অর্ঘ্যদীপ চক্রবর্তী

গল্প - ব্রহ্মদৈত্যর আশীর্বাদ

লেখক: অর্ঘ্যদীপ চক্রবর্তী
প্রকাশ - বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই ২০২৪ ধরণ: ভৌতিক

আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা বলছি।
তখন আমাদের অজয়পুর ছিল একেবারে অজ পাড়া গাঁ। গ্ৰামের বাড়িগুলি কম করে হলেও একশো দুশো মিটার অন্তর ছিল। গ্ৰামে একটাই মাত্র উচ্চমাধ্যমিক স্কুল ছিল। সেখানে প্রথম শ্রেণি থেকেই পড়াশোনা চলত।গ্ৰামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে হীরামতি নদী।এই নদীর পাশেই সপ্তাহে তিনবার হাট বসত।গ্ৰামে কোনো ডাক্তারখানা ছিল না।তবে দুই ঘর বৈদ্য বাস করত।ব্যস এই নিয়ে আমাদের গ্ৰাম গড়ে উঠেছিল।গ্ৰাম থেকে একুশ কিমি দূরে ভীমনগর শহর অবস্থিত। সেখানে হাসপাতাল কলেজ সবই আছে।

তবে বর্তমানে আর সেই আগের মতো গ্ৰাম নেই।অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন উচ্চমাধ্যমিক স্কুল ছাড়াও দুটো প্রাথমিক স্কুল গড়ে উঠেছে। এখন একটা ছোটো বাজার গড়ে উঠেছে নদীর ধারে সেই জায়গায় যেখানে আগে তিনবার হাট বসত। যদিও এখন আর হাট বসে না।গ্ৰামে বসতি আরও বেড়ে গেছে।এছাড়াও গ্ৰামে একটা বড়ো স্বাস্থ্যকেন্দ্র হয়েছে।

আমি বর্তমানে একজন অবসরপ্রাপ্ত চাকুরিজীবী।কলকাতায় পরিবার নিয়ে থাকি কারণ, কালকাতাতেই একটা প্রাইভেট সংস্থায় কাজ করতাম। বাবা মাকে আসতে বলেছিলাম, আমার কাছে থাকার কথাও বলেছিলাম, কিন্তু তাঁরা আসতে চাননি। তাঁরা গ্ৰামেই থেকে গেছেন।তাই চাকরি থেকে যখনই ছুটি পাই তখনই বাবা মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আসি পরিবার নিয়ে।

আজও যখন সেই দিনের কথাটা ভাবি তখন সারা শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। শরীরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়।

যাই হোক যে সময়ের কথা বলছি তখন আমার বয়স একুশ কি বাইশ বছর। নিজের গুণের কথা নিজের মুখে প্রচার করতে নেই তবু বলছি কিশোর বয়সে আমি অন্যের বিপদে আপদে এগিয়ে যেতাম। পাশে দাঁড়াতাম।যতটা সম্ভব সাহায্য করতাম। যেমন কারও অসুখ করলে শহরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো ইত্যাদি।

সেদিনটা ছিল ভাদ্র মাসের কোনো এক দিন। দীর্ঘ এক সপ্তাহ ধরে আমাদের গ্ৰামের হারাধন মুখোপাধ্যায় পেটের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। হারাধনবাবুর কোনো সন্তান নেই যদিও বিয়ে করেছিলেন। ক্ষেতে ফসল ফলিয়ে তা হাটে বিক্রি করে যা রোজগার হত তাতেই কোনোরকমে দিন কাটাতেন। বয়স আন্দাজ চল্লিশ পঞ্চাশের কাছাকাছি।আগেই বলেছি আমাদের গ্ৰামে দুজন বৈদ্য বাস করতেন। তো তাঁরা অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ করতে পারলেন না। তাঁরা দেখলেন যে ব্যথাটা রাতের দিকে বাড়ে কিন্তু সকাল বেলায় কম থাকে।এভাবে চলতে চলতে তাঁরা হাল ছেড়ে দিলেন। আটদিনের মাথায় হারাধনবাবুর পেটের ব্যথা আরও বাড়ল। দিনের বেলাটা কোনোরকমে কাটল। কিন্তু রাতের বেলায় একেবারে যন্ত্রনায় ছটফট করতে শুরু করলেন। অনেকটা কাটা ছাগলের মতো। তাঁর ঐ অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগল।তাই আমি উদ্যোগী হয়ে সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ সালেমচাচার রিক্সায় করে হারাধনবাবুকে সঙ্গে নিয়ে শহরের হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।শহরে যেতে ঘন্টা চারেক তো লাগবেই সেই ভেবে তাড়াতাড়ি রওনা হলাম। আর তাছাড়া গ্ৰামের মেঠো পথ তার উপর এবড়োখেবড়ো।তাই যেতে সময় লাগবেই।

পূর্ণিমার রাত ছিল। তাই সঙ্গে কোনো হারিকেন বা টর্চ নিলাম না।গ্ৰামের মাঠ, বন, মেঠো রাস্তা পূর্ণিমার আলোয় যেন এক মায়াবী ভৌতিক পরিবেশ গড়ে তুলেছিল। সেই আলোয় পথ চলতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না।
হারাধনবাবুর ছটফটানি ভাবটা তখন কিছুটা কমেছিল। তিনি মাথা নিচু করে বসেছিলেন পেটে হাত দিয়ে। মুখ থেকে একটাও কথা বলছিলেন না।

প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ঐভাবে চললাম। শহরে ঢোকার আগে বেলবাগান পেরোতে হয়।এই বেলবাগান মেঠো পথের দুই পাশে অবস্থিত। কিন্তু এমন চাঁদোয়ার মতো পথ ঢেকে রাখে যে দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো ঠিকঠাক ঢুকত না।
এই বাগান যেই পেরোতে শুরু করলাম তখনই যেন দুনিয়ার সব ফুল, চন্দন, সুগন্ধি ধূপ ধূনোর গন্ধ আমার নাকে আসতে লাগল। আমি কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলাম। সালেমচাচাকে জিজ্ঞেস করলাম যে গন্ধ পাচ্ছে কিনা।চাচা বলল, হ্যাঁ।
মনে মনে ভাবলাম আমি তো কতবার এই পথে রাতের বেলায় সকাল বেলায় গেছি এসেছি কোনোদিন তো এমন গন্ধ পাইনি। সারাটা পথ আমি হারাধনবাবুর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম।
হঠাৎ দেখি তিনি কেমন যেন কাঁপছেন। আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, “হারাধনবাবু কী হল আপনার? এমন কাঁপছেন কেন?”
এতটা পথ যে এলাম তিনি কোনো কথা বলেননি। স্বাভাবিকভাবেই পেট ব্যথার কারণে। কিন্তু তখন হঠাৎ বলে উঠলেন, “বাবা আমার পেট ব্যথা আর নেই।”
আমি আর চাচা দুজনেই একসাথে বললাম, “অ্যাঁ? কী বলছেন?”
আমি বললাম, “আপনার… আপনার পেট ব্যথা আর করছে না?
হারাধনবাবু বললেন, “না গো বাবা।”
জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, আপনি কোনো গন্ধ পাচ্ছেন? মানে ফুল ধূপের?”
উনি বললেন, “হ্যাঁ পাচ্ছি।”
তখনও বেলবাগান পুরোটা পেরোইনি। আমি অবাক হয়ে গেলাম।
এখানে একটা কথা বলা ভালো। এর আগে আমি এমন কোনো পরিস্থিতিতে আগে কখনও পরিনি। এমন অলৌকিক ঘটনার কথা গল্পের বইতে ঢের পড়েছি।বাস্তবে এই প্রথম এমন কোনো ঘটনার মুখোমুখি হলাম। তাই সত্যি যে ভয় লাগছিল না একথা বলতে পারি না।
এতটা পথ এলাম। যন্ত্রনায় যে মানুষটা কথা বলতে পারছিল না সে এই বেলবাগান পার করার সময় হঠাৎ সুস্থ হয়ে গেল? কথা বলতে পারল? আমি এসব নিজের মনেই ভেবে চললাম। কিন্তু প্রকাশ করলাম না।
আমি আবার ভাবতে শুরু করলাম যা ঘটছে তা কি আদৌ ঘটছে নাকি আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি? এই ভেবে নিজের হাতে একটা চিমটি কাটলাম। লাগল। তার মানে পুরাটাই সত্যি!
গন্ধ তখনও পাচ্ছি। আমি বললাম, “তবু আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব।এতটা পথ এসেছি আর শেষে যদি নাই যাই তাহলে পুরো পরিশ্রমটাই জলে যাবে।আর আপনার পেটে ব্যথা এখন সেরে গেলেও পরে তো আবার দেখা দিতে পারে।”
হারাধনবাবু বললেন, “না গো বাবা। আর হবে না। আমি বলছি শোনো।”
সালেমচাচা বললেন,”না না ছোটোবাবু ঠিকই বলেছে,চলুন যাই হাসপাতালে‌।”
এইসব কথা বলতে বলতে আমরা বেলবাগান পার করলাম। বেলবাগান পার করার সাথে সাথে গন্ধও মিলিয়ে গেল।

শহরের বড়ো রাস্তায় যখন এলাম তখন রাত কত হবে? ন’টা কি দশটা। আরও আধঘন্টা যাওয়ার পর হাসপাতালে পৌঁছলাম। তখন হারাধনবাবু পুরোপুরি সুস্থ। তাঁর চোখ মুখ বলে দিচ্ছে।
ডাক্তারবাবুর কাছে গেলাম।
উনি বললেন, “কী হয়েছে রোগীর?”
আমি সব কথা জানালাম। পথে আসার সময় শুধু বললাম না বেলবাগানে ধূপ ধুনোর গন্ধের কথা। কী জানি শহুরে মানুষেরা হয়ত এসব আজগুবি কথা বিশ্বাস করবে না।
ডাক্তারবাবু সব শুনে বললেন, “পথে আসতে আসতেই রোগ সেরে গেছে?
বাবা! আমার চাকরি জীবনে এই প্রথম এমন কোনো রোগীকে দেখলাম।”
ডাক্তারবাবু বললেন, “ঠিকাছে আমি তবুও ওনার পেট টিপে দেখে জিজ্ঞেস করছি পেটের কোথায় ব্যথা করছিল।”
ডাক্তারবাবু যেই হারাধনবাবুর পেটের জামাটা সরাতে যাচ্ছিলেন হঠাৎ বললেন, “একী জামায় এত ধুলো কোথা থেকে এল? আর জামার গায়ে এসব কী? কিসের যেন লম্বা লম্বা ছাপ বলে মনে হচ্ছে।”
আবার বললেন, “দেখি আপনি পিছনে ঘুরে বসুন তো।”
হারাধনবাবু তাই করলেন।
ডাক্তারবাবু বললেন, “লম্বা লম্বা ছাপ তো জামার পিছনের দিকেও আছে। তারমানে সারা জামাতেই এই ধরনের ছাপ!”
আমি আর সালেমচাচা দেখলাম। আচ্ছা, এতটা পথ যে এলাম তখন দেখিনি তো, হয়তো লক্ষ্য করিনি।
ডাক্তারবাবু বললেন, “রোগীর জামায় এইরকম ছাপ এলো কোথা থেকে? এগুলো তো কোনো জুতোর ছাপ মনে হচ্ছে।”
আমি ও সালেমচাচা একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছি। দুজনেই আবাক‌।দেখলাম হারাধনবাবুও কেমন অবাক হয়ে গেছেন।
আমি বললাম, “বুঝতে পারছি না ডাক্তারবাবু হয়তো জামাটায় আগে থেকেই ঐরকম ছাপ ছিল।”
ডাক্তারবাবু বললেন, “কিন্তু দেখুন এই ধরনের জুতোর ছাপ তো আমার আপনার পায়ের জুতোর মতো নয়। আমি যদি ভুল না বলি তাহলে এটা কোনো খরমের ছাপ। মানে জামার উপর দিয়ে খরম পায়ে কেউ হেঁটে গেছে?”
আমি আর চাচা ফের একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম। আমাদের দুজনের চোখই বিস্ফারিত।
আমি হারাধনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন তখন দেখেছিলেন কি জামায় এইরকম ছাপ রয়েছে?
এবার হারাধনবাবু বললেন, “কই না তো আমি একরকম কোনো ছাপ দেখিনি। জামাটা একদম নতুন। ট্রাঙ্ক থেকে বার করে পরেছি।”
ফের আমি আর চাচা একসাথে বললাম, “দেখেননি?”

আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আমরা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পরলাম।রিক্সায় যেতে যেতে ভাবছিলাম শুনেছি বেলগাছে নাকি ব্রহ্মদৈত্য থাকেন। ডাক্তারবাবুর কথা যদি সত্যিই হয় তাহলে খরম তো তাঁর পায়েই থাকা উচিত।তিনিই তাহলে শেষ অব্দি হারাধনবাবুকে রক্ষা করলেন? তিনি হারাধনবাবুর উপর দিয়ে হেঁটে গেছেন? এও সম্ভব? আমার পাশেই বসেছিলেন অথচ আমি কিছু দেখতে পেলাম না!
কিন্তু তিনি দেখা দিলেন না কেন? এও শুনেছি তাঁর রূপ নাকি অনেক ভয়ংকর। জানতাম ভগবান মনের কথা বুঝতে পারেন। কিন্তু আজ থেকে ধারণা হলো ভূত প্রেতও মনের কথা জানতে বুঝতে পারে।
হয়ত ব্রহ্মদৈত্য বুঝেছিলেন যে আমরা ভয় পেয়ে যাবো তাই দেখা দেননি। কিন্তু তাঁর আশীর্বাদেই সুস্থ হলেন হারাধনবাবু। তাঁর আশীর্বাদেই আমরা উপকৃত হলাম।কী অবাক কান্ড না? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে গ্ৰামে ফিরে সবাইকে কী বলব, ডাক্তারবাবু রোগ সারাননি? ব্রহ্মদৈত্যর কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে?

১৫/১০/২০২৩

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ১৯ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন