শীতের ঝরা পাতা
শংকর ব্রহ্ম
কয়েক দিনের জন্য অফিসের কাজে জলপাইগুড়ি যাচ্ছিলাম। আমার উল্টোদিকে বসে এক ভদ্রলোক। ভদ্রলোককে দেখে সম্ভ্রান্ত মনেহল। কত বয়স তার, দেখে তা মোটেও বোঝা যায়নি। যাচ্ছিলেন শিলিগুড়ি ছেলের কাছে আগেই থেকেই কথা বলে, এ কথা জেনেছিলাম তার কাছে। পরণে তার ধুতি পাঞ্জাবি, গায়ে জহর কোট, কম্বলটাকে পায়ের উপর রেখে বাবু হয়ে বসে, অন্ধকারে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন আনমনাভাবে।
রাত বারোটা বাজে, যাত্রীরা প্রায় সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি চাদরটাকে গায়ে জড়িয়ে মোবাইলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন ঠান্ডা পড়েছে ?
বললাম, হ্যাঁ একটু লাগছে বটে। ভদ্রলোক বললেন এক্ষুনি কফিওয়ালা উঠবে একটু কফি খেয়ে নাও দেখবে ভালো লাগবে । ঠিক তাই হলো। দু’জন কফিঅলা ট্রেনে উঠলো। দ্বিতীয় জনের কাছ থেকে আমরা দুজনেই এককাপ করে কফি নিয়ে বসলাম।
কফিতে চুমুক দিয়ে, ধীরে ধীরে তিনি বললেন,
– কোথায় থাকো ?
– কলকাতা গড়িয়ায়।
– কি করো?
– একটা ছোট কোম্পানিতে চাকরি চাকরি করি।
– সন্তান কটি ?
– একটি মাত্র ছেলে
– কিসে পড়ে সে?
– প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
– বেশ বেশ।
কথায় কথায় তিনি জানালেন, তিনি একজন কবি। কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটলো, কফি শেষ। তারপর তিনি আমায় শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন লাগছে জীবনের স্বাদ?
আমি যে কি বলবো, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না ।
তিনি আমায় আস্বস্ত করে বললেন, আমি জানতে চাইছি জীবনটাকে তেতো না মিষ্টি লাগছে?
আমি হাসতে হাসতে বললাম টক ঝাল তেতো …
সকালে দশটায় অফিস, তারপর ফিরতে ফিরতে সেই রাত আটটা। বাকি সময়টুকু হয় আমার সঙ্গে বউয়ের ঝামেলা। না হয়, ছেলের সাথে তার মায়ের …
– সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি কর কেন?
– হোম ওয়ার্ক করোনি কেন ?
– খাবার কেন থালায় পড়ে আছে এখনও?
– স্কুল ব্যাগ কেন গোছাওনি ?
– বইগুলো ঠিক জায়গায় নেই কেন ?
– পা না ধুয়ে খাটে উঠেছ কেন?
– বিছানার চাদরটা এ’রকম দলা-মোচড়া করেছো কেন?
– আর কত টিভি দেখবে ?
একটা না একটা বিষয় নিয়ে লেগেই আছে , মাঝে মাঝে অতিষ্ট হয়ে মেজাজ যায় খারাপ হয়ে, তখন ভাবি এ কোন নরকে আছি? এক একবার মনেহয় যাই সব ছেড়ে-ছুড়ে অন্য কোথাও চলে।
ভদ্রলোক সব শুনে, ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কম্বলটি বুকের উপর টেনে নিয়ে বললেন, এটাই তোমার জীবনের সবচেয়ে সেরা সুন্দর সময় কাটছে …এটাকে উপেক্ষা কোরো না …. টক ঝাল মিষ্টির এই অতুলনীয় স্বাদটাকে কব্জি ডুবিয়ে চেটেপুটে উপভোগ করে নাও।
একটা সময় আসবে যখন ঘরে ঢুকে দেখবে চারিদিক ফাঁকা, নিঃশব্দ, বিছানার চাদরটা টান টান করে পাতা , মা-ছেলের যুদ্ধ চিরতরে কোথায় হারিয়ে গেছে, কোনও এক অলৌকিক মায়াজালে, বইয়ের তাকটা পরিপাটি করে সাজানো। হালকা সাদা ধুলোর আস্তরণ বইগুলোতে লেগে আছে, সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিন্তু চারিদিকটায় শুধু ধূ ধূ মরুভূমির মতো শূন্যতা।
বাড়ি থেকে বেরোবার সময় পেছনে থেকে কেউ নাড়বে না আদুল হাতের টাটা, কেউ বলবে না,তাড়াতাড়ি ফিরো কিন্তু….
থেকে থেকে একটু একটু করে গড়ে তোলা সব স্বপ্ন যাবে কোথায় হারিয়ে।
দৃষ্টি শক্তি ধীরে ধীরে কমে আসবে, বাড়বে শুধু ওষুধের সংখ্যা, অনিদ্রায় চোখ দুটো কড়কড় করে উঠবে। তবু ঘুম আসবে না।
ভদ্রলোকটির প্রতিটি কথা ট্রেনের বিকট আওয়াজের সঙ্গে তাল রেখে যেন বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটছিল কেউ।
আমি অসহায়ভাবে বললাম তাহলে উপায়?
ভদ্রলোক তখন একটু ধরা গলায় বললেন,
শীতের ঝরা পাতার মতো যদি ঝরে পড়ো, তখন কেউ আর তোমায় মনে রাখবে না।
তাই সবুজ থাকতে থাকতে সবকিছু উপভোগ করে নাও। যাতে পরে আর তার জন্য কোন আপসোস করতে না হয়।
প্রায় ত্রিশ বছর আগের ঘটনা এটা। আমি এখন অবসরপ্রাপ্ত। স্ত্রী গত হয়েছেন দু’বছর আগে।
ছেলে ব্যাঙ্গালরে চাকরি করে। আমি বড় একা এখন।
ভদ্রলোকের কথা আজ আমি হাড়ে টের পাই।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন