সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা - এক সন্ধে থেকে মধ্যরাত্রি

লেখক: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


আয় মন বেড়াতে যাবি
কল্পতরু গাছের অভাব নেই, চতুর্দিকেই চারি ফল ছড়ানো
কুড়িয়ে খেলেই তো হয়
কিন্তু মুশকিল হয়েছে দুটি নারীকে নিয়ে
বেড়াতে বেরুলে কক্ষনও দুই রমণীকে সঙ্গে নিতে নেই
রামপ্রসাদ কী ভুলটাই না করেছিলেন
এক নারী একটু গায়ে গা ঠেকিয়েছে না ঠেকায়নি
অমনি অন্যটির মুখ ভার, সরে যাবে দূরে
আবার তাকে কাছে টানতে গেলে সে সজোরে ঠেলে দেয়
নিছক অভিমানে নয়, তার নামই যে নিবৃত্তি
ধর্ম আর অর্থ চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া যায়
কিন্তু কাম তো তা নয়, তার লাগে প্রেম নামে এক ঝাল-মিষ্টি আচার
তখন যে তরুণীটি শরীরিণী হয়, তার নাম প্রবৃত্তি
তার লাস্যে এত মোহ
আমার এই এক জীবনে সেই মোহ থেকেই অতৃপ্তির শোধ হল না
তাই চতুর্থ ফল মোক্ষটোক্ষ নিয়ে মাথাই ঘামানো
হল না কখনও
বিশ্বাস করুন রামপ্রসাদ সেন মশাই
আমার এই লেখাটি এক পলকে পড়ে নিয়ে
হাততালি দিয়েছেন সবুজ রঙের প্রকৃতিদেবী
আপনার মতন সাধকরা তো তাকে চিনলেনই না!


আসলে নেই তেমন কোনও গর্জমান নদী
যদির সঙ্গে মিল দেব না মরে গেলেও, নিরবধি তো নয়ই
ছেলেবেলার ছোট্ট চোখে সবই তো ছিল বৃহৎ
সৃষ্টিরও তো বাল্যকাল, আকাশে পক্ষিরাজ।


আয় রে আয়, ছেলের পাল, খিচুড়ি খেতে যাই
যে-যার চাটাই বগলে নিয়ে পাত পাতব ভাই
আয়রে আয়, ঘণ্টা বাজে, পেটে আগুন খিদে
আমিনা দিদি, লেবু চাই না, একটুখানি ঘি দে!
পোড়া কপাল, ঘি খেয়েছেন, বাপ-দাদারা কবে
তেমন ভাগ্য তোদের ভাগ্যে আর কোনও দিন হবে?
গরম গরম খেয়ে দেখ না, একটু একটু করে
বাঁধাকপির তরকারিটা আসছে একটু পরে।
ছি ছি ছি ছি দিদি রাঁধতে শেখেনি
খিচুড়িতে তেল দেয়নি, তরকারিতে চিনি!
রাঁধতে শিখিনি যে তবু খেলি অনেক হাতা?
আমিনা দিদি, তোমার জন্য স্বর্গে আসন পাতা!


খুল যা সিমসিম, অ্যাবরা ক্যাডাবরা, ছু মন্তর
এই যে দেখে নাও, দরজা খুলে গেছে, গোপন নেই
দেখা ছিল ভালো, চক্ষে ধাঁধা লাগে অসম্ভব
রক্ত মাংসের বাইরে আরও কিছু এত গভীর!

সিঁড়ির পর সিঁড়ি, বাঁকের পর বাঁক, গহন পথ
আলো ও আঁধারির এমন অপরূপ শব্দময়
শব্দ ঢেউ তোলে, শব্দ ছবি আঁকে নিরন্তর
এ কার মহাকাশ, সীমানাহীন সীমা, অলীক নয়!

না দেখা ছিল ভালো, চক্ষে ধাঁধা লাগে, অসম্ভব!


আমাদের গেস্ট হাউজের চাতালে উথালপাথাল করছে
একটা আলকেউটে
মাটি ছেড়ে সিমেন্টে এসে সাপটাই পড়েছে মহা আথান্তরে
আমরা ভয়ে এগুতে পারছি না, সে বেচারিও পালাবার পথ
ভুলে গেছে
কে যেন চেঁচিয়ে বলল, ক্যামেরা, ক্যামেরা।

নিরাপদর ছেলে কালাচাঁদ ফিরে আসছে হাতে দুধের
ঘটি ঝুলিয়ে
ও খোকা, এখন আসিস না, দাঁড়া, দাঁড়া উঠোনে
সাপ দশ বছরের ছেলেটি যে আসলে বদ্ধ কালা তা আমরা
ভুলে গেছি
কিংবা যার মনে আছে, সেও ইচ্ছে করে চ্যাঁচাচ্ছে?
আমার মনে পড়েছিল, কিন্তু আমার হাতে ক্যামেরা, আমার তো
অন্য দায়িত্ব নেবার কথা নয়
নিরাপদ কেন সিগারেট আনতে গিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যেও
ফিরছে না
সব দোষ তার!


শুধু মাঠ, সবুজের ঢেউ, তবু কেন বুক কাঁপে?
জন্মের পর কান্না, তা কি মনে পড়ে যায় অন্য মনস্তাপে
উদ্ভিদের মতো আমি মাথা তুলে উঠেছি এ ভূমি, জলকাদায়
এই বাংলায়
ঝিনুক তোলার জন্য ড়ুবে গেছি অনেক গভীরে
বুলবুলি পাখির ডিম চুরি করে, ফের রেখে এসেছি সে নীড়ে
পুকুরের জলে চাঁদ ড়ুবে যায়, আবার চকিতে ঠিক ভাসে
ঝড়ের সুগন্ধ আমি পেয়েছি যে কতবার পশ্চিমের উড়ন্ত বাতাসে।

সবুজের বুক চেরা হাইওয়ে, গাড়ি থেকে নেমে আমি দাঁড়িয়েছি
একা
কেন চোখে জল আসে, কেন মনে হয়
আমি এই পৃথিবীর কেউ নয়।


শেষ কয়েকটি নিশ্বাস ফেলার আগে
বাবা বললেন, আমি এবার বাড়ি ফিরে যাব
বাড়ি? কোথায় বাড়ি? আমরা থাকি কলকাতায় পাখির বাসায়
ভাড়াটে, লঝঝরে একতলায়
বাড়ি যাকে বলে, সে তো লুপ্ত হয়ে গেছে বহুকাল আগে
সে এখন অন্য দেশ
বাবা কি তবে রূপক অর্থে বলছেন, কিংবা স্বপ্ন দেখছেন স্বর্গের?
এ সময় খুব মেপে মেপে নিশ্বাস খরচ করতে হয়
বাবা অস্ফুট স্বরে বলতে লাগলেন, বড় অশ্বথগাছটার
পাশ দিয়ে রাস্তা
সিধু ধোপর টিনের ঘর, পাটখেত
বারোয়ারি পুকুরের ঘাটে দাঁতন করছেন
চৌধুরীমশাই
গন্ধ লেবুর বাগানের পাশে একটা জম্বুরা গাছ
রান্নাঘরের দাওয়ায় উনুনে পায়েস চাপিয়েছেন মা, মা ঠিক জেনে গেছেন
আমি আজ আসব
এই তো এসে গেছি, মা

এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ স্মৃতি নিয়ে চলে যাওয়াও তো কম সৌভাগ্যের কথা নয়!

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ৬৭ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন