শংকর ব্রহ্ম

গল্প - গল্প হলেও সত্যি – প্রথম পর্ব

শংকর ব্রহ্ম
মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪ জীবনবাদী

গল্প হলেও সত্যি – প্রথম পর্ব
শংকর ব্রহ্ম

প্রথম পর্ব

পরিচারিকা থেকে লেখিকা
বেবী হালদার

শংকর ব্রহ্ম

১৯৭৩ সালে কাশ্মীর উপত্যকায় জন্ম হয় এক বাঙালি কন্যার। সেনাকর্মী মদ্যপ বাবার প্রতিদিনের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচবার জন্য, মা তার দুই সন্তানকে নিয়ে চলে আসেন মামার বাড়ি মুর্শিদাবাদ। বড় মেয়েটির বযস তখন চার বছর। মা আবারও বিয়ে করেন, মেয়েরা বড় হতে থাকে সৎ বাবার সংসারে। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় আচমকাই শেষ হয়ে যায় বেবীর (বড় মেয়েটি) মেয়েবেলা।
একটা বাচ্চা মেয়ের যখন ফ্রক পরে খেলাধুলো করার কথা, তখন তাকে বসিয়ে দেওয়া হয় বিয়ের পিঁড়িতে। শেষ হয়ে যায় তার শৈশব। শৈশবে খেলার মাঝখান থেকে তাকে মণ্ডপে উঠিয়ে এনে একটা লোকের পাশে বসিয়ে দেওয়া হয়। কিছুই বুঝতে পারছিল না মেয়েটা, ভেবেছিল বোধহয় কোনো পুজো হচ্ছে। তারপর তাকে বলা হল যে ওই লোকটার সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেছে। তাকে চলে যেতে হবে লোকটির সঙ্গে। তখন মেয়েটির বয়স মাত্র ১২ বছর,স্বামীর বয়স ২৬ বছর।

বিয়ের প্রথম রাত থেকেই শুরু হয় মেয়েটির উপর অত্যাচার। পতি দেবতাটির ধারণা বউয়ের তো দুটোই কাজ, সন্তান ধারণ আর রান্না করা। কুড়ি বছর বয়সের মধ্যে মেয়েটি তিন সন্তানের জন্ম দেয়। তখনই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সন্তানদের জীবন তার জীবনের মতো হতে দেবে না।
১৯৯৯ সালে, ২৫ বছর বয়সে মেয়েটি তার মা আর তিন সন্তানকে নিয়ে দিল্লীগামী একটি ট্রেনে উঠে বসে।
দিল্লিতে এসে সে বিভিন্ন বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতে শুরু করে। একে অল্প বয়স তার ওপরে কোন গার্জেন নেই, কাজের জায়গা থেকেই নানা রকম কুপ্রস্তাব আসতে থাকে। সে’কারণে, নানা বাড়ি ঘুরে শেষপর্যন্ত সে কাজ পেলো প্রবোধ কুমারের বাড়িতে । অধ্যাপক প্রবোধ কুমার ছিলেন মুন্সী প্রেমচন্দের নাতি।

বইয়ের তাক ঝাড়পোঁছ করতে গিয়ে মেয়েটি মাঝেই মাঝেই তাক থেকে পেড়ে আনতো বই। কিছুক্ষণ বইয়ের পাতার ওপর চোখ বুলিয়ে আবার রেখে দিতো তাকের উপর যথাস্থানে।
এই ঘটনা চোখ পড়ে গৃহকর্তা প্রবোধ বাবুর, যাকে বেবী তাতুস বলে ডাকতো । শব্দটির অর্থ বাবা, তিনিই তাকে এ নামে ডাকতে বলেছিলেন । একদিন তিনি তার হাতে তুলে দেন তসলিমার লেখা ‘আমার মেয়েবেলা’।
“বইটা পড়ে আমার খুব ভালো লেগেছিল। মনে হয়েছিল, যেন আমার কথাই এখানে লেখা আছে,” বলছিলো সেই কাজের মেয়েটা বেবী।
এর কিছুদিন পর, দক্ষিণ ভারত ভ্রমণে যাওয়ার আগে, নিজের ড্রয়ার থেকে প্রবোধ কুমার তাকে একটা ডায়েরি আর পেন দিয়ে যান। বলেন, তাতে তার মনের কথা লিখতে। মেয়েটি তো হতবাক, কী নিয়ে লিখবে সে!
লিখলো তাঁর হারানো শৈশবের কথা, লিখলো তাঁর প্রথম সঙ্গমের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা, লিখলো তেরো বছর বয়সের প্রসব যন্ত্রণার কথা, লিখলো বছরের পর বছর ধরে নির্যাতনের ফলে শরীরে ফুটে ওঠা ক্ষত চিহ্নের কথা। লিখতে লিখতে মনে পড়ে গেলো, বোনের স্বামীর বোনের গলা টিপে ধরার আতঙ্কময় স্মৃতির কথা। তাও লিখলো বেবী ডাইরীতে।
প্রথম দিকে বানান, আর ব্যাকরণ নিয়ে বেশ সমস্যা হচ্ছিলো। পরে একটু একটু করে তা ঠিক হয়ে গেল। আরো লিখতে থাকলো সে।
বেবী পরে বলছে, “যত লিখতাম, ততই ভালো লাগতো। মনে হত যেন অনেক দিনের কোনো ভার আমার বুকের ওপর থেকে নেমে যাচ্ছে।”
প্রবোধ কুমার ফিরে এসে দেখলেন, একশো পাতার বেশি লেখা হয়ে গেছে!
প্রথম বার পড়ে কেঁদে ফেলেছিলেন প্রবোধ বাবু। যে সমস্ত সাহিত্য-অনুরাগীদের লেখাটি দেখিয়েছিলেন তিনি, তাঁরা অনেকে অ্যান ফ্রাঙ্কের ডায়েরির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন এই লেখাটির।
তারপর সেই লেখা নিয়ে প্রবোধ বাবু বহু প্রকাশকের দোরে দোরে ঘুরলেন। অনেকেই নাকচ করে দেওয়ার পর, শেষ অব্দি কলকাতার একটা ছোট প্রকাশনী “রোশনি পাবলিশার্স ” সেই লেখাটি বই আকারে ছাপতে রাজি হয়।‌
এটাই (তার) বেবী হালদারের প্রথম বই – “আলো আঁধারি।”

তারপরের ঘটনা –

“একদিন একটা বই দেখিয়ে তাতুস আমাকে বললেন, ‘এটা তোমার বই। তুমি এটা লিখেছ।’ ছাপা বই আমার সামনে হাজির! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না!”

ঝাড়ুদার থেকে পরিচারিকা,পাশের বাড়ির অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা থেকে আধুনিকা কলেজ পড়ুয়া, বেবী হালদারের কাহিনী তাদের সকলকেই নাড়া দিয়েছিল।
বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ঊর্বশী বুটালিয়া। ২০০৬ সালে বইটি বেস্ট সেলার তালিকার অন্তর্ভুত হয়েছিল।
তারপর বইটি একুশটি আঞ্চলিক ভাষায় এবং তেরোটি বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
আরও দুটি বই লিখেছেন বেবী হালদার। লেখা তাকে দিয়েছে আত্মপরিচয়, যা আগে কখনোই তার ছিলই না ।
অর্থনৈতিক ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মত অবস্থায় পৌঁছে বেবী তাঁর তিন সন্তানকে (সুবোধ, তাপস, পিয়া) নিয়ে কলকাতায় থাকতে আরম্ভ করেছে।
বেবী হালদার বলেছে, “এখন আমি বিশ্বাস করি, মানুষ সব পারে। আগে আমি পরিচারিকা ছিলাম। এখন আমি লেখিকা। আমি সবাইকে এটাই বলি যে, শুরুটা যে কোনো সময়েই করা যায়।” ‌

১৩০
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন