প্রেমাংশুর রক্ত চাই

নির্মলেন্দু গুণ নির্মলেন্দু গুণ

নিষিদ্ধ ভুবনগুলি অতিক্রম করে গেলো যারা,
রাতের আঁধার ছিঁড়ে ছিঁড়ে যে ক্রুদ্ধ জীবন জনতা
অতিক্রম করে গেল বাধা, অথবা অতিক্রমণের মুখে
যারা রোজ বাঁধা পড়ে,
সেইদিনও বাঁধা পড়েছিল, এবং আগামী রাতেও
বিদ্ধ হবে যারা; বকনের মতো কাচা রমনীর প্রেম ভুলে গিয়ে–
ভালোবাসা, আনন্দের অভিলাষ মিথ্যে ধরে নিয়ে
যারা রোজ সমর্পিত, বন্দী হয় বিরুদ্ধ-খোঁয়াড়ে,
সাজিয়ে সুরের সাথে মনের আঁধার প্রতিদিন :
–আমি একা রমণীকে ভালোবেসে-বেসে নিজেরি মুদ্রাদোষে
নিঃসঙ্গ বৃক্ষের মতো রাত্রিদিন আলাদা হলেও
ছিলাম নদীর মতোই সমর্পিত সাগর মিছিলে সেইদিন।
তারও আগে বহুদিন–, সেইসব মানুষের সাথে,
তাহাদেরই সাথে প্রতিদিন আমিও রয়েছি মিশে,
ছিলাম সেদিনও; এই পৃথিবীর, এই মানুষের
এই বাঙলার সূর্যমুখর শিশিরের প্রতিবাদে।

আমাকে থাকতে হতো, আমাকে থাকতে হয়,
আমাকে থাকতে হবে, আমাকে থাকতেই হবে
লালশালুঘেরা স্টেজে, বক্তৃতায়, পল্টনের
মাউথ-অর্গানে, গণসঙ্গীতের নির্যাতিত রাতে।
মারমুখো অন্যায়ের রাহুগ্রাসে আমাকেও দিতে হবে
প্রতিবাদে নৃশংস আগুন। লাঙ্গলের লাল ফালে,
বাস-ট্যাক্সি-লরীর আগুনে, হাসপাতালের উর্বর বেডে,
ইমার্জেন্সির নিমর্ম শয্যায়, মানুষের মৃত্যু-যন্ত্রণায়,
অনুর্বর বিমুখ ফাগুনে –আমাকে থাকতে হবে,
আমাকে থাকতে হয় এইসব মানুষের যেকোন আগুনে।

মানুষের কোলাহল ঘৃণা করে
জনতার চিৎকার থেকে দূরে, বহু দূরে
নিজেরি গোপন-ভ্রূণে কতবার হয়েছি শহীদ,
টোপে-গাঁথা মৎস্যের মতো একাকী রমণে কত
করেছি নিহত রাত্রিদিন অন্ধকারে শুধু রমণীকে।
এনেছি আকাশ থেকে নীলিমার পাপ,
আর প্রাচুর্য বিশ্বাস, তবু কোনো কল্যাণী নিঃশ্বাস
বিনিময়ে দিয়েছি কি কেউ?
কোনো কিছুতেই কোনোদিন কেউ কিছু
দেবে না জেনেও কতবার ভেবেছি একাকী
বাড়ির পাশের রোগা নদীটির কাছে বসে বসে :
–মানুষ যেমন একা, অসহায় নিজের কাছেই
একদিন যদি ধরে পড়ে যায় সে তখন কোন অজুহাতে,
কার নামে চোখ থেকে ফেরাবে মৃত্যুকে?
মানুষ কী করে পারে জীবন এবং মৃত্যুর মহিমাকে
রক্ত থেকে অস্বীকার করে শেফালির মৃতদেহ
কাঁধে নিয়ে মিছিলে দাঁড়াতে?

বহুদিন আসক্তিকে আরাধনা ভেবে
নীলিমার সারা দেহ সাজায়েছি মাধবীর স্তনে,
আর ঠিক সেইক্ষণে, বাইরে যখন
মানুষ এগিয়ে গেলো মানুষের দিকে–
(মানুষ এগিয়ে যাবে চিরকাল মানুষের দিকে?)
বন্দুক শোনালো তার অন্তিমের গান,
আগুন জানালো তার সর্বগ্রাসী ধ্বংসের আহ্বান
এ্যাম্বুলেন্সের নীল হাসপাতাল
চলে এলো মৃত্যুর প্রতিরোধে, পথের বালক
যখন মৃত্যু-চিৎকারে আকাশে চৌচির হলো ফেটে,
কাঁদানে গ্যাসের সাথে থেকে-থেকে
মানুষের শান্ত চোখগুলো
যখন টকটকে লাল হলো ফুলের মতন
–আমি তো তখন মৃত্যু, আলিঙ্গন তুচ্ছ মনে করে
ডিমের খোলশ ভেঙে পাখির মতন
রাজপথে বেরিয়ে এসেছি, যেখানে মানুষ তার
জীবনের সব প্রাপ্য এসেছে মেটাতে।

মানুষ যেদিন সঙ্গীতের মিহিসুর ভুলে গিয়ে
প্লাবনের কল্লোল দেখে প্রলয়ের চিৎকার দিয়েছিল,
অথবা মানুষ যখন নিছক বর্ষণে
ভিজে-ভিজে হয়েছিল কাক,
সেদিন আমিও ছিলাম;
মানুষের সাথে মিশে আমিও সেদিন
আটটি ফুঁটোর বাঁশি, উচ্চাঙ্গের অবোধ্য সেতার
ভেঙেছি নির্জন রাতে দু’পায়ের চাপে,
সার্ট খুলে বুকে করে নিয়েছি বৃষ্টিকে
–এবং বুঝেছি হয় চিৎকার কখনও সঙ্গীত।
আমিও তো তোমাদেরই মতো প্রতিবাদে বলেছি তখন,
‘প্রেমাংশুর বুকের রক্ত চাই, হন্তার সাথে আপোস কখনো নাই।’
বুকের বোতাম খুলে প্রেমাংশুকে বলিনি কি—‘দেখো,
আমার সাহসগুলি কেমন সতেজ বৃক্ষ–,
বাড়ির পাশের রোগা নদীটির নীল জল থেকে
প্রতিদিন তুলে আনে লাল বিস্ফোরণ?’
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ৫৬ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন