ঢাকার উত্তরা এলাকার ছয়তলা একটা বাসার ছাদে রোজ বিকেলে একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নাম তার জারা আক্তার। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখে। চারপাশে হাজারো শব্দ, পাখির ডাক, গাড়ির হর্ন, ছাদে খেলারত বাচ্চাদের চিৎকার—সব কিছুর মাঝেও জারার চোখে থাকে অদ্ভুত এক নিরবতা।
আজ প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল। তবুও সে রোজ আসে ছাদে, একই সময়, একইভাবে, যেন কিছু একটার অপেক্ষায়।
জারার জীবনের গল্পটা খুব সাধারণ ছিল, যতক্ষণ না সে বিশ্ববিদ্যালয়ে আদিল নামের এক ছেলেকে চিনত।
আদিল ছিল অন্যরকম—চুপচাপ, বইপ্রেমী, আড্ডায় কম আগ্রহী। কিন্তু তার চোখে ছিল গভীর একটা আকর্ষণ, যে চোখে তাকালে মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে।
তাদের বন্ধুত্ব শুরু হয় লাইব্রেরির পেছনের বেঞ্চে। ধীরে ধীরে সেই বন্ধুত্ব এক নিঃশব্দ ভালোবাসায় রূপ নেয়। কেউ কাউকে বলেনি কিছু, কিন্তু চোখ আর উপস্থিতি দিয়ে সব বলা হয়ে গিয়েছিল।
একদিন আদিল বলেছিল
“জারা, আমরা কি একসাথে জীবনের পথ চলতে পারি?”
জারা একটু সময় নিয়ে বলেছিল
“আমি তোমার হবো, কিন্তু যদি তুমি কথা দাও কোনদিন হারিয়ে যাবে না।”
আদিল মুচকি হেসে বলেছিল, “যদি একদিন হারিয়েও যাই, জানবে—ফিরব, ঠিক সূর্যাস্তের সময়। তখন আকাশ লাল হবে, আর আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকব।”
তারপর একদিন, হঠাৎ করেই সব বদলে গেল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ঠিক আগেই আদিল নিখোঁজ হয়ে গেল।
মোবাইল বন্ধ, ফেসবুক ডিঅ্যাক্টিভেট, কোথাও কোনো খোঁজ নেই।
জারা প্রথমে ভাবল, হয়তো কোনো সমস্যায় আছে। একদিন, দুইদিন… একমাস… তারপর এক বছর কেটে গেল।
অনেকে বলল, “ভুলে যাও। জীবন থেমে থাকে না।”
কিন্তু জারা করো কথাই কানে নেয় নাই।
সে প্রতিদিন ছাদে আসে, ঠিক সূর্যাস্তের সময়। একরকম প্রতিজ্ঞা হয়ে গেছে যেন—
যদি আদিল ফিরে আসে, সে যেন জারাকে ঠিক আগের জায়গায় খুঁজে পায়।
পাঁচ বছর পরে
একদিন ছাদে জারা বসে আছে। হালকা বাতাস, আকাশের রঙ ক্রমশ লালচে হচ্ছে। হঠাৎ পেছন থেকে একটি কণ্ঠস্বর!
“এই জায়গাটা দেখছি এখনো আগের মতই আছে?”
জারা প্রথমে চমকে ওঠে। ধীরে ধীরে ফিরে তাকায়।
সামনে দাঁড়িয়ে আদিল। পাঁচ বছর আগের সেই চেহারা নয়, মুখে দাড়ি, চোখে ক্লান্তি, কাঁধে পুরনো একটা ব্যাগ।
“তুমি!”—শুধু এটুকু বলতে পারে জারা।
আদিল ধীরে ধীরে বলে,
“আমার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। গ্রামে গিয়ে দেখি জমি-জমা নিয়ে প্রচন্ড বিবাধ বেঁধে ছিল আমার পরিবারে। মা ক্যান্সারে ভুগছিলেন। একসময় সবকিছু এত কঠিন হয়ে গেল যে… আমি তোমার সামনে দাঁড়ানোর সাহস হারিয়ে ফেলি। কিন্তু তোমার কথা রোজ মনে পড়ত।”
জারা চোখের জল আটকাতে পারে না।
“তুমি জানো, আমি রোজ এখানে আসি। ঠিক সূর্যাস্তের সময়। তুমি বলেছিলে—তুমি ফিরবে, আকাশ লাল হলে।”
আদিল এক পা এগিয়ে আসে।
“তাহলে আজ কি আবার প্রথম থেকে শুরু করা যায়?”
জারা কিছু বলে না। সে শুধু সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে থাকে—আকাশের রঙ লাল, চারদিকে আলো-ছায়ার খেলা।
অপেক্ষার রঙ যে আজ সত্যিই রঙ পেয়েছে।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন