পথিক যখন হিজলডাঙ্গার প্রান্তে এসে দাঁড়ায়, তখন সন্ধ্যার আবছা আলো তার সামনে বিস্তৃত এক অদ্ভুত দৃশ্য ফেলে। সারা গ্রামজুড়ে হিজলগাছের ঘন ছায়া, আর সেই ছায়ার ফাঁক দিয়ে সূর্যাস্তের শেষ আলো ফোঁটা ফোঁটা হয়ে মাটি ছুঁয়ে যায়। বয়ে যাওয়া নদীর পানিতে আলো-অন্ধকারের খেলা এমন, যেন প্রকৃতি নিজ হাতে মিশিয়ে তুলির টান দিয়ে কিছু বলতে চায়।
এই গ্রাম নিয়ে কত গল্প শুনেছি। শোনা যায়, এখানে রাত গভীর হলে বাতাস থেমে যায়, আর ঘন সবুজে ঢাকা গ্রামে শুরু হয় এক অদ্ভুত সুরের খেলা। সেই সুর কারো করুণ গানের মতো, কারো কাছে শোনায় অলীক হাসির মিশ্রিত শব্দ। একসময় এই গ্রামে এক অজ্ঞাত সাধু এসে বসতি গড়েছিলেন। তিনি নাকি গাছের পাতার মর্মরধ্বনিতে ঈশ্বরের বাণী শোনার চেষ্টা করতেন। কেউ কেউ বলে, তিনি মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিজের মধ্যে শোষণ করতেন, আর তার ফলেই একদিন তিনি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যান।
তবে এ কাহিনির সত্য-মিথ্যা জানার জন্য আমার আসা। আমি, অরিন্দম, এক শহরের কিশোর, গ্রামে এসে এই অদ্ভুত ঘটনার রহস্য উদঘাটনে মন দিয়েছি। প্রথম রাতটা কেমন স্বপ্নের মতো গেল। চারদিক শান্ত, নীরবতা এত গভীর যেন নিজেকে শোনা যায়। কিন্তু রাতের মাঝখানে হঠাৎ একটা কান্নার শব্দ শুনলাম। অন্ধকারে জানালার বাইরে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না, তবে মনে হলো, গাছের ছায়ার মধ্যে যেন কারা চলাফেরা করছে।
পরদিন সকালে গ্রামের এক বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বললেন, “বাবু, এই কান্না আমাদের গ্রামের চিরন্তন। সাধুর অভিশাপ অথবা আশীর্বাদ, আমরা জানি না। তবে মনে রেখো, এখানে যে প্রবেশ করে, তার জীবন আর আগের মতো থাকে না।”
তার কথা শুনে এক অদ্ভুত শিহরণে মনের ভেতর এক ধরনের আকর্ষণ জন্মাল। সেই রাতে, গভীর অন্ধকারে, আমি বেরিয়ে পড়লাম। সুর উঠল আবার, এবার যেন আরও স্পষ্ট। এক গাছের নিচে গিয়ে দেখি, একটা ছোট দীপ জ্বলছে, আর এক অদ্ভুত আলো-ছায়ার নাচন শুরু হয়েছে চারপাশে।
আমি যখন দীপটা ধরতে গেলাম, তখনই পেছনে একটা করুণ কণ্ঠে ডাক শোনা গেল, “থামো, পথিক। সত্য জানার ইচ্ছা তোমায় ধ্বংস করবে।” আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু বলার আগে, সব অদৃশ্য হয়ে গেল।
ভোরে উঠে দেখি গ্রামটা আবার স্বাভাবিক। কিন্তু সেই রাতের স্মৃতি আমার মন থেকে যায়নি। হয়তো হিজলডাঙ্গা তার গোপন রহস্য নিজেই পাহারা দেয়। আর সেই রহস্য আমি এখনও বয়ে বেড়াই।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন