য আবির্ভাবে
প্রেতার্ত অভাবে
জাগে যেন প্রজ্ঞাপারমিতার অভয় ;
ক্লেদ-মেদ-খেদের আলয়—
জঘন্য জান্তব দেহে দেশ-কাল-সংকলিত মল
সংসক্ত থাকে না আর ; তন্মাত্রাসম্বল
হয় তনু আচম্বিতে |
নির্বিকার স্বপ্নের নিভৃতে,
বিয়োগান্ত নাটকের উদ্যোগী নায়ক, আমি পাতি
যৌবরাজ্য.— ব্যোমযান, কামান, পদাতি
যে-রাস্ট্রের অঙ্গ নয় ; ন্যায়, ক্ষমা, মিতালি, মনীষা
যার মুখ্য অবলম্ব, জিজীবিষা
সামান্য লক্ষ্মণ ;
শ্বাপদসংকুল নয় যেখানে কানন,
দুরাক্রম্য নয় গিরিচূড়া,
পরিস্রুত সুরা
নিদাঘের অফুরন্ত দিন,
সুবর্ণধারার শষ্পশ্যামল পুলিন
উৎপিঞ্জর তারুণ্যের লাস্যময় লীলায় মুখর,
গন্ধবহসমার্জিত স্বরাট্ অম্বর
দেয় ফিরে
অবরোহী সন্ধ্যার শিশিরে
অনুপূর্ব মানুষের অভ্যুদিত চিত্তের প্রসাদ ;
জয়যুক্ত স্ট্রেসেমান্-ব্রিয়াঁর সংবাদ ||
হয়তো তখনই
উপশয়ী সংবর্তের আড়ালে অশনি
লেলিহান করবালে ধার দিতে শুরু করেছিলো |
প্রবাদের ধুয়ো ধরেছিলো
তত্পূর্বে অন্তত
মুসোলীনি যুদ্ধগামী বর্বরের মতো ;
এবং উদ্বাস্তু ট্রটস্কি ইতিমধ্যে দেশে-দেশান্তরে
ঘুরে মরেছিলো, পুরাকালীন শহরে
গলঘন্ট কুষ্ঠরোগী যত দ্বার সব বন্ধ দেখে
যেমন নির্জনে যেতো ভিক্ষাব্যতিরেকে |
কিন্তু তার
বভ্রু কেশে অন্তগত সবিতার উত্তরাধিকার,
সংহত শরীরে
দ্রাক্ষার সিতাংশু কান্তি, নীলাঞ্জন চোখের গভীরে
তাচ্ছিল্যের দামিনীবিলাস,
গ্যেটে, হোল্ ডার্লিন, রিল্ কে, টমাস মানের উপন্যাস
দেওয়ালের খোপে-খোপে, বাখের সনাটা
ক্লাভিয়েরে, শতায়ু ওকের পাটা
তেজস্ক্রিয় উৎকোণ পটলে ;
বায়ব্য অঞ্চলে
রক্ষিত মঙ্গলদীপ, অনাদি নগরী,
মালা জ’পে, কাটায় শর্বরী
স্বপ্নাবিষ্ট সভ্যতার নিশ্চিন্ত শিয়রে |
লেগেছিলো হাস্যকর স্বভাবত সে-সবের পরে
কূটাগার থেকে দেখা স্বস্তিকলাঞ্ছন
বালখিল্য নাট্ সীদের সমস্বর নামসংকীর্ত্তন
মশালের ধূমার্ত আলোকে :
বরঞ্চ বৃষ্টির দিনে স্তব্ধ শোকে
নির্বাক বিদায়
স্মরণীয় স্বস্থ মর্যাদার ||
অবশ্য বুঝেছি আজ এ-সিদ্বান্ত নিতান্তই মেকি,
কারণ অন্বয়ব্যতিরেকী
সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত,
এবং সে-নিত্যবিপরীত
দ্বন্দ্বসমাসের সঙ্গে তুলনীয় মেরুবিপর্যয়
বিকল্পস্বভাব ক্ষেত্রে | নিঃসংশয়
উপরন্তু এও
বিশ্বামিত্র দস্যুরাই ব্যক্তিনামধেয়
যদিচ প্রাজ্ঞের মতে, তবু ব্যষ্টিসংকল্পের ঝোঁকে
প্রাগুক্ত দোলকে
কখনও বিলম্ব ঘটে, কদাচিৎ দ্রুতি |
তবে কেন ভক্ষোলে প্রতিশ্রুতি ?
বারোটা উত্তীর্ণ, কিন্তু টেলিফোন করে কই লীলা ?
অথচ রঙ্গিলা
নয় সে দীপ্তির মতো ; অন্তত সে জানে
সমাজের ঘুম নেই, শ্রুতি আছে দেওয়ালের কানে ;
গোপন সুযোগ
নিতান্তই দুর্লভ তাই, উপভোগ
পরিণামচিন্তায় ব্যাহত |
তাহলে কি অসময়ে ফিরেছে প্রমথ
নিন্দুকের প্রেরণায় ? এত দিনে সফল নতুবা
সে-বাচাল যুবা
যার পেশা কৃতীর সম্ভ্রমহানি ?
ইচ্ছার সামর্থ্য নেই মানি ;
তথাপি টাকার আজ্ঞা প্রলয়েও লঙ্ঘনীয় নয় :
বন্ধকীর নিলামে বিক্রয়
মারোয়াড়ীদের গ্রাসে তুলে দেয় বাঙালির দায় |
সুতরাং সে মাঝারিবয়সীকে চায়
সে নিশ্চয় প্রকৃতিভিখারী,
নচেৎ, বিকারী ||
বৃথা স্বপ্ন ; সংকল্প অক্ষম ;
মতিভ্রম
বৃষ্টির বিবিক্ত দিনে অসংলগ্ন স্মৃতির সংগ্রহে
কিংবা শুধু মৌখিক বিদ্রোহে
নিঃসঙ্গ জরার আর্তি ভোলার প্রয়াস |
কিন্তু মানবেতিহাসে মাঝে-মাঝে আসে মলমাস,
কর্মচ্যুত পৃথিবী যখন
উম্মার্গ ঘুমের ঘোরে, নাক্ষত্রিক সহযাত্রীগণ
সে-অপচারীকে ভুলে ছোটে লোকাতীতে ;
নির্বাণ নিশীথে
কারারূদ্ধ আয়ুব মিয়াদ,
রোমন্থ বিস্বাদ,
বিষায়িত ভবিষ্যের ধ্যান,
অভিজ্ঞান
শকুন্তের স্পর্শকলুষিত |
প্রমাবিরহিত
অন্ধ বিশ্বাসের বশে তখন মানুষ খোঁজে ফের
অশক্ত বা অসম্পৃক্ত অধিদৈবতের
পুরাতন পদপ্রান্তে সংগতি বা পৈতৃক অমিয়,
কার্যত যদিও
ঐকান্তিক শূন্য তাকে করে বিশ্বম্ভর,
কারণ তখন বায়ু অনিলে মেশে না, অবস্কর
ভস্মান্ত হয় না, অনুব্যবসায়ী ক্রুতু
বোঝে সন্তাপেও ব্যাপ্ত ব্রহ্মাণ্ডের বীতাগ্নি বেপথু |
অন্তর্হিত আজ অন্তর্যামী :
রুষের রহসে লুপ্ত লেনিনের মামি,
হাতুড়িনিষ্পিষ্ট ট্রট্ স্কি, হিটলারের সুহৃদ স্টালিন,
মৃত স্পেন, ম্রিয়মান চীন,
কবন্ধ ফরাসীদেশ | সে এখনও বেঁচে আছে কি না,
তা সুদ্ধ জানি না ||
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন