সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা - মেঘলা দিন, মিহিন বাতাসে

লেখক: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রাজ্জাক হাওলাদার, আমার সে গ্রাম সহোদর
বহুকাল পর দেখা, বস্তুত তা কালেরও অতীত
তার জন্মগ্রহণের আগে আমি মাইজপাড়া-ত্যাগী
তবু দেখামাত্র ঠিক রক্তের সম্পর্কে চেনা হল
আমি ঢের বয়ঃজ্যেষ্ঠ, তাই তার কাঁধ ছুঁয়ে উৎকণ্ঠায় বলি
কত দূর থেকে এলি, রাস্তাটা পিচ্ছিল ছিল না তো
পায়ে কি ফুটেছে কাঁটা? মুখ শুকনো, চুলে এত ধুলো
বসে আগে জিরিয়ে নে, তারপর সব কথা হবে।

রাজ্জাক হেসে বলল, দাদা, আপনি ভুল করলেন,
আমি তো আসিনি দূর থেকে, আমি স্বস্থানেই আছি
আপনিই দূর থেকে বহু দূরে, সে দুরত্ব মাপজোক করা
কোনও মানদণ্ডে কিংবা সময়ে সম্ভবপর নয়।
আপনারই পথে বহু বিঘ্ন আর রিপুভয় ছিল
নৌকো ছিল দোলাচলে, অসাবধানে জুতো হারালেন
সে সবই শুনেছি, জানি, সীমান্তের কাঁটাতারে কাঁধ
ছড়ে গিয়ে রক্ত ঝরল, কেউ কেড়ে নিয়েছিল জামা…
এবার আমিও হাসি, আজগুবি গুজব এসব
সীমান্তের কাঁটাতার কখনও দেখিনি, জুতোটাও
হারায়নি, নদীস্রোতে নিজেই দিয়েছি বিসর্জন
রক্ত ঝরেছিল বটে, কাঁধে নয়, বুকের মাঝখানে
সে অন্য কাহিনি, তবে দূরত্বের কথাটা সঠিক
কেউ পৃথিবীর এক প্রান্তে, আমি, ধরা যাক, আছি অন্য পিঠে
কে যে কার থেকে দূরে, এই প্রশ্ন অনন্তকালের
এমনকী কাছাকাছি থেকেও তো দূরত্বের বিষাক্ত নিশ্বাস
টের পাওয়া যায়। কত প্রতিবেশী, পিঠোপিঠি রয়েছে মানুষ
নিতান্ত অচেনা হয়ে, অথবা কখনও মুখোমুখি হলে পরস্পর
তুলেছে সর্পিল ছুরি, পাশাপাশি গ্রাম পুড়ে যায়,
বাল্যের খেলার সঙ্গী স্বার্থপর উত্তর-বয়সে
একে অপরের রক্ত গায়ে মাখে, বিভেদের কত না ছলনা
কখনও ভূমি বা নারী, কিংবা ধর্ম, দুনিয়ার এখানে ওখানে
পবিত্র ধর্মের নামে কত ঘৃণা, ধর্মের মহিমা
পৃথিবীর ধুলো মেখে কখনও বারুদ হয়, কখনও কালের
সিংহ থাবা! যারা স্বর্গ চেয়েছিল, তারা দেয় ভুল আত্মাহুতি
যারা স্বর্গ চেয়েছিল, তারাই তো খুলে দেয় নরকের দ্বার।

রাজ্জাক আমাকে বলল, দাদা ওই সমস্ত কথা, এখন রাখেন
মানুষের ইতিহাস ভরাই যে কত মিথ্যা, আপনি তো জানেনই
আমিও তা জানি কিছু কিছু। এই সভ্যতায় একদিক সাদা
অন্যদিক বড় বেশি ভয়ংকর কালো৷ তবু দেখেন না আকাশে বিদ্যুৎ
পথ ভুলে অন্ধকারে একা একা কানামাছি, অকস্মাৎ যার
গায়ে হাত ঠেকে, দেখি আলোর ঝলকে সে-ই একান্ত আপন
সে ভাবেই পেয়ে গেছি আপনাকে, অথবা আপনিই বুঝি আমাকে ছুঁলেন!
নদীর দুপারে দুই মানুষ খাড়ানো, মেঘলা দিন, মিহিন বাতাসে
মনে পড়ে, এক কালে এই নদী, আড়িয়াল খাঁ, বাপরে কী দুরন্ত
ক্ষুধার্তই না ছিল!

মনে পড়ে? ইলিশের নৌকাগুলি ঘাটে এসে ভেড়ে
আমরা দুইজন পাশাপাশি।

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ৭৭ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন