শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলো সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে যেন আরও বেশি রহস্যময় হয়ে ওঠে। রাস্তার ধুলো মিশে যায় বাতাসে, আর সেই ধুলোমাখা বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকে অর্ণব। বুকের ভেতর এক অজানা শূন্যতা, এক অপূর্ণতা…
তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে রূপসা’র মুখ। মেয়েটার হাসি ছিল নদীর ঢেউয়ের মতো—একবার দেখলে বারবার দেখতে ইচ্ছে করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনেই পরিচয় হয়েছিল অর্ণব আর রূপসার। রূপসা ছিল প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি, আর অর্ণব ছিল শান্ত, গম্ভীর প্রকৃতির। একেবারে বিপরীত দুই মেরু, তবুও যেন এক অদৃশ্য সুতোয় তারা বাঁধা ছিল।
ক্লাসের ফাঁকে, লাইব্রেরির টেবিলে, কিংবা বৃষ্টির দিনে ক্যান্টিনের এক কোণে—অর্ণব আর রূপসা ধীরে ধীরে একে অপরের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল।
এক সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকের ধারে বসে ছিল তারা। চারদিকে গোধূলির আলো, বাতাসে একটা শীতল আমেজ।
রূপসা হঠাৎ বলল, “তুমি কখনো অনুভব করেছো, কিছু সম্পর্কের কোনো নাম হয় না, তবুও তারা সবচেয়ে গভীর হয়?”
অর্ণব চুপ করে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে।
রূপসা আবার বলল, “আমি চাই না আমাদের সম্পর্কের নাম দাও। আমি শুধু চাই, তুমি আমায় এমনভাবেই ভালোবেসে যাও, যেমন বাতাস ভালোবাসে গাছের পাতা, যেমন নদী ভালোবাসে সমুদ্রকে…”
অর্ণব ধীরে বলল, “তাহলে আমার ভালোবাসা থাকবে না? যদি একদিন দূরে চলে যাও?”
রূপসা হেসে বলেছিল, “ভালোবাসা কি কখনো দূরে যায়?”
দিন গড়াতে থাকল, তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হলো। কিন্তু এই ভালোবাসার মাঝেই এল এক ভয়ানক ঝড়।
রূপসার পরিবার ঠিক করল, তাকে বিয়ে দেবে এক ধনী ব্যবসায়ীর সঙ্গে। সে চাইলেও কিছু করতে পারছিল না। সমাজের নিয়ম, পরিবারের চাওয়া—সবকিছু যেন শিকল হয়ে তার পায়ে জড়িয়ে গেল।
অর্ণব দিশেহারা হয়ে পড়ল। অনেকবার রূপসার বাড়ির সামনে গিয়েছে, অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কিছুই বদলায়নি।
বিয়ের আগের দিন রূপসা একবার দেখা করতে চাইল অর্ণবের সঙ্গে।
শহরের এক নির্জন পার্কে তারা দেখা করল। অর্ণবের চোখ ছিল শূন্য, আর রূপসার চোখে ছিল না বলা হাজারো কথা।
“তুমি কি পালিয়ে যেতে চাও আমার সঙ্গে?” অর্ণব ফিসফিস করে বলল।
রূপসা ম্লান হাসল, “ভালোবাসা পালিয়ে গেলে কি টিকে থাকে?”
“তাহলে?”
রূপসা চুপ করে হাত থেকে একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো বের করল। তাতে লেখা ছিল—
“ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না, অর্ণব। হয়তো দেহের মিলন হলো না, কিন্তু আত্মার ভালোবাসা চিরকাল থাকবে…”
তারপর, রূপসা কেঁদে ফেলে অর্ণবের হাত ছাড়িয়ে চলে গেল—চিরদিনের জন্য।
বিয়ের দিন, অর্ণব শহরের রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছিল। তার পৃথিবী যেন থেমে গিয়েছে।
হঠাৎ একটা খবর এলো— রূপসা আর নেই।
বিয়ের কিছুক্ষণ আগে সে নিজের ঘরে নিঃশব্দে চিরবিদায় নিয়েছে।
অর্ণব ছুটে গেল তার বাড়ির সামনে, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। সে শুধু দূর থেকে দেখল, রূপসার শূন্য জানালা, যেখানে একদিন তারা স্বপ্ন দেখেছিল একসাথে থাকার।
সেদিন বিকেলের সূর্যটা যেন লাল হয়ে গিয়েছিল। সেটাও কি কাঁদছিল? হয়তো…
(শেষ)
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন