শক্তি চট্টোপাধ্যায়
(আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি)
শংকর ব্রহ্ম
১৯৩৩ সালের ২৫শে নভেম্বর, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার জয়নগরে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে শক্তি চট্টোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন।
তার মা কমলা দেবী এবং বাবা রামনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, যিনি কলকাতার ‘দ্য কাশিমবাজার স্কুল অব ড্রামায়’ পড়তেন। চার বছর বয়সে শক্তির বাবা মারা যায় এবং পিতামহ তার দেখাশোনা শুরু করেন।
১৯৪৮ সালে শক্তি কলকাতার বাগবাজারে আসেন এবং মহারাজা কাশিম বাজার পলিটেকনিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের সান্নিধ্যে মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচিতি হন। ১৯৪৯ সালে তিনি প্রগতি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন এবং “প্রগতি” নামে একটি হাতে-লেখা পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন, পরবর্তীতে, যা খুব শীঘ্রই মুদ্রিত রূপ নেয় এবং পুনরায় নাম বদল করে “বহ্নিশিখা” রাখা হয়।
১৯৫১ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং সিটি কলেজে ভর্তি হন তার এক মামার কাছে, যিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং তার তখনকার অভিভাবক, যিনি শক্তির হিসাবরক্ষকের চাকরি পাইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। একই বছর তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) সদস্য হন। ১৯৫৩ সালে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক (বাণিজ্য বিভাগ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, যদিও তিনি বাণিজ্য অধ্যয়ন ছেড়ে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক অধ্যয়নের জন্যে প্রেসিডেন্সি কলেজ (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা) ভর্তি হন, কিন্তু পরীক্ষায় উপস্থিত হননি।
১৯৫৬ সালে, শক্তিকে তার মামার বাড়ি ছেড়ে আসতে হয়েছিল এবং তিনি তার মা ও ভাইয়ের সঙ্গে উল্টোডাঙ্গায় একটি বস্তিতে চলে যান। সে সময়ে তিনি সম্পূর্ণরূপে তার ভাইয়ের স্বল্প আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। দারিদ্রের কারণে শক্তি স্নাতক পাঠ অর্ধসমাপ্ত রেখে প্রেসিডেন্সি কলেজ ত্যাগ করেন এবং সাহিত্যকে জীবিকা করার উদ্দেশ্যে উপন্যাস লেখা আরম্ভ করেন।
প্রথম উপন্যাস লেখেন কুয়োতলা। কিন্তু কলেজ – জীবনের বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে তার বনাঞ্চল – কুটির চাইবাসায় আড়াই বছর থাকার সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় একজন সফল লিরিকাল কবিতে পরিণত হন। একই দিনে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলার অভ্যাস গড়ে ফেলেন তিনি। শক্তি নিজের কবিতাকে বলতেন পদ্য। ভারবি প্রকাশনায় কাজ করার সূত্রে তার শ্রেষ্ঠ কবিতার সিরিজ বের হয়। পঞ্চাশের দশকে কবিদের মুখপত্র কৃত্তিবাস পত্রিকার অন্যতম কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তার উপন্যাস অবনী বাড়ি আছো? ‘দাঁড়াবার জায়গা’ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়।
আড্ডার মধ্য দিয়ে ১৯৬৫ সালে মীনাক্ষীর সাথে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম পরিচয় ঘটে, পরবর্তী কালে প্রণয় এবং তাদের বিয়ে হয়। তিতি চট্টোপাধ্যায় তাদের একমাত্র মেয়ে ।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকলেও কোনো পেশায় দীর্ঘস্থায়ী ছিলেন না। একসময় তিনি দোকানের সহকারী হিসেবে ‘সাক্সবি ফার্মা লিমিটেডে’ কাজ করেছেন এবং পরে ভবানীপুর টিউটোরিয়াল হোমে (হ্যারিসন রোড শাখায়) শিক্ষকতা করেন। ব্যবসা করার চেষ্টাও করেছিলেন এবং ব্যর্থ হওয়ার পর একটি মোটর কোম্পানিতে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দেন। তারপর তিনি ১৯৭০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করেছেন। তিনি
স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার ও রূপচাঁদ পক্ষী ছদ্মনামে অনেক ফিচার লিখেছেন। ১৯৬১-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি সাহিত্যে সক্রিয় ছিলেন।
জীবনানন্দ-উত্তর যুগের বাংলা সাহিত্যের তিনি একজন প্রধান আধুনিক কবি হিসেবে স্বীকৃত।
১৯৬১ সালের নভেম্বরে ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে যে চারজন কবিকে হাংরি আন্দোলন – এর জনক মনে করা হয় তাদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম । অন্য তিনজন হলেন সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায় এবং মলয় রায়চৌধুরী। শেষোক্ত তিনজনের সঙ্গে সাহিত্যিক মতান্তরের জন্য ১৯৬৩ সালে তিনি হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীতে যোগ দেন । তিনি প্রায় পঞ্চাশটি হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীকালে কৃত্তিবাসের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম সাহিত্যিক মহলে একত্রে উচ্চারিত হতো, যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলন এর ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং কৃত্তিবাস পত্রিকায় ১৯৬৬ সালে সেই মনোভাব প্রকাশ করে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন।
১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে , শক্তির কবিতা “যম” বুদ্ধদেব বসু প্রকাশিত কবিতা সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি কৃত্তিবাস এবং অন্যান্য পত্রিকার জন্য লিখতে শুরু করেন। বুদ্ধদেব বসুও তাকে নবপ্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য কোর্সে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান। শক্তি কোর্সে যোগদান করলেও সম্পূর্ণ করেন নি। ১৯৫৮ সালে শক্তি সিপিআইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক বন্ধ করে দেন।
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হে প্রেম, হে নৈশব্দ’ ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় দেবকুমার বসুর চেষ্টায়।
১৯৮২ সালে প্রকাশিত তার ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’ কাব্যগ্রন্থ ইংরেজি এবং মৈথিলী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে তিনি এই কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৭৪ সালে পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচালিত ‘ছেঁড়া তমসুখ’ চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন।
তিনি মোট ৪২টি কাব্যগ্রন্থ,
১০টি উপন্যাস,১১টি অনুবাদ গ্রন্থ ও একটি গল্পগ্রন্থ লিখেছেন। তাঁর অগ্রন্থিত লেখা নিয়ে ১৯৯০ সালের জানুয়ারী মাসে প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনস প্রা. লি. থেকে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৭৫ তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৩ সালে, তার যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো (১৯৮২) কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া তিনি একাধিক পুরস্কারে পেয়েছেন।
১৯৯৫ সালে গেষ্ট লেকচারার হিসাবে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি বিশ্বভারতীতে যান।
সেখানে ২৩শে মার্চ রাতে অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে, মাত্র ৬১ বছর বয়সে মারা যান।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পাঁচটি কবিতা :-
১).
অবনী বাড়ি আছো
অবনী বাড়ি আছো
অবনী বাড়ি আছো
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’
আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছ?’
২).
প্রভু, নষ্ট হয়ে যাই
বার বার নষ্ট হয়ে যাই
প্রভু, তুমি আমাকে পবিত্র
করো, যাতে লোকে খাঁচাটাই
কেনে, প্রভু নষ্ট হয়ে যাই
বার বার নষ্ট হয়ে যাই
একবার আমাকে পবিত্র
করো প্রভু, যদি বাঁচাটাই
মূখ্য, প্রভু, নষ্ট হয়ে যাই!
৩).
ধর্মের সোপানগুলি কাঁদে
ভক্তের পায়ের স্পর্শে ধর্মে
সোপানগুলি কাঁদে।
প্রতিমা একাকী থাকতে
চায়—কোনো ভক্তই বোঝে না,
কবিত্ব-অসুখে ভুগে প্রতিমা একাকী
থাকতে চায় ;
অন্তত একদিন ওকে ছুটি দাও, ও
ভক্তমণ্ডলী —
ভক্তের পায়ের স্পর্শে ধর্মের
সোপানগুলি কাঁদে
স্থানান্তরিত করো প্রতিমাকে এক
রহস্যলোকে।
কিছুক্ষণ আয়ু দাও কিশোরীর,
আনমনা হোক,
নিজেকে সাজাবে ব’লে তুলে আনুক
কুর্চি, পদ্মনাল—
এক কোঁচড় ফুল তুলে গাঁথুক একান্ত
মালাখানি।
তোমার মালাতে কেন প্রতিদিন ওর
ক্ষুধা মেটাবে ?
স্বকৃত মালায় সেজে রাজেন্দ্রাণী
জঙ্গলে দাঁড়াক।
কপোল চুম্বন করবো, চন্দন পরাবো
দুই হাতে—
একবার মানুষী হয়ে নামতে দাও
ধর্মের উঠোনে,
ভক্তের পায়ের স্পর্শে ধর্মের
সোপানগুলি কাঁদে !
৪).
আমাদের সম্পর্ক
ঈশ্বর থাকেন জলে
তাঁর জন্য বাগানে পুকুর
আমাকে একদিন কাটতে হবে।
.
আমি একা…
ঈশ্বর থাকুন কাছে, এই চাই–জলেই থাকুন!
.
জলের শান্তিটি তাঁর চাই, আমি, এমনই বুঝেছি
কাছাকাছি থাকলে শুনি মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিন
সম্পর্ক রাখাই দায়
.
তিনি তো মানুষ নন!
তা ছাড়াও, দূরের বাগানে
–থাকলে, শূন্য দূরত্বও
আমাদের সম্পর্ক বাঁচাবে।
৫).
আপন মনে
আমার ভিতর ঘর করেছে লক্ষ জনায়–
এবং আমায় পর করেছে লক্ষ জনে
এখন আমার একটি ইচ্ছে, তার বেশি নয়
স্বস্তিতে আজ থাকতে দে না আপন মনে।
লক্ষ জনে আমার ভিতর ঘর করেছে,
লক্ষ জনে পর করেছে।
আমার একটি ইচ্ছা,
স্বগতোক্তির মতো–আপন মনে থাকার।
যারা থাকতে দিচ্ছে না,
তাদের কাছে আমার এই সামান্য নিবেদন
বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন